স্নেহা সেনগুপ্ত
কঙ্কনা সেন শর্মা, অর্জুন রামপাল, তন্ময় ধননিয়া। তিন মুখ্য অভিনেতা। ছবির নাম ‘দ্য রেপিস্ট’। পরিচালক অপর্ণা সেনের ছবি। ধর্ষণকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছে ছবিটি। ছবিতে দুটি ভারতবর্ষকে দেখাতে চেয়েছেন অপর্ণা সেন। ধর্ষণকে কেন্দ্র করে যে-যে প্রশ্ন পরিচালককে ভাবায় বা তাঁর মনে প্রশ্ন তোলে, সেটাই তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন ছবিতে। সেই সঙ্গে উঠে এসেছে মৃত্যুদণ্ড, রেস্টোরেটিভ জাস্টিস, ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টের বিচার ব্যবস্থাও। ধর্ষক কেন ধর্ষণ করে? সমাজে কীভাবে একজন ধর্ষক তৈরি হয়..? ছবিতে উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছেন অপর্ণা। অ্যাপ্লজ় এন্টারটেনমেন্ট ও কোয়েস্ট ফিল্মসের ব্যানার ও প্রযোজনায় তৈরি ছবিটি ইতিমধ্যেই আলোচনার কেন্দ্রে। ছবিতে ধর্ষককে সমবেদনার দৃষ্টিভঙ্গীতে দেখিয়েছেন অপর্ণা সেন। ছবি নিয়ে TV9 বাংলার সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে অকপট অপর্ণা।
‘দ্য রেপিস্ট’ ছবিতে যে ধর্ষককে দেখানো হয়েছে, সে বস্তি এলাকার বাসিন্দা। ওই শ্রেণির একজন মানুষকে কেন ধর্ষক হিসেবে দেখালেন আপনি? সমাজের অন্য স্তরের মানুষও তো ধর্ষণ করে…
বস্তির ছেলেই রেপিস্ট, সেই জন্য কিন্তু দেখাইনি। তার শৈশব-কৈশোর-যৌবন কীরকম কেটেছে, মায়ের উপর কী ধরনের অত্যাচার সে দেখেছে, বোনের উপর কী ধরনের অত্যাচার সে দেখেছে… যা দেখে বড় হয়েছে, দেখিয়েছি। এইভাবেই তো একজন মানুষ তৈরি হয়। ধর্ষক একজন অন্য শ্রেণিরও হতে পারে। কিন্তু আমি দু’টো ভারতবর্ষকে দেখাতে চেয়েছি আমার ছবি ‘দ্য রেপিস্ট’-এ। আমি গ্রামের ভারতবর্ষকে দেখাইনি। কারণ সেই সুযোগ এই ছবিতে ছিল না। কিন্তু দরিদ্র ভারতবর্ষ, স্বচ্ছল ভারতবর্ষ, কুসংস্কারে আচ্ছন্ন পুরনো পুরুষতান্ত্রিক মূল্যবোধকে আঁকড়ে থাকা ভারতবর্ষকে দেখিয়েছি। আর সেই সঙ্গে দেখিয়েছি আধুনিক, শিক্ষিত, অন্যরকম একটি ভারতবর্ষকেও। এই দু’টোকে মুখোমুখি আনতে চেয়েছিলাম। দু’টোরই সমস্যা রয়েছে।
কঙ্কনা সেনশর্মা, অর্থাৎ ছবির নয়না একজন ক্রিমিনাল সাইকোলজিস্ট। সে ধর্ষিত হয়েছে এবং তিহার জেলে রেপিস্টের সঙ্গে দেখা করেছে। তার ধর্ষকের সঙ্গে জেলে ইন্টারভিউ রেকর্ড করে নয়না… এখানে কি আপনি কোনও বার্তা দিতে চেয়েছিলেন?
