৬৭তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছিল ‘জ্যেষ্ঠপুত্র’৷ কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় পরিচালিত এই ছবি দু’টি বিভাগে পেয়েছিল জাতীয় পুরস্কার ৷ সেরা স্ক্রিন প্লে বিভাগে পুরস্কার গ্রহণ করেছিলেন পরিচালক ৷ আবার এই ছবির জন্যই সেরা সঙ্গীত পরিচালকের পুরস্কার পেয়েছিলেন প্রবুদ্ধ বন্দ্যোপাধ্যায়৷ কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের ছবি ‘নগরকীর্তন’-এও ছিলেন প্রবুদ্ধ। আজ, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে (International Mother Language Day) জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারবিজয়ী এই বাঙালি সঙ্গীত পরিচালককে যদি বলা হয় ‘আমি বাংলায় গান গাই, আমি বাংলার গান গাই’—এই বিষয়ে ডায়েরি লিখতে হলে কী লিখবেন? TV9 বাংলার জন্য ডায়েরি লিখলেন প্রবুদ্ধ বন্দ্যোপাধ্যায়
আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। আজ সকাল থেকেই নানা কথা মনে পড়ছে। মনে পড়ছে ছোটবেলায় বাবার মুখে শোনা ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা নিয়ে আন্দোলনের কথা (তখনকার পূর্ব বাংলা, এখন যেটা বাংলাদেশ)। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কিছু ছাত্র এবং তাঁদের সঙ্গে আরও কয়েকজন প্রগতিশীল মানুষ বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে থেকে মিছিল করে বেরিয়েছিলেন। এগিয়েছিলেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের দিকে। সেখানেই পুলিশ তাঁদের রোধ করে। গুলি চালায়। মৃত্যু ঘটে আন্দোলনকারীদের। অনেকেই আহত হন। বাংলাদেশে স্মৃতিসৌধ আছে ভাষা আন্দোলন নিয়ে…
…ছোটবেলা থেকেই রাজনৈতিক সচেতন পরিবারে মানুষ হয়েছি আমি। ফলে এইসব আলোচনা হত বাড়িতেই। সব শুনতাম গালে হাত দিয়ে। শিহরিত হতাম। চোখ ভিজত। গর্বিত হতাম। এখনও হই। আমার ছেলেবেলার পাওনা, গুণী মানুষেরা আসতেন আমাদের বাড়িতে। বাড়িতেই গান-বাজনা হত। নিয়মিতভাবে আসতেন জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র। তখনকার দিনে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত মানুষজনও আসতেন আমাদের বাড়িতে। কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ও আইপিটিএ-র সঙ্গে যুক্তরাও আসতেন। এসবের মধ্যেই বড় হয়েছি আমি।
এ দিকে, পাশ্চাত্য সঙ্গীতের সঙ্গে আমার পরিচয় সেই ছোটবেলাতেই। আমি ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলের ছাত্র ছিলাম। ছোটবেলা থেকেই কনসার্টে যোগদান করতাম। ৫ বছর বয়স থেকে ওয়েস্টার্ন ক্ল্যাসিক্যাল ভায়োলিন বাজাতে শিখেছিলাম ক্যালকাটা স্কুল অফ মিউজ়িকে। ফলে ছোট থেকেই আমার মধ্যে ওয়েস্টার্ন ক্ল্যাসিক্যাল মিউজ়িকের প্রভাব বেশি ছিল। তা সত্ত্বেও আমার বাবা-মায়ের কারণে-উৎসাহে ও আমার আশপাশের লোকজনের সান্নিধ্যে কোনওদিনও শিকড়চ্যুত হইনি। মাটির কাছেই ছিলাম। ছিলাম বাংলার কাছেই।
…ফলে পশ্চিমী সঙ্গীতের চর্চা ও বাংলা গানের তালিম সমানতালে চলত। এখন দিনকাল অনেক পালটেছে, রুচিবোধও পালটেছে। ভাষায় এসেছে পার্থক্য। আমাদের খাদ্যাভ্যাস বদলে গিয়েছে। আমরা এখন জিন্সের উপর পাঞ্জাবি পরি। নানারকম ঐতিহ্যবাহী পোশাক ‘ফিউশন’-এ পরিণত হয়েছে। খাবারও তাই। আমরা পাসতা খাই। পিৎজা খাই। নলেনগুড়ের আইসক্রিমও খাই। কাজেই সবকিছুই বিশ্বায়নের জন্য মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে। দো-আঁশলা ব্যাপার হয়েছে আরকী!
…একইভাবে এখনকার বাংলা গানের ধরনেও পরিবর্তন এসেছে ভীষণরকম। এখনকার ভাষা পালটেছে। এখনকার বাংলা গানে প্রচুর ইংরেজি শব্দ ঢুকেছে। আবার হিন্দি শব্দও জুড়ে গিয়েছে। সে সব গানের সুর তৈরি হয়। অনেক গানেরই সুর হয় বলিউডি স্টাইলে। কিছু গানের সুর হয় পশ্চিমী স্টাইলেও। আমিও কোনও ব্যতিক্রম নই। সেরকমই গানবাজনা করি। অনেকটা বাজারচলতি প্রভাবে হার স্বীকার করেই হয়তো সেটা করতে হচ্ছে আমাকেও। পেট চালানোর জন্য।
কিন্তু একটা বিষয় আমার খারাপ লাগে। আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। তাই ডায়েরি লিখতে বসে কথাটা আমার মনে ধাক্কা দিচ্ছে বার বারই! আমাদের যা কিছু কালজয়ী সঙ্গীত ছিল, যেমন রবীন্দ্রসঙ্গীত, লোকসঙ্গীত – সেগুলো আজকাল যেভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে, একজন সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে আমার মোটেও ভাল লাগছে না। রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে কপিরাইট উঠে যাওয়ার পর প্রচুর মাইন্ডলেস এক্সপেরিমেন্ট চলছে। গানগুলোকে এমনভাবে অ্যারেঞ্জ করা হচ্ছে, তাতে হারিয়ে যাচ্ছে গানের মূল ভাব, বার্তা এবং বিষয়। কন্টেন্টকে এক ঝটকায় পিছনে টেনে সরিয়ে সামনে জোর করে জায়গা করতে চাইছে ফর্ম।
বেশ কয়েকজন রবীন্দ্র সঙ্গীত গায়ক-গায়িকা, কেউ নতুন, কেউ সিনিয়র… এমনভাবে রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইছেন, এমনভাবে স্বরবিতান থেকে সরে আসছেন, যে গানের ভাব নষ্ট হচ্ছে। অনেকেই মনে করছেন, এটাই বোধহয় রবীন্দ্রসঙ্গীত। মনে করছেন, মূল গানের সুর হয়তো এরকমই। আমার এই ব্যাপারে ঘোরতর আপত্তি আছে!
বিদেশে নানা ধরনের গান হয়, নানা রকম সঙ্গীত চর্চা হয়, নানা ধরনের স্টাইল আসে… এক-একটা ওয়েভ আসে। সত্তরের দশকে রক অ্যান্ড রোল ওয়েভ এসেছে। ক্লাসিক রক এসেছে। একটা সময় পাঙ্ক রক এল। এখন নিউ-এজ রক হয়। ওখানে কিন্তু ইয়ং জেনারেশন হোক কিংবা সিনিয়র মিউজ়িশিয়ান, ট্র্যাডিশনাল, ক্ল্যাসিক্যাল মিউজ়িক বাজানোর সময় মূলধারা থেকে তাঁরা সরে আসেন না। সনাতনকে সংরক্ষণ করার দায় তাঁদের আছে। আমাদের নেই। হারিয়ে গিয়েছে। পশ্চিমে তৈরি হয়েছিল, যেভাবে গঠিত হয়েছিল, সম্পূর্ণ অটুট রেখে আরও সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলেন তাঁরা। ওখানে কেউ মোৎজ়ার্টের তৈরি কোনও কম্পোজ়িশনকে নিজের মতো তৈরি করার কথা ভাবতেই পারেন না। আমরা কিন্তু এই দুঃসাহস দেখাই। হামেশাই দুঃসাহসিক কাজ ঘটে চলেছে।
আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। একটা জিনিসই আশা করব, সময়ের সঙ্গে ঠিক যেভাবে আমরা বিবর্তিত হচ্ছি, ঠিক যেভাবে আমাদের গানের স্টাইল পালটাচ্ছে, আমাদের গানের কথা পালটাচ্ছে… পাশাপাশি আমাদের কালজয়ী সঙ্গীতের সম্ভারও আছে। তা যেন আমরা সুরক্ষিত রাখতে পারি। চর্চা করতে পারি। কোনও ভাবেই যেন সেই কালজয়ী সম্ভার বিকৃত না হয়। তা না হলে আগামী দু’-তিন প্রজন্মের পরই কালজয়ী সঙ্গীত অন্য আকার ধারণ করবে এবং আগামী প্রজন্ম জানতেও পারবে না আসলটা কী ছিল! মাঝখান থেকে রবীন্দ্রনাথের গান, অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্ত সেন ও আরও অন্যান্যদের সৃষ্টি হারিয়ে যাবে। সেটা আমাদের সংস্কৃতির জন্য ভাল নয়।
পিছনের দিকে তাকিয়ে হাঁটতে বলছি না। আমরা এগিয়ে যাব সামনের দিকেই। এগিয়ে যাব ইতিহাসকে মাথায় রেখে, সংস্কৃতিকে বজায় রেখে!
স্নেহা সেনগুপ্ত
(অনুলিখনের ভিত্তিকে লিখিত)
গ্র্যাফিক্স: অভীক দেবনাথ