পুজোয় রাত জেগে ঠাকুর দেখায় তো আর নতুনত্ব কিছু নেই। তবু প্রতিবছরই রীতি মেনে পালন করা হয় সেই বার্ষিক রেওয়াজ—রাত দেখে ঠাকুর দেখা। তবে এবারের পুজোটা হয়তো একটু অন্যরকম হয়ে যেতে পারে, যদি ঠাকুর দেখার সঙ্গে সঙ্গে রাত জেগে চলে হলে বসে সিনেমা দেখাও। এবারের দুর্গাপুজোর রাতের মজা দ্বিগুণ হবে কি না, তা যদিও নির্ভর করছে রাতভর সিনেমা হল খোলার রাখার সিদ্ধান্তের উপর। ‘জওয়ান’ দেখতে লেট নাইট শো থেকে শুরু করে আক্ষরিক অর্থে মাঝরাতের শো দেখতে যেভাবে দর্শক বড় পর্দার সামনে জড়ো হয়েছেন, তা দেখেই কলকাতার সিনেমা হল মালিকদের সার্কিটে শুরু হয়েছে এই গুঞ্জন। যদি প্যান্ডেল হপিংয়ের পাশাপাশি পুজোর সময় পছন্দের ছবিও সারারাত ধরে দেখানো যায় দর্শকদের।
গত ৭ সেপ্টেম্বর কলকাতায় ‘জওয়ান’-এর প্রথম স্ক্রিনিং ছিল ভোর ৫টায় রাজারহাটের একটি মাল্টিপ্লেক্সে। অন্যদিকে, উত্তরবঙ্গের রায়গঞ্জের এক মাল্টিপ্লেক্সের একটি স্ক্রিনে ৮ সেপ্টেম্বর মধ্যরাতে (রাত্রি সওয়া ২টোয়) শো ছিল ‘জওয়ান’-এর। রায়গঞ্জের বিধায়ক কৃষ্ণ কল্যাণীও উপস্থিত ছিলেন গভীর রাতের ওই শোয়ের দর্শকাসনে।
নতুন জামা পরে প্যান্ডেলে-প্যান্ডেলে ঘোরা থেকে শুরু করে হই-হুল্লোড়, খাওয়া-দাওয়া আর রাত জেগে ঠাকুর দেখার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে টলিউডের পুজো রিলিজ়। ২০২৩-এর দুর্গাপুজোয় মুক্তি পাচ্ছে দেবের ‘বাঘাযতীন’, পরিচালক অরিন্দম শীলের ‘জঙ্গলে মিতিন মাসি’ (যার প্রধান চরিত্রে কোয়েল মল্লিক), মিমি চক্রবর্তী ও আবির চট্টোপাধ্যায় অভিনীত ‘রক্তবীজ’ (এই ছবির পরিচালক নন্দিতা রায়-শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়)। এই ছবির মাধ্যমেই বাংলা সিনেমায় আবার দেখা যাবে অভিনেতা ভিক্টর বন্দ্যোপাধ্যায়কে। এছাড়াও থাকছে পুজোয় একের পর এক হিট ছবি দর্শককে উপহার-দেওয়া সৃজিত মুখোপাধ্যায় পরিচালিত মাল্টিস্টারার ‘দশম অবতার’ (যে ছবিতে আবার প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়কে দেখা যাবে সম্পূর্ণ অন্য লুকে)। এছাড়া হিন্দি ছবি তো থাকছেই। সব মিলিয়ে জমজমাট এবারের পুজো।
এবারের পুজো রিলিজ় যদি ঠাকুর দেখার শেষে রাতে হলে বসে দেখা যায়, কেমন হয় তাহলে? সেই সিনেমা শহরের প্রেক্ষাগৃহে সারারাত দেখার সুযোগ থাকলে আনন্দ দ্বিগুণ হয়ে যায়। সেই রকমই উদ্যোগ নিতে চলেছেন কলকাতার নবীনা সিনেমা হলের কর্তৃপক্ষ। এ দিকে, প্রিয়া সিনেমা বহুদিন ধরেই পুজোর সময় মধ্যরাতের শোয়ের আয়োজন করে আসছে। সারারাত সিনেমা দেখানোর কথা ভাবছেন নবীনা সিনেমা হলের মালিক নবীন চোখানি। এই বিষয়ে তিনি TV9 বাংলাকে বলেন, “পুজোর সময় চারটি প্রধান বাংলা ছবির পাশাপাশি হিন্দি ছবিও মুক্তি পাবে। শো-এর সংখ্যা বাড়লে দর্শকদের দেখার সুযোগও বাড়বে।” ওই সিনেমা হলের তরফে আরও জানানো হয়েছে, দর্শকদের আনন্দের কথা মাথায় রেখেই তারা সারারাত সিনেমা হল খোলা রাখার পরিকল্পনা করছেন। তবে এই ব্যবস্থা করতে হলে অবশ্যই পরিকাঠামোগত কিছু বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। কর্মচারীদের সংখ্যা বাড়াতে হবে। শিফটিং ডিউটির ব্যবস্থা করতে হবে। অন্য দিকে, প্রিয়ার কর্ণধার