একটা নতুন নিয়ম এসেছে। ইচ্ছে করেই সেটা আমি স্পষ্ট করে আমার ছবিতে বলিনি। কারণ সুস্পষ্ট মেসেজ দেওয়া আমি পছন্দ করি না। ‘দ্য রেপিস্ট’ থেকে মানুষ যে বার্তা গ্রহণ করবেন, সেটাই মেসেজ বা বার্তা। আপনি যেটা গ্রহণ করেছেন, সেটা ঠিকই গ্রহণ করেছেন। অপরাধকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য নতুন ধরনের উপায় উদ্ভাবন করেছে ‘রেস্টোরেটিভ জাস্টিস’ (restorative justice)। এটা কিন্তু খুবই সাম্প্রতিক বিষয়। অর্থাৎ, যে রেপিস্ট, যে সার্ভাইভার, তাঁরা মুখোমুখি হয়। নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে। যাঁরা রেস্টোরেটিভ জাস্টিসে বিশ্বাস করেন, তাঁরা মনে করেন রেপিস্টকে কিংবা একজন খুনিকে মেরে ফেললেই সমাজের দায়িত্ব সম্পন্ন হয় না। তাকে রিহ্যাবিলিটেট করতে হয়। কারণ গবেষণার ফলে দেখা গিয়েছে, ডেথ পেনাল্টি কোনওভাবেই অপরাধ করা থেকে বিরত থাকতে পারে না। এটা গবেষণাতেও প্রমাণিত। ফলে কীভাবে তাঁদের রিহ্যাবিলিটেট করা যায়? তাদের সঙ্গে দেখা করে, কথা বলে বিষয়টা ঘটে। এটাই রেস্টোরেটিভ জাস্টিসের পন্থা। আমি সেই পন্থাকেই আমার ছবিতে ব্যবহার করেছি। সত্যি-সত্যিই একটি মেয়ের মনে হতে পারে, কেন আমার সঙ্গে এটা হল, কেন আমাকে ধর্ষণ করা হল। তাঁর রাগও থাকে। প্রচণ্ডভাবে রাগ থাকে। সেই রাগটাকেই আমি দেখিয়েছি। পাওয়ালেসনেস থেকে পাওয়ারফুল হওয়ার ইচ্ছা… সমস্তটাই থাকে। ছবিতে সবটাই রেখেছি। এবং সেই সঙ্গে রেখেছি রেস্টোরেটিভ জাস্টিসকেও। রেপিস্ট ও রেপ সার্ভাইভারের সামনাসামনি হওয়াটা আমি ব্যবহার করেছি আমার ছবি ‘দ্য রেপিস্ট’-এ।
আপনি নিজে ওয়ান-অন-ওয়ান সম্পর্কে খুব বিশ্বাস করেন। এখানে কোথাও গিয়ে ধর্ষক ও ধর্ষিতার মধ্যে একটা সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল?
হ্যাঁ। পরস্পরকে জানতে-জানতে একজন মানুষ হিসেবে অন্যজনকে দেখার একটা বিষয় ছিল। সেই দেখা কেবল ধর্ষক হিসেবে দেখা নয়। সেখানেই বোঝা যায়, সমাজে কেন একজন ধর্ষক তৈরি হয়।
আপনি দেখিয়েছেন ধর্ষক নিজেও ধর্ষণের শিকার। তার সঙ্গে দিনের পর-দিন অন্যায় ঘটে গিয়েছে…
এটা কিন্তু খুব হয়। আমি জিজ্ঞেস করেছি। জেনেছি। কিন্তু সব ধর্ষকই কোনও না-কোনও সময় ধর্ষিত হয়েছে, তা-ও কিন্তু নয়। এটা কিন্তু খুবই কমন বিষয়।
ছবি দেখে অনেকেরই কিন্তু ধর্ষকের উপর সমবেদনা হতে পারে… বারবার মনে হয়েছে অনেক মানবিকভাবে বিষয়টা তুলে ধরেছেন আপনি।
