মাধ্যম বা ভাষা যাই হোক না কেন, জয় হোক সিনেমার

স্বরলিপি ভট্টাচার্য |

Jan 10, 2021 | 7:46 PM

আড্ডার সবথেকে সিনিয়র সদস্য ছিলেন পরিচালক হরনাথ চক্রবর্তী। অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ পরিচালক যেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে মনে করিয়ে দিলেন এক পুরনো কথা। “এমন ছবি করো না, যা আর্ট থেকে বেরিয়ে ব্লু ফিল্ম হয়ে যায়।” এই কথাই যেন আগামীর চলার পাথেয়।

মাধ্যম বা ভাষা যাই হোক না কেন, জয় হোক সিনেমার
আড্ডার মঞ্চে শিল্পীরা।

Follow Us

শুভঙ্কর চক্রবর্তী: কিছুদিন আগে লকডাউনে যখন মন খারাপ করে বসে থাকতেন, তখন একের পর এক ওটিটি প্ল্যাটফর্ম আপনাকে সঙ্গ দিয়েছিল তো? বন্ধু হয়ে হয়তো আপনার হাত ধরতে পেরেছিল নতুন সিরিজ বা পুরনো সিনেমা। আবার বড়পর্দার আমেজ, পছন্দের অভিনেতার এন্ট্রির পর হল জুড়ে হাততালির উত্তেজনাও হয়তো মিস করেছেন আপনি। পরিস্থিতি এখনও অনুকূল নয়। এখনও সিনেমা হলে তেমন কোনও নতুন ছবি মুক্তি পাচ্ছে না। সেই ওটিটিই ভরসা। তাহলে কি ‘ডিজিট্যাল প্ল্যাটফর্ম সিনেমার ভাষা বদলে দিচ্ছে?’

রবিবার ২৬তম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের (KIFF 2021) তৃতীয় দিনে এটাই ছিল আড্ডার বিষয়। মঞ্চে তখন চাঁদের হাট। দুই পক্ষের অতিথিদের সামলাতে রেফারি থুড়ি সঞ্চালকের আসনে সৌরভ দাস। পক্ষের বক্তা সৌরভ চক্রবর্তী, ঋতব্রত মুখোপাধ্যায়,অনিন্দিতা বসু, ঈশা সাহা, সৌরসেনী মৈত্র। বিপক্ষে বললেন ধ্রুব বন্দ্যোপাধ্যায়, আবির চট্টোরাধ্যায়, অর্জুন চক্রবর্তী, হরনাথ চক্রবর্তী, অরিজিৎ দত্ত, ঋদ্ধি সেন।

আড্ডার মুখরা ধরে দিলেন পরিচালক ধ্রব বন্দ্যোপাধ্যায়। “প্রত্যেকটা প্ল্যাটফর্মকে কনটেন্ট দিয়ে ঋদ্ধ করতে হবে। ওটিটি খুব পার্সোনালাইজ। সিনেমা সোশ্যাল মিডিয়াম। সিনেমা মানে ১০০ জন হাসছেন, কাঁদছেন, সেটা আনন্দ দেয়”, বললেন ধ্রুব।

ধ্রুবর মতোই আনন্দের খোঁজ দিলেন পরিচালক তথা অভিনেতা সৌরভ চক্রবর্তী। তাঁর কথায়, “ওটিটি মিডিয়াম। আর টেকনোলজিটা সিনেমার মান বদলে দেবে। বই তো সবাই মিলে পড়ি না। ওটিটিতে দেখা তো তেমনই। বই পড়া যেমন আনন্দ দেয়। ওটিটিও তেমন আনন্দ দেয়য। ওটিটি সিনেমার ভাষা বদলায়নি, সিকিওর করেছে সেই জায়গাাটা। তবে সিনেমার ন্যারেশনটা বদলেছে।”

আরও পড়ুন, সামাজিক বার্তাবাহী ছবি সমাজ বদলাতে পারে না: অনুভব সিনহা

সিনেমার ভাষা বদলানোর পক্ষে সওয়াল করলেন অভিনেতা অর্জুন চক্রবর্তীও। তিনি মনে করেন, “সিনেমার ভাষা বদলাচ্ছে। ওটিটি সিনেমাকে বিস্তৃত একটা জায়গায় পৌঁছে দিচ্ছে। তবে এটাও ঠিক, ওটিটিটে ডিসট্র্যাকশনও হয়। পজ করে যাই। সেটা সিনেমা হলে হয় না। যদি মোবাইল আটকে রেখে সিনেমা হলে যাওয়া যায়, সেটাই বোধহয় ভাল হত।”

