Matrimonial Ads: ‘পিতৃমাতৃহীন’ ও ‘ভাল মনের মানুষ’ চেয়ে বিজ্ঞাপন সেরিব্রাল পলসিতে আক্রান্ত পাত্রীর পরিবারের

megha |

Aug 04, 2022 | 12:11 PM

Cerebral Palsy: আর পাঁচটা আপাত-সাধারণ ‘পাত্র চাই’, ‘পাত্রী চাই’ বিজ্ঞাপনের মতোই এই বিজ্ঞাপনেও উল্লেখ রয়েছে পাত্রীর বয়স এবং কেমন পাত্র চাই, তার বিবরণ। তবু এই বিজ্ঞাপন হাঁটছে স্রোতের বিপরীতে।

Matrimonial Ads: ‘পিতৃমাতৃহীন’ ও ‘ভাল মনের মানুষ’ চেয়ে বিজ্ঞাপন সেরিব্রাল পলসিতে আক্রান্ত পাত্রীর পরিবারের
৩১ জুলাই একটি বাংলা দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদপত্রের একটি বিজ্ঞাপন থেকে...

Follow Us

মেঘা মণ্ডল

আর পাঁচটা আপাত-সাধারণ ‘পাত্র চাই’, ‘পাত্রী চাই’ বিজ্ঞাপনের মতোই এই বিজ্ঞাপনেও উল্লেখ রয়েছে পাত্রীর বয়স এবং কেমন পাত্র চাই, তার বিবরণ। তবু এই বিজ্ঞাপন হাঁটছে স্রোতের বিপরীতে। কারণ এই পাত্রের জন্য পাত্রীর বাড়ির চাহিদা তথাকথিত সমাজের চোখে একটু ‘অ’-স্বাভাবিক: পাত্রকে হতে হবে ‘পিতৃমাতৃহীন’ এবং ‘ভাল মনের মানুষ’। সেই সঙ্গে পাত্রকে ‘পাত্রীর নিজগৃহে থাকতে’ হবে। রবিবারের সংবাদপত্রের একটা বড় অংশ জুড়ে থাকে সারি-সারি ‘পাত্র চাই’, ‘পাত্রী চাই’ বিজ্ঞাপন। বিজ্ঞাপনের বিষয়বস্তু থাকে মোটামুটি এরকম: ‘সুশ্রী’, ‘গৃহকর্মেনিপুণা’, ‘ঘরোয়া’ কিংবা ‘কর্মরত’, ‘শিক্ষিত পাত্র/পাত্রী’ চাই। যাঁরা পাত্র খোঁজেন, তাঁদেরও প্রাথমিক চাহিদায় খুব একটা ফারাক থাকে না: সুশিক্ষিত এবং সরকারি চাকুরেরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে থাকেন পছন্দের তালিকায়। যে বিজ্ঞাপন এই প্রতিবেদনের আলোচ্য বিষয়, তার দাবি তা-ই একটু ‘অ’-স্বাভাবিকই ঠেকতে পারে আপনার চোখে—পাত্রকে হতে হবে ‘পিতৃমাতৃহীন’ এবং ‘ভাল মনের মানুষ’। এহেন বিজ্ঞাপনের কারণ পাত্রী বর্ডারলাইন সেরিব্রাল পলসিতে আক্রান্ত।

গত রবিবার, ৩১ জুলাই একটি বাংলা দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদপত্রের এই বিজ্ঞাপন দেখে TV9 বাংলার তরফে যোগাযোগ করা হয় তাতে যে হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরের উল্লেখ ছিল, তাতে। কথা হয় পাত্রীর মায়ের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘‘আমার মেয়ে সেরিব্রাল পলসিতে আক্রান্ত। আমরা চাই আমাদের পর মেয়ের পাশে থাকুক কেউ। কিন্তু দয়া বা করুণার চোখে নয়। সিমপ্যাথি দেখিয়ে কেউ আমার মেয়েকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করুক, সেটা চাই না আমরা।’’ আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের মতোই ‘স্বাভাবিক’ জীবনযাপনের অধিকার রয়েছে পাত্রীর। ‘ভাল মনের মানুষ’ পেলে তবেই চার হাত এক করবেন পাত্রীর মা-বাবা। ‘ভাল মনের মানুষ’-এর পাশাপাশি পাত্রকে হতে হবে শিক্ষিত অথবা ডাক্তার। পাত্র যদি সাহিত্য অনুরাগী হন তাহলে মেয়ের সঙ্গে ভাব জমবে ভাল, TV9 বাংলাকে জানিয়েছেন পাত্রীর মা। যদিও পাত্রীর পরিবারের সকলেই চিকিৎসাপেশার সঙ্গে যুক্ত।

কেন পাত্রকে হতে হবে ‘পিতৃমাতৃহীন’? সেই সঙ্গে বিয়ের পর ‘পাত্রীর নিজগৃহে থাকতে’-ও ইচ্ছুক হতে হবে পাত্রকে। তাহলে কি এক্ষেত্রে পাত্রীর মা-বাবা কিছুটা ‘স্বার্থপর’? তর্কের খাতিরে যদি এমনটা ধরেও নেওয়া হয়, তাহলে একজন সেরিব্রাল পলসিতে আক্রান্ত পাত্রীর মা-বাবার পক্ষে এই ধরনের দাবি বা চাহিদা কি খুব অস্বাভাবিক বা অযৌক্তিক? পাত্রীর মায়ের ভণিতাহীন উত্তর, ‘‘আমাদের বয়স হয়েছে। ভবিষ্যতে আমাদেরও সঙ্গী হয়ে উঠবে সে (পাত্র)। একজন পিতৃমাতৃহীন ছেলে হলে সে হয়তো আমাদেরও সময় দেবে। সবথেকে বড় কথা পিতৃমাতৃহীন একজনকে হয়তো মা-বাবার মর্মটাও বোঝাতে পারব আমরা।’’

বিজ্ঞাপনের দু’-একটা শব্দে আপাতদৃষ্টিতে ‘স্বার্থপরতা’ প্রকাশ পেলেও এই চাহিদার মাধ্যমে উঠে আসছে সমাজের এক অন্যরূপ। এহেন বিজ্ঞাপন কি কোথাও গিয়ে সেরিব্রাল পলসি বা এই জাতীয় জটিল রোগে আক্রান্তদের পরিবারের সৎ ও একাধারে সাধারণ ‘চাওয়া’কে খোলামেলাভাবে সমাজের কাছে তুলে ধরার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করে? এই প্রসঙ্গে TV9 বাংলার তরফে যোগাযোগ করা হয় ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সেরিব্রাল পলসির আইটি ও অ্যাডভোকেসি ট্রেনার সুদীপেন্দু দত্তের সঙ্গে। সুদীপেন্দুর কথায়, ‘‘সেরিব্রাল পলসিতে আক্রান্ত একজন অবশ্যই আর পাঁচজনের মতো একটা সুখী জীবনের স্বপ্ন দেখতে পারেন। কিন্তু এই ধরনের রোগে আক্রান্ত মানুষের সাধারণ ‘চাওয়া’গুলোকে সমাজ ‘সাধারণ’ভাবে দেখতে পারে না।’’ এই বিজ্ঞাপন তাই-ই শুধু যে নজর কেড়েছে তা নয়, সমাজের এক ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিও তুলে ধরেছে। ‘‘প্রত্যেকের অধিকার রয়েছে আর পাঁচটা মানুষের মতো সুন্দর করে জীবন কাটানোর। সেখানে সেরিব্রাল পলসিতে আক্রান্ত ব্যক্তিরাও ব্যতিক্রম নন। বরং এই ধরনের বিজ্ঞাপন সমাজে সচেতনতা প্রসারের কাজ করছে,’’ অভিমত সুদীপেন্দুর।

সমাজের কাছ থেকেও এই একই মনোভাব প্রতাশ্যা করছেন পাত্রীর মা। তাঁর মেয়ের জীবনে কেউ আসবে কি না, তিনি জানেন না। তবে আশা রাখেন, এই বিজ্ঞাপন দেখে আরও পাঁচজন সেরিব্রাল পলসিতে আক্রান্ত ব্যক্তি বা রোগীর বাড়ির লোকও আগামিদিনে এগিয়ে এসে নির্দ্বিধায় তাঁদের চাহিদা বা দাবিগুলোর কথা বলতে পারবেন।

কিন্তু ‘ভাল মনের মানুষ’—এ তো ভীষণ একটা বিমূর্ত একটা ধারণা। চাইলেই তো আর ‘ভাল মনের মানুষ’ পাওয়া যায় না। সুদীপেন্দুর কথায়, ‘‘এই ‘ভাল মনের মানুষ’-এর সংজ্ঞাটা ব্যক্তিবিশেষে এক-এক রকম। মেয়েকে যত্নে, ভালবেসে রাখবে, মেয়ের চাওয়া-পাওয়াগুলোকে প্রাধান্য দেবে, মেয়ের জন্য এমন ‘ভাল মনের মানুষ’ চান পাত্রীর মা-বাবা। এটাই তো প্রত্যেক মা-বাবাই চান। দিনের শেষে সব অভিভাবকই চান, সন্তান যেন ভাল থাকে।’’ তাহলে কি ‘পিতৃমাতৃহীন’ পাত্র চাওয়ার মধ্যে প্রকারান্তরে ফুটে উঠেছে স্বার্থপরতা? সুদীপেন্দুর উত্তর, ‘‘তাঁরা হয়তো ভাবছেন ‘পিতৃমাতৃহীন’ পাত্র হলে সে সহজে মেয়েকে ছেড়ে চলে যাবে না। তাঁরা যদি স্বার্থপর হয়েও থাকেন, এটা তাঁদের দিক দিয়ে বিবেচনা করলে মোটেও অস্বাভাবিক নয়।’’ ইতিমধ্যেই বহু কল পেয়েছে পাত্রীর পরিবার। উল্টো দিক থেকে দাবি করা হয়েছে, তাঁদের কেউ-কেউ শিক্ষিত। আবার কেউ-কেউ চিকিৎসকও। পরিবারের আশা: মেয়ের জন্য ‘সঠিক’ পাত্র খুঁজে পাবেন।

Next Article