দেবী সাহা
ইনস্টাগ্রামে যে ছবিটা শেয়ার করেছি, সেটা ২০১৯ সালে তোলা। ইকো পার্কে আয়োজিত লাইভ পারফরম্যান্সে কেকে-কে আমি মঞ্চে উপস্থাপন করার সুযোগ পাই। এটা সে দিনের ছবি। খুব ছোটবেলা থেকে আমি লাইভ ইভেন্ট ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে যুক্ত। সেই পেশার সঙ্গে যুক্ত থাকার সুবাদে কেকে-কে দু’বার স্টেজে প্রেজ়েন্ট করেছিলাম। তবে ওঁর লাইভ পারফরম্যান্স দেখেছি অনেক ছোট্ট বয়স থেকে। কেন এটা বললাম? তার কারণ, প্রত্যেকবার আমার একই রকম অভিজ্ঞতা হয়েছে মানুষটিকে ঘিরে। ব্যাকস্টেজে হোক কিংবা দর্শক আসনে—দু’বারই একই রকম ভাইব এবং এনার্জি অনুভব করেছি কেকে-র কাছ থেকে। প্রত্যেকবারই গোটা অডিটোরিয়াম জুড়ে কেকে-র এনার্জি ছড়িয়ে পড়ত। ৬-৭ বার দর্শক হয়ে কেকে-র লাইভ দেখেছি।
শিল্পীদের সংগ্রহে থাকে বহু সম্মান ও পুরস্কার। কেকে-রও সেই সম্মান ও পুরস্কার রয়েছে। এখন একটা ক্লিকেই শিল্পীদের সম্পর্কে সবকিছু জানা যায়। সঞ্চালকদের কাজ তাঁদের মঞ্চে উপস্থাপন করা। কেকে-র মতো শিল্পীদের ক্ষেত্রে খুব সমস্যা হয় তখন। আমার মতো সঞ্চালকরা যদি কেবলই কেকে-র পুরস্কার কিংবা সম্মান নিয়ে কথা বলে, অসমাপ্তির জায়গা তৈরি হয়। কেকে আমাদের ‘সময়’ উপহার দিয়েছেন। ক্লাস ফাইভ-সিক্সে পড়ার সময় থেকে কেকে-র গান শুনতে শুরু করি। তখন থেকেই তিনি আমার প্রিয়। ইন্ডি-পপ জঁরের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন কেকে। ৯০-এর নস্ট্যালজিয়া নিয়ে যাঁরা বাঁচেন, তাঁদের হয়তো প্রত্যেকেরই এই ধরনের অভিজ্ঞতা রয়েছে। প্রেমে পড়া, প্রেম ভাঙা, প্রেমের প্রস্তাব—এ সব কিছুর সঙ্গে কেকে জড়িয়ে। তিনি জড়িয়ে আছেন ফেয়ারওয়েলেও। তাই মঞ্চে সঞ্চালনা করতে উঠলে এই সব স্মৃতিই একসঙ্গে মাখোমাখো হয়ে যায়। সেই মানুষটিকে যখন স্টেজে প্রেজ়েন্ট করতে উঠেছিলাম, আগে থেকেই গলার কাছটা দলা পাকিয়ে গিয়েছিল। যে সময়টা পিছনে ফেলে এসেছি, সেই সময়টাই যেন চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে ওঠেছিল। সেই সময় কেবল কেকে-কে স্টেজে প্রেজ়েন্ট করিনি, প্রেজ়েন্ট করেছিলাম একটা গোটা সময়কে। যে সময় পিছনে ফেলে এসেছি আমরা প্রত্যেকে। সেই প্রেম, ভালবাসা, বিচ্ছেদ… পুরনো নস্ট্যালজিয়া।
আমি আরও একটা কথা বলতে চাই এখানে। আমার একান্ত আপন অভিজ্ঞতা। আজ আর আমি কুণ্ঠাবোধ করব না। লাইভ ইভেন্টে বড় শিল্পীর ক্ষেত্রে বহু অসুবিধাজনক অভিজ্ঞতা হয় আমাদের। তাঁদের স্টেজে ওঠার আগে অনেক সময় গুণী অথচ অল্প পরিচিতি শিল্পীরা পারফর্ম করেন। দেখা যায় তুলনায় বড় মাপের শিল্পীদের টিম আগে থেকে এসে ব্যাকস্টেজ উত্তপ্ত করে তোলেন। অনেক কিছু বলতে থাকেন। কিন্তু কেকে-র ক্ষেত্রে এরকমটা আমি কোনওদিনও লক্ষ্য করিনি। কোনওদিনও না…
কেকে-র মতো বড় মাপের শিল্পীর সঙ্গে যখন আমরা স্টেজ শেয়ার করি, কিছুটা হলেও দ্বিধাগ্রস্ত থাকি। কিন্তু কেকে-র ব্যবহারে যে উষ্ণতা পেয়েছি, তা আজীবন মনে থাকবে। যে ছবিটা আপনারা দেখলেন, সেখানে তিনি আমাকে আলিঙ্গন করেছিলেন। কিন্তু স্পর্শ করেননি। একটা গ্যাপ রেখেছিলেন। এটাই কেকে-র উষ্ণতা। তিনি আমাকে স্পর্শ না করেও উষ্ণতার অনুভূতি দিয়েছিলেন।
স্টেজে দাঁড়িয়ে তাঁর সম্পর্কে যা-যা বলেছিলাম, তা শুনে তিনি খুশি ছিলেন। পারফরম্যান্সের মাঝে ছোট্ট গ্যাপে আমি কেকের সঙ্গে কথা বলতে যাই। তাঁকে জানাই, আমি তাঁর কত বড় ভক্ত। আমার প্রথম প্রেম, বিচ্ছেদ, কলেজের স্মৃতি, স্কুলের স্মৃতির সঙ্গে তাঁর গান কতখানি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে সবটাই জানাই তাঁকে। কেকে-কে সেদিন বলেছিলাম, স্টেজে তাঁর সম্পর্কে কেবলই গালভরা কথা বলছিলাম না। সব কথাই ছিল মনের। সেই সময়ও কেকের আচরণে উষ্ণতা অনুভব করেছি।
আজ ভাবতে সত্যি অবাক লাগছে, স্কুল-কলেজে পড়ার সময় কেকের ‘পল’ গানটি গেয়ে কত বন্ধুকে আলিঙ্গনে ফেয়ারওয়েল জানিয়েছি আমরা। কেকের বিদায়বেলায় সেই গানটাই তাঁর ‘ফেয়ারওয়েল গান’ হয়ে উঠল। জীবনের প্রদীপ নিভে যাওয়ার আগে সেই গানটাই তিনি শেষবার গাইলেন। এটা মিরাকেল ছাড়া আর কী!