কিন্তু সিনেমার ভাষা বদলানোর যুক্তিকে মানতে চাইলেন না অভিনেতা ঋদ্ধি সেন। “সিনেমার ভাষা অনেক আগেই বদলে দিয়েছেন কিম কি দুন, মৃণাল সেন। আর কী বদলাবে? আমার মনে হয়, অভিনয় দেখতে হলে নাসিরুদ্দিন বা নওয়াজের অভিনয় দেখতে গেলে সিনেমাতেই দেখতে হবে।কয়েক বছর আগে কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় একটা ছবি করেছিলেন। ‘শব্দ’। ফলি আর্টিস্টদের কথা ছিল। সেই ফলি আর্টিস্ট বা কালারিস্টদের কাজ সূক্ষ্ম কাজ দুহাতে ফোন নিয়ে ওটিটিতে দেখা সম্ভব নয়”, মত ঋদ্ধির। প্রিয়া সিনেমার কর্ণধার অরিজিৎ দত্তও মনে করেন, “শোলে বা ডিডিএলে যদি মোবাইলে দেখানো হয়, ভাল লাগবে? কোনওভাবেই ভাল লাগবে না।”

আড্ডা শুরুর আগে চলছে চা-পর্ব।

দর্শকাসনে সাধারণের পাশে তখন হাসিমুখে বসে পরিচালক অরিন্দম শীল, কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের চেয়ারম্যান রাজ চক্রবর্তী প্রমুখ। মঞ্চে বক্তাদের একাধিক প্রশ্ন করেছেন তাঁরা। অভিনেতা আবির চট্টোপাধ্যায় শেয়ার করলেন, লকডাউনের সময় তাঁর টেলিভিশনে কামব্যাকের গল্প। “আমি যখন প্রথম সিনেমায় অভিনয় করতে শুরু করি, লোকে বলেছিল, এ কি সিনেমা করবে, এ তো টেলিভিশনে ছেলে। লকডাউনে যখন আবার ফেরত গেলাম টেলিভিশনে, তখন এটা কেউ বলেনি। সিনেমায় একটা বড় অন্ধকার ঘরে পাশের জনের হাসি, কান্নার গুরুত্ব অনেক বেশি। ওটিটিতে সেটা করা যায় না। লকডাউনে মানুষ আরও একা হয়েছে। তার জন্য এখন সিনেমার প্রয়োজন। যাতে একসঙ্গে হাসি কান্নার অনুভূতির শরিক হতে পারি আমরা। আর ওটিটিতে এই মুহূর্তে কাজের কোনও অফার নেই। তবে তেমন চরিত্র পেলে নিশ্চয়ই কাজ করর।”

অর্থাৎ আবিরের মতে, মাধ্যম আলাদা হলেও অভিনয়ের আলাদা কিছু নেই। পর্দার ‘সোনাদা’ অর্থাৎ আবিরকে সমর্থন করলেন ‘গুপ্তধনের সন্ধানে’, ‘দুর্গেশগড়ের গুপ্তধন’-এর ঝিনুক, অর্থাৎ ঈশা সাহা। তাঁর কথায়, “সব প্ল্যাটফর্মেই অভিনয় এক। তবে লকডাউনে বাবা-মাকে ওটিটিতে পুরনো ছবি দেখিয়েছি। ওঁরা এনজয় করেছেন।” ওটিটি নতুনদের জায়গা করে দিয়েছে বলে মনে করেন অভিনেতা ঋতব্রত মুখোপাধ্যায়।

আরও পড়ুন, কলকাতা আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল-এ ‘চিকেন তেহারি’

এদিনের আড্ডার সবথেকে সিনিয়র সদস্য ছিলেন পরিচালক হরনাথ চক্রবর্তী। অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ পরিচালক যেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে মনে করিয়ে দিলেন এক পুরনো কথা। “এমন ছবি করো না, যা আর্ট থেকে বেরিয়ে ব্লু ফিল্ম হয়ে যায়।”

এই কথাই যেন আগামীর চলার পাথেয়। এক ঘণ্টার আড্ডায় এক কথায় জিতে গেল সিনেমা। যে ভাষাতে বা যে মাধ্যমেই তৈরি হোক না কেন, জয় হোক সিনেমার।

Next Article