‘মিন্ত্রা’র লোগো কতটা অবমাননাকর মহিলাদের পক্ষে? কী বলছেন সমাজের বিভিন্ন পেশার মানুষ

TV9 বাংলা যোগাযোগ করেছিল বিজ্ঞাপন-নির্মাতা থেকে শুরু করে অভিনেতা, ফ্যাশন ডিজাইনার, লোগো আর্টিস্টদের সঙ্গে। তাঁদের চোখে মিন্ত্রার 'M' কীভাবে ধরা দিয়েছে, তা রইল আমাদের আতসকাচে।

'মিন্ত্রা'র লোগো কতটা অবমাননাকর মহিলাদের পক্ষে? কী বলছেন সমাজের বিভিন্ন পেশার মানুষ
গ্রাফিক- অভীক দেবনাথ
Follow Us:
| Updated on: Feb 06, 2021 | 8:02 PM

লোগো বদলে ফেলেছে অনলাইন শপিং সংস্থা ‘মিন্ত্রা’। ‘আপত্তিকর অংশ’ বাদ দেওয়া হয়েছে যত্ন করে। সংস্থাটির ওই সিদ্ধান্তে সোশ্যাল মিডিয়া এখন দ্বিধাবিভক্ত। জোরকদমে চলছে তর্ক-বিতর্ক, মিম-হাসাহাসি। একদলের মত, ‘যা হয়েছে বেশ হয়েছে, মেয়েদের জন্য অবমাননাