মদ ‘এসেনশিয়াল কমোডিটি’ নয়। তবুও লকডাউন ঘোষণা হওয়ার পর সবথেকে বেশি লাইন পড়েছে মদের দোকানে। গত বছরও একই চিত্র ছিল। গত বছর বিষয়টা নতুন হলেও, এখন আমাদের হাতে এক বছরের উদাহরণ রয়েছে। তা-ও কেন এই আচরণ? এর পিছনে কোন মানসিকতা কাজ করছে? এই দুঃসময়ে সত্যিই কি এই সহ-নাগরিকরা অপারগ, তাই-ই লাইনে দাঁড়াচ্ছেন? নাকি কোথাও বাস্তব পরিস্থিতি ভুলে থাকার চেষ্টা? একই সঙ্গে এই ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত কর্মচারীদের দিকটা ভাবলে এটা তাঁদের রুটি রুজি। গোটা বিষয়টি ব্যখ্যা করলেন মনোবিদ শতভিষা চট্টোপাধ্যায়।
মদের দোকানের সামনে লাইনটা বুঝতে গেলে প্রথমত মদ সংক্রান্ত আমাদের যা ধারণা অথবা ভ্রান্ত ধারণা সেগুলো বুঝতে হবে। তার মধ্যে প্রথমটা যেটা ভীষণ ভাবে প্রচলিত, সেটা হল মদ খেলে আমরা একটু যেন রিল্যাক্স করতে পারি, একটু যেন চাপ কমে। বলা বাহুল্য এখন পরিস্থিতি অসম্ভব চাপের। লোকে বিভিন্ন কারণে চাপে রয়েছেন। যার ফলে মদের প্রয়োজনটা যেন বাড়ছে মনে হচ্ছে। এ বার এই ধারণাগুলো ভ্রান্ত নাকি আসল, সেটা বুঝতে গেলেও আমাদের বোধহয় এটা মাথায় রাখতে হবে, মদ করছেটা কী? আমরা যখন অ্যালকোহল কনজ়িউম করি, সেটা আমাদের শরীরে কীভাবে প্রভাব ফেলে সেটা নিয়ে অনেক তথ্য রয়েছে। কিন্তু ব্রেনকে কীভাবে প্রভাবিত করে, সেটা একটু দেখি। অ্যালকোহল কনজ়ামশনের ফলে এনডোরফিন্স বলে একটা জিনিস রিলিজ় করতে সাহায্য করে। যার ফলে একটা ফিল গুড ফ্যাক্টর, একটু ভাল লাগা, একটু ফুরফুরে ভাব তৈরি হয়। ব্রেনের মধ্যে কানেকশনগুলোকেও যেন একটু দুর্বল করে দেয়। তার ফলে যে মানুষটা অত্যন্ত সজাগ হয়েছিলেন, তাঁর সজাগ ভাবটা যেন একটু কমল, তাঁকে যেন হালকা ঘুম পাড়ানো হল। এ বার সেই অর্থে তো চাপটা কমাচ্ছে, ফ্যাক্ট। কিন্তু এটা অত সহজও নয়। এটা তাৎক্ষণিকভাবে অল্পক্ষণের জন্য যদি ফ্যাক্টও হয় মাইল্ড কনজ়ামশনে, কিন্তু এই কথা ভেবে যদি বেশি করে মদ খেতে থাকে মানুষ, তাহলে আসলে ধীরে-ধীরে চাপের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর ক্ষমতা কমে যায়। চাপ সামলাতে তখন আর আমরা পারি না। কারণ ব্রেন দুর্বল হয়ে আছে। তার সঙ্গে লং টার্মে ধীরে-ধীরে ব্রেন ছোট হতে থাকে। ফলে ডিমেনশিয়া, বুদ্ধি কমে যাওয়া, ভেবে কাজ করার ক্ষমতা কমে যাওয়া এগুলো ঘটতে থাকে। ফলে লং টার্মে চাপ কিন্তু বাড়ালো।
আর একটি মিসকনসেপশন মদের বিষয়ে। গত বছরে যখন বিভিন্ন সূত্রে বারবার আলোচনা করা হয়েছিল, অ্যালকোহল নাকি স্যানিটাইজ়ার। অ্যালকোহল স্যাচুরেশন একটা নির্দিষ্ট পারসেনটেজে হলে সেটা স্যানিটাইজ় করবে বা ভাইরাসটাকে মারতে সাহায্য করবে। এ বার যা হয়, চোরের মন বোঁচকার দিকে। যাঁরা মদাসক্ত, তাঁদের মধ্যে আলোচনা করে হোক বা যে কোনও ভাবে আরও একটি ভ্রান্ত ধারণার প্রচলন ঘটল, তাহলে যাঁরা মদ খান, তাঁরা বুঝি রেহাই পেয়ে যাবেন! এটা ফ্যাক্ট নয়। উল্টে শরীরের ইমিউনিটি পাওয়ার কমে যাচ্ছে। ফলে করোনা ভাইরাসের সঙ্গে লড়াই করার ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। অসংখ্য মানুষ এই ভ্রান্ত ধারণা নিয়ে বলে এসেছেন, ‘ভালই তো, আমি মদ খাচ্ছি মানে নিজেকে প্রোটেক্ট করছি’। এই ধারণা থেকে মদাসক্তি বেড়েছিল।
এ বছর কার্যত লকডাউনে কেন মদের দোকান খুলে দেওয়া হল? গত বছরও সরকারকে এই সিদ্ধান্তের জন্য প্রচুর সমালোচনা শুনতে হয়েছে। এটা বুঝতে গেলে দু’টো জিনিসের ব্যালান্স বুঝতে হবে।
এক ইকনমিক্স। দুই লকডাউনজনিত মানসিক চাপ। ইকনমি সাফার করছিল। আমাদের ইকনমিতে এই মদের দোকানগুলো বিশাল অঙ্কের পরিমাণ কন্ট্রিবিউট করে। দোকান খুলতে না পারলে ক্ষতির সংখ্যা কিন্তু মারাত্মক। মদের দোকান থেকে প্রচুর আয় হয়। পুরো বন্ধ থাকা মানে শুধু দোকানের ক্ষতি তা নয়, সামগ্রিক অর্থনীতির ক্ষতি। যদিও রিসার্চ করতে গিয়ে যেটা দেখলাম, গত বছরের তুলনায় এ বছর মদের বিক্রি কমেছে। অন্তত ৫০ শতাংশ। ইনক্লুডিং হোম ডেলিভারি। অন্তত এটাই দাবি করা হচ্ছে। সেটা অবশ্যই ভাল কথা। যদিও মদের দোকানের বাইরে দীর্ঘ লাইনের প্রচুর ছবি এ বারও আমরা দেখছি।
দ্বিতীয় বিষয় হল, বাড়িতে আটকে মদের দোকান বন্ধের কারণে মদ না পেয়ে বহু মানুষ যাঁরা মদাসক্ত, তাঁদের মধ্যে কিছু ব্যবহারিক চাঞ্চল্য বাড়তে থাকে। ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সও বাড়তে থাকে। এটা কমানোর জন্য এবং আয়ের কথা ভেবে লিকার শপ খোলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ বছর অন্য দোকানের মতোই একই সময়ে মদের দোকানও খোলা থাকছে। সারাদিন খোলা থাকছে না বলে দোকান খোলা থাকার নির্দিষ্ট সময়ে ভিড় হচ্ছে বেশি।