হ্যাঁ, ঠিক। ঠিক ধরেছেন। কিন্তু আমার ছবিতে ধর্ষক ভীষণ ভয় পেয়েছিল। তাকে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। প্যান্ট ভিজিয়ে ফেলছিল সে। এরকম অবস্থাটা! জলটা অনেকক্ষণ ধরে খাচ্ছিল, যাতে মৃত্যুর মুহূর্তটাকে সে পিছিয়ে দিতে পারে। সেখানে কিন্তু হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে নয়নাকে (অভিনেত্রী কঙ্কনা সেন শর্মা) ‘রন্ডি’ ইত্যাদি বলতে আরম্ভ করে। আমি নিজেও কিন্তু জানি না কেন বলল। শেষে নয়নাকে ওঁর স্বামী যখন জিজ্ঞেস করল, ‘ধর্ষকের কি অনুশোচনা হয়েছে?’ কঙ্কনা বলল, ‘আমি জানি না!’ সবকিছু আসলে সাদা-কালো হয় না। কিছু ধূসর জায়গা থাকে। আমি সেই ধূসর জায়গাগুলোকে ধরতে চেয়েছিলাম।
ধর্ষক জেলের জানলা দিয়ে ধর্ষিতাকে বলছে, ‘বুধবার আমার ফাঁসি’। ধর্ষিতা বলছে, ‘না, না, বেশি যন্ত্রণা হবে না’। এখানে কি কোথাও আপনি বলতে চেয়েছেন, যে যন্ত্রণা তুমি আমাকে দিয়েছ, সেটার তুলনায় তোমার শাস্তি অনেক লঘু?
তা কিন্তু নয়। আমি তা বলতে চাইনি। মেয়েটি সত্যি-সত্যি তার ধর্ষককে মানবিক দিক থেকে দেখেছে। তার বাড়িতে গিয়েছে। বেড়ে ওঠার পরিস্থিতি দেখেছে। কিছুটা তাকে ‘ভিকটিম’ (পরিস্থিতির শিকার) ভাবতে শুরু করেছিল। তাই না? বুঝতে পেরেছে, যে শৈশব ছেলেটি কাটিয়েছে, যেমনভাবে বাবাকে পেয়েছে, সেই ধরনের চিন্তাধারার মানুষ তৈরি হয়েছে। সেখানে সে নিজেও সামাজিক ভিকটিম। ভুললে চলবে না, মেয়েটি কিন্তু একজন অ্যান্টি ডেথ পানিশমেন্ট অ্যাক্টিভিস্ট। ওর স্বামী আফতাবও (অর্জুন রামপাল) তাই। মৃত্যুর আগে ছেলেটি ভয় পাচ্ছিল। সেটা দেখে স্বাভাবিক-মানবিক ভাবনা থেকেই বলেছিল যন্ত্রণা কম হবে। মেয়েটি কিন্তু ডেথ পেনাল্টিতে বিশ্বাস করে না।
আপনি ডেথ পেনাল্টিতে (মৃত্যুদণ্ড) বিশ্বাস করেন?
আমি জানি না আসলে। কিন্তু কখনও-কখনও কাশ্মীরের মেয়েটি কিংবা দিল্লির নির্ভয়া… এদের ক্ষেত্রে মনে হয়েছে ধর্ষকদের বাঁচার কোনও অধিকার নেই। দেখুন, যে সব প্রশ্ন আমাকে ভাবায়, ‘দ্য রেপিস্ট’-এ তা আমি তুলে ধরেছি। আমি কোনও সমাধান দিতে চাইনি। সবকিছুর উত্তর যে আমি নিজে জানি, তা-ও কিন্তু নয়। আমিও উত্তর খুঁজছি।
সাম্প্রতিককালে হাঁসখালির ঘটনাটাও তো ঘটেছে…
সে তো বটেই। একজন নাবালিকাকে ধর্ষণ করা হয়েছে। কী বলি! কী বলা যায় বলুন তো! এই ধরনের দানবীয়, পৈশাচিক কাজ যদি মানুষ করে, কী বলা যায়… তাকে ধিক্কার দেওয়া ছাড়া তো কিছু বলা যায় না।
একটি ধর্ষণকাণ্ডের রায় বেরতে অনেকটা সময় লাগে। কিন্তু আপনি ছবিতে রায় বেরনোর সঙ্গে-সঙ্গে ফাঁসির সাজা শোনানোর প্লট রেখেছেন…
হ্যাঁ আমি দেখিয়েছি। কারণ, অনেক কথা হয়েছিল ফাস্ট ট্র্যাক কোর্ট নিয়ে। মালিনীর স্বামী বলল, ‘আমরা ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টে যাব’। আমি ভেবেছিলাম, একটা সিন রাখব, যেখানে ও ঘুষ দিচ্ছে। কিন্তু সেটা আমি করিনি। কারণ মনে হয়নি প্রয়োজন আছে বলে। তার উপর কিছুটা তো দর্শকের কল্পনার উপরও ছেড়ে দিতে হবে। নির্ভয়ার সময় আমাদের দেশের আইন ব্যবস্থা একটু নড়েচড়ে বসেছে। জনগণের চাপ ছিল তীব্র। সেই সময়তেই ফাস্ট ট্র্যাক কোর্ট শুরু হয়। সেখানেও কিন্তু সময় লাগে। কিন্তু ছবির ক্ষেত্রে কিছুটা সিনেম্যাটিক লাইসেন্স নিতেই হয়। না হলে গল্পটাই বলা যায় না।
ধর্ষণ যারা করছে, কিংবা করার কথা ভাবে… তাদের পর্যন্ত ছবিটা পৌঁছল কি?
এই বিষয়টা কিন্তু আমার হাতের মধ্যে নেই। কিন্তু আমার ছবির পর যদি ডিবেট হয়, বিতর্ক সৃষ্টি হয়, আলোচনা হয় কিংবা কথাবার্তা হয়… সেই কথাবার্তার কারণে যদি সিস্টেমে পরিবর্তন হয়, তাহলে নিশ্চয়ই হবে। ধর্ষকের কাছে বিষয়টা পৌঁছনোর চেয়েও বড় বিষয়, যে সমাজ তাকে ধর্ষক করে তুলেছে সেই সমাজের কাছে পৌঁছল কি না। একটি মেয়ের উপর অত্যাচার করা সবচেয়ে সহজ। কারণ সে কিছুটা হলেও পাওয়ারলেস হয়ে পড়ে। সেই সুযোগটা নেওয়া হয়। ছবিতেই তো আছে, সোনিয়া বলে মেয়েটি রাতের বেলায় বেরিয়েছিল বলে তাকে মোটরসাইকেলে এসে শাসিয়ে যায় ছেলেগুলো। বলে এই মহল্লার না হলে এখানেই শেষ করতাম। তার মানে কী? রেপ করতাম, মেরে ফেলতাম… ওই সব করতাম!
ছবির শেষে একটি সংলাপ আছে, ‘মালিনী জাগ গই হোগি’…
এখানে এটাই বলতে চেয়েছি, এখানে মৃত্যু ঘটেছে। কিন্তু জীবনও চলছে নিজের ছন্দে। জীবন তো চলতেই থাকে। আমার বহু ছবিতেই এটা আছে। ‘পারমিতার একদিন’-এও আছে। সনকা মারা গেল। আর একটা নতুন প্রাণও এল। সেই গানটা ছিল ‘পারমিতার একদিন’-এ… ‘বিপুল তরঙ্গ রে’… সেই ব্যাপারটা, যে জীবন ও মৃত্যুর একটা সাইকেল রয়েছে। তার মধ্যে আনন্দ আছে। বাচ্চাও আছে। ধর্ষক প্রসাদ সিংয়ের সন্তানকে জন্ম দেয় নয়না। বাচ্চাটাকে মানুষ করার দায়িত্ব নেয় সে ও তার স্বামী আফতাব। এমন নয় যে তাকে ফেলে দেওয়া হয়েছে। সে একটি রেপের সন্তান। কিন্তু তাকে নার্চার করছে, মানুষ করছে শিক্ষিত বাবা-মা।
২০২১ সালের ৭ অক্টোবর ২৬তম বুসান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে গিয়েছে ‘দ্য রেপিস্ট’। পেয়েছে কিম জিসেওক সম্মান। সেখানে দেখান হয় ছবিটি। সম্প্রতি কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবেও দেখান হয়েছে।