আমি পণ্ডিত নই, মানুষ যে কেন আমায় পণ্ডিত বানিয়েছেন, সেই হিসেব আজও আমার কাছে বিশেষ স্পষ্ট নয়। আমি এই শব্দটি নিয়ে এত তর্ক-বিতর্ক ও আলোচনা আছে যে, সেগুলো নিয়ে কথা বলতেও নিজেকে ছোট বলে মনে হয়। পাণ্ডিত্য মানে জ্ঞান, বুদ্ধি, বিচার, বিশ্লেষণ। আর জ্ঞান তো জলের থেকেও পাতলা। তাই সেই বিচার করলে মনে হয়, যেমন একজন ছাত্র ছিলাম ছোটবেলায়, এখনও ঠিক তেমনটাই আছি। শুধু খানিক অভিজ্ঞতা বেড়েছে।
ছোটবেলার পুজো
ছোটবেলার পুজো মানে আমার কাছে দুধে দেওয়া কলম আর দোয়াত… আর সেটা দিয়ে বইয়ের মধ্যে লিখতে হবে, ‘ওঁ সরস্বতী নম’। এটা না করলেই মুশকিল। বিদ্যে বুদ্ধি কিচ্ছু হবে না। যত বয়স বাড়তে লাগল, তত বুঝতে পারলাম, সরস্বতী মানে যার অধিষ্ঠান নিজের মধ্যে। একমাত্র সরস্বতীই যার কোনও মন্দির হয় না, এখানে-সেখানে নানা দেব-দেবীর মন্দির আছে, কিন্তু মায়ের মন্দির হয় না। কেন জানেন? কারণ মায়ের স্থান মনের গভীরে, মনের অন্দরে, কাজেই তাঁর আর কোনও মন্দিরের প্রয়োজনই পড়ে না। অজানা থেকে জানার এক ইঞ্চির দিকে এগনো মানেই যে সরস্বতী।
হাঁস হতে হবে
এই যে সরস্বতীর বাহন হাঁস, কেন জানেন? সিংহ তো হতে পারত, আর কত বড় বড় জন্তু আছে। হাঁসই কেন? তার কারণ, হাঁস একমাত্র প্রাণী যে প্রাণী ঠোঁট দিয়ে বন্ধ-খোলা করতে-করতে দুধ জল থেকে জলটা ফেলে দিয়ে শুধু দুধটা গ্রহণ করতে পারে। এরই নাম তো শিক্ষা। এই শিক্ষাই যে দেন মা সরস্বতী। ভালকে গ্রহণ আর খারাপকে পরিত্যাগ। আমাদের সবাইকে হাঁস হতে হবে। যার মধ্যে এই গুণ আছে, একমাত্র তারই এই পুজোর অধিকার আছে।
কে বলেছে রেওয়াজ বন্ধ?
ওই দিন বাবা আমায় জোর করে পড়াশোনা করতে বসাতেন। তাঁর যুক্তি ছিল, ওই দিন ঠাকুরের দিকে তাকাও। কিছু একটা করতেই হবে। যা পারবে না, সেগুলো ঠাকুরের পায়ে সমর্পণ করতে হবে। হতে পারে আজকে আবার দু’টো তান ভাল হয়নি। মায়ের পায়ে সেই দু’টো তান রাখছি, যাতে তিনি সেটা ঠিক করে দেন, এই শিক্ষাই পেয়েছি আমরা। সরস্বতী পুজোর দিন কেন রেওয়াজ বন্ধ থাকবে? আর রেওয়াজ এমন একটা জিনিস, যা প্রতি মুহূর্তে মনের ভিতর হতে থাকে। তার জন্য কোনও দিনক্ষণ, সময়ের দরকার পড়ে না। বাথরুমেও কিন্তু রেওয়াজ করা যায়। আমার অধিকাংশ সুর কিন্তু বাথরুমেই হয়েছে। আসল ব্যাপারটা হল একাগ্রতা। সেটা যার মধ্যে কম রয়েছে, তার সরস্বতী পুজো করে কী লাভ? GFX CARD: এখন একাগ্রতার বিষয়টা কমে যাচ্ছে কম্পিউটার আর টেলিফোনের কারণে। সারা পৃথিবীর ফালতু তথ্য আমাদের কাছে, যা আমাদের দরকার নেই।
প্রেম ছিল তবে…
ভীষণ ভীষণ মনে হয়েছে। তা হল বিদ্যার প্রতি প্রেম। প্রেম তো শুধুই শারীরিক নয়। শারীরিক প্রেম হল সবথেকে সহজ ও সস্তা! আমি সস্তা জিনিস কেন করব? প্রেম মানে তো ভালবাসা। সেই ভালবাসার জন্য তো কোনও মানুষ দরকার হয় না। বন্ধু-বান্ধবদের যে সস্তার আলোচনা করতে দেখিনি, তা নয়। কিন্তু আমার বাবা বরাবরই আমায় মূল্যবোধ শিখিয়েছেন। সবাই যেটা করে সেটা সহজ। কাজেই চেষ্টা করতে হবে—একটু আলাদা হতে। আর সেই লিগাসিটাই আমার পরবর্তী প্রজন্ম টেনে নিয়ে গিয়েছে। কৌশিকীকে কখনও আমি মোড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে আড্ডা দিতে দেখিনি। আমার নাতি সব জায়গায় যায়, আড্ডা দেয়, কিন্তু তার মধ্যে সৌন্দর্যবোধও আছে। এটা দরকার, সেটা বজায় রাখা দরকার। আর সেটা যাপন করলেও ভিড়ের মাঝে আলাদা হওয়া যায়। সবার সঙ্গে মিশে যাওয়া দরকার, কিন্তু ছাগল হয়ে বেঁচে কী লাভ? দরকার তো মানুষ হওয়া। সেটাই যদি না হতে পারি, তাহলে সবটাই যে ব্যর্থতা। ওই যে প্রথমেই বললাম, হাঁস হতে না পারলেন সরস্বতী পুজোর পুরোটাই বেকার। পুরোটাই ব্যর্থ।
(অনুলিখনের ভিত্তিতে লিখিত) অনুলিখন: বিহঙ্গী বিশ্বাস