এ বার আবার আমরা সেই জায়গাতেই এলাম। এটা বুদ্ধি বিবেচনার ব্যাপার। মদের দোকানে ভিড়ের মধ্যে লাইন দিলে তো করোনা হতেই পারে। যাঁরা অতটা ডেসপারেট ভাবে লাইন দিচ্ছেন, তাঁরা হয়তো ডিনায়েল-এ আছেন। অর্থাৎ এই বাস্তবটাকে সামলাতে-সামলাতে তাঁরা চাপটা আর নিতে পারছেন না। অথবা মিস কনসেপশনের কোনও একটাতে তাঁরা সারেন্ডার করেছেন।
ডিনায়েল অর্থাৎ নিজেকে বলা, এই ঘটনাটা ঘটেনি। বাস্তবকে ডিনাই করা। এটা খুব প্রাইমারি ডিফেন্স মেকানিজ়ম। ডিনায়েল আমাদের বহু চাপের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে সাহায্য করে। যদিও কীভাবে ব্যবহার হচ্ছে, তার উপর নির্ভর করে। কোভিড পরিস্থিতি শুরু হওয়ার দেড় বছর পরেও যদি আমাদের ডিনায়েলে থাকতে হয়, তাহলে বোধহয় সমস্যাটা অনেক বেশি। ফলে এমনিতে বাঁচব কী মরব তার ঠিক নেই, মদ খেয়ে মরি। এই ভেবে যদি কেউ লাইনে দাঁড়ান, এতে যে শুধুমাত্র নিজেদের জীবনের ঝুঁকি, তা নয়। তাঁদের আশপাশের মানুষের জীবনেরও ঝুঁকি থাকছে। সেটাও তাঁরা ডিনাই আউট করে গিয়েছেন। এ বার এই ভ্রান্ত ধারণাগুলো ভাঙার জায়গায় আমরা কেউ নেই। সবার চাপের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর মানসিকতা আলাদা। যে যেভাবে পারেন, চাপের সঙ্গে বন্ধুত্বে আসার চেষ্টা করছেন।
যাঁরা অ্যালকোহলিক, তাঁরা মদ খান না, মদ তাঁদের খায়। এখানে একটু অ্যালকোহলিজ়ম নিয়েও বলা দরকার। ইউজ়, অ্যাবিউজ়, টলারেন্স, ডিপেন্ডেস। খুব সহজ ভাষায় এগুলো হল পরপর ধাপ। ইউজ় হল, যখন মাঝেমধ্যে রিল্যাক্স করার জন্য অল্প মদ খাওয়া হল। অ্যাবিউজ় হল যখনই ফুর্তি করতে ইচ্ছে করছে, সঙ্গে সঙ্গে মদ খোঁজো। রিল্যাক্স করতে ইচ্ছে করলেই যেন মদ ছাড়া আর গতি নেই। তখন আরও একটু বেশি খাওয়া হয়ে যাচ্ছে। টলারেন্স অর্থাৎ মদ খেতে-খেতে শরীর অল্প পরিমাণে মদকে টলারেট করতে শিখে যাচ্ছে। একই কিক পাওয়ার জন্য তার আরও বেশি পরিমাণ মদ লাগছে। অর্থাৎ আগে যেটা এক বা দুই পেগেই হত, এখন সেটাই হচ্ছে তিন বা চার পেগের পরে। এটার মানে, শরীরের ক্ষতি শুরু হয়ে গিয়েছে। এরপর সেই মানুষের মদ পান করা বা না করার চয়েস আরও কমতে থাকে। ডিপেন্ডেস যখন মদের উপর সেই মানুষটি নির্ভরশীল হয়ে পড়ছেন। অর্থাৎ একদিন, দু’দিন না খেলে হয়তো সেন্স অফ ওয়েল বিয়িংটাই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ মানুষ আর মদ খাচ্ছেন না, মদ মানুষকে খাচ্ছে।
আমি মদ ব্যবহারের বিরোধী নই। কিন্তু যখনই সেটা ইউজ় থেকে অ্যাবিউজ়ে যাচ্ছে, তখনই বোধহয় কোথাও লাইন টানা দরকার।
অলঙ্করণ: অভীক দেবনাথ