নন্দন পাল
সোশ্যাল মিডিয়ায় আপনার ক’জন বন্ধু? সেই বন্ধু তালিকা অনেকেরই উপচে পড়ে। একটা প্রোফাইলের সর্বাধিক ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পূরণ হয়ে গেলে অন্য আর একটা প্রোফাইল খুলতে হয়! কিন্তু সত্যি বলুন তো মনের কথা খুলে বলার মানুষটা কি আছে? যার সামনে নিজেকে মেলে ধরা যায়। আয়নার মতো একটা প্রতিচ্ছবি দেখা যায় যার কাছে? উত্তরগুলো অধিকাংশেরই ‘না’। আসলে আমাদের সবার অনেকরকম গল্প থাকে। কথা থাকে। যা সব জায়গায় বিশ্বাস করে বলা যায় না। বলার পরিবেশও অনেক সময়ে পাওয়া যায় না। গোপন সে সব না-বলা কথা জমে তৈরি হওয়া গল্পগুলো জমে-জমে তৈরি হয় আস্ত একখানা বই। সে বই খুলে দেখাই হয় না আমাদের। মনের কোণে জমতে থাকে ঝুল, ধুলো, ময়লা। আর জমে থাকা সেই কথারা প্রভাব ফেলে আমাদের কাজে, আমাদের দৈনন্দিন জীবনে। সম্প্রতি উত্তর কলকাতায় হয়ে গেল একটি আড্ডা। আয়োজন করল টি-টকার্স, আড্ডার পোশাকি নাম ‘দোজখনামা’। গোয়াবাগানের ভুবনবাড়িতে আশা-নিরাশার গল্প করলেন কিছু মানুষ।
দোজখনামার আয়োজক সৌভিক বিশ্বাস, নিবেদিতা দে-রা বলছেন, “এটা হল একটা মঞ্চ যেখানে মানুষ এসে মন খুলে তাঁদের কথা বলবেন একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে। যাতে একের গল্প অনুপ্রাণিত করে অন্যকে। এভাবে একে অপরের সঙ্গে মিলেমিশে একটা মোটিভেশানাল কমিউনিটি তৈরি করা।” এভাবে উজ্জীবিত হওয়ার গল্প বলতে আর শুনতে-শুনতে কেটে গেল ৫টা বছর। পার হল ১৯টা গল্পের আসর। এখানে যারা আসেন, তাঁরা সাদা কাগজে নিজেদের গোপন কথা লিখে জমা দেন। তাঁদের পরিচয় গোপন রেখে আলোচনা শুরু হয়। আড্ডা হয়। সমাধানও হয় বহু সমস্যার। আড্ডা ঘরের এক কোণে নিভৃতে থাকে একটা সাদা কনফেশন বক্স। অনেকে একটা চিরকুটে স্বীকারোক্তি লিখে নীরবে ফেলে যান সেই সফেদ বাক্সে। মূলত সম্পর্কের সমস্যা আর কাজের জগৎ সম্পর্কিত আলোচনাই বেশি হয়েছে আগের দোজখনামার পর্বে। অংশগ্রহণকারীরা থাকেন নিজেদের মেজাজে। আড্ডা জমে ধ্রুপদী সঙ্গীতের মৃদু সুরে। স্ন্যাক্স আর নরম পানীয় যোগ্য সঙ্গত দেয়। মাদুরে, পাশবালিশে, চেয়ারে, সোফায় লেগে থাকে স্বস্তি। তবে এখানে আসতে হলে আছে কিছু নিয়ম। অংশ গ্রহণের জন্য যা খুবই জরুরি।
৩ ঘণ্টা দোজখনামা চলাকালীন ব্যবহার করা যায় না মোবাইল ফোন-সহ কোনও রকম ইলেক্ট্রনিক গ্যাজেট। আর ‘জাজমেন্টাল’ হওয়া চলে না একে-অন্যের প্রতি। একে-অপরের বক্তব্যকে শ্রদ্ধা করে ওঁরা শুনে চলেছেন জীবনের কথা। রবিশঙ্কর বলের উপন্যাস ‘দোজখনামা’য় ভারত আর পাকিস্তানের দু’টি কবরের অন্তিম শয্যায় শুয়ে গল্প করেছেন সাদাত হাসান মান্টো আর আসাদুল্লাহ মির্জা গালিব। তাঁদের গল্প পরতে-পরতে তুলে ধরেছে জীবনের দুঃখ, একাকীত্ব ও পারিবারিক সমস্যা। বাস্তবের মাটিতে টি-টকার্সের দোজখনামায় সাহায্যের হাতগুলো এগিয়ে আসছে একে-অপরের দিকে। একটা সুন্দর জীবনের প্রত্যাশায়।