অরিজিৎ দত্ত জানিয়েছেন, তাঁরা বহুদিন ধরেই পুজোর সময় রাত ১২টায় শো রাখেন এবং ব্যবসাও ভাল হয়েছে। তবে হিন্দি বা দক্ষিণের মতো সারারাত ধরে সিনেমা দেখার চল বাংলায় নেই। পুজোর সময় যেহেতু সারারাত ধরে ঠাকুর দেখে মানুষ, তাই লেট নাইট শো-তেও বুকিং হয়েই থাকে। অরিজিতের কথায়, “তবে ব্যবসার সঙ্গে সঙ্গে একটু মানবিক হওয়াটাও দরকার। সারারাত সিনেমা হল খোলা রাখলে প্রেক্ষাগৃহের কর্মচারীদের ছুটিতে টান পড়বে। তবে সিনেমা দেখার চাহিদা থাকলে, সেই মতো ব্যবস্থা করা যাবে।” প্রিয়া এন্টারটেইনমেন্টের কলকাতা-সহ শহরতলিতেও সিনেমা হল রয়েছে। পুজোর দিনগুলিতে সেই সব সিঙ্গল স্ক্রিন ও মাল্টিপ্লেক্সে সারারাত সিনেমা দেখানো হবে কি না, সেটা নিয়ে এখনও সিদ্ধান্ত নেননি অরিজিৎ। তবে ব্যবসার পাশাপাশি তিনি কর্মচারীদের কথাও ভাবছেন।
অন্য দিকে, এসএসএসআর সিনেমার শতদীপ সাহা একাধারে সিনেমা হলের মালিক এবং অন্য দিকে ডিস্ট্রিবিউটরও। তাঁকে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “পুজোর সময় সিনেমা হল সারারাত খোলা থাকলে ভালই হবে। এরকমটা সত্যি হলে এই প্রথমবার হবে এমন কোনও পদক্ষেপ করা হবে।” শহরতলিতেও এসএসএসআর গোষ্ঠীর বেশ কিছু সিনেমা হল রয়েছে। তবে সিনেমা শেষমেশ কেমন হয়, তার উপর সবকিছুই নির্ভর করবে। শতদীপের কথায়, “চাহিদা থাকলে যোগানও দেওয়া যায়। তবে এখনও কিছু ঠিক করা হয়নি। দেখা যাক। পুজোর আগেই ঠিক হয়ে যাবে কটা শো রাখা হবে অজান্তা-সহ এসএসআরের বাকি সিনেমা হলগুলিতে।
এবার পুজোয়, মোট চারটি বাংলা সিনেমা দর্শকদের উপহার দিতে চলেছে টালিগঞ্জের সিনেমা পাড়া। সারারাত সিনেমা দেখার চল দক্ষিণের, এমনটাই জানিয়েছেন পরিচালক অরিন্দম শীল। তবে এবার বাংলার সিনেমা হলগুলিতেও এই চল শুরু হলে তাতে বেজায় খুশিই হবেন পরিচালক। তিনি বলেন, “সিঙ্গল স্ক্রিন থেকে মাল্টিপ্লেক্,স সবাই যদি এই উদ্যোগ নেয়, বাংলা ছবির জন্য সেটা অসাধারণ হবে। পুজোর সঙ্গে সিনেমাও উৎসবে পরিণত হবে।”
অভিনেতা মিঠুন চক্রবর্তীর মতে, এই উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে বাংলা ইন্ডাস্ট্রির জন্য তা অবশ্য়ই শুভ হবে। এই সিনেমার জন্য কত সংসার চলে, সেই দিকটাও ভাবতে হবে। শুধুই পুজো নয়, সারা বছর ২৪×৭ ঘণ্টা সিনেমা দেখালে আরও ভাল হয় বলেই মত মিঠুনের। পরিচালক কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের মতে, হইহই করে দর্শক সিনেমা দেখবে রাত থেকে ভোর পর্যন্ত। “এ তো তো সিনেমার জয়। পুজোর সময় পরিবারের সকলে মিলে যেমন মণ্ডপে ঘোরা হবে, তার সঙ্গেই সিনেমাও দেখা হবে,” উচ্ছ্বসিত কৌশিক। আইন-শৃঙ্খলা ঠিক থাকলে সারারাত সিনেমা খোলা থাকতেই পারে বলে মত কৌশিকের। অভিনেত্রী পাওলি দাম জানান, ব্যবসা ভাল হলে সিনেমার লাভ। এটি পরীক্ষামূলকভাবে এ বছর করে দেখা যেতে পারে বলে জানিয়েছেন পাওলি।
সিনেমার চাহিদা ভাল হলে হল মালিকরাও সারারাত সিনেমা দেখাতে প্রস্তত। এবার দেখার পুজোয় সারারাত ছবি দেখে নতুন ট্রেন্ড সেট হয় কি না! তবে সিনেমাপ্রেমী বাঙালি এই স্বাদ পেলে হয়তো দক্ষিণী রীতি অনুসরণ করে বাংলাতেও সারারাত ছবি দেখার চল শুরু হবে। এখন পুজোর দিন ও রাতের অপেক্ষায় বাঙালি দর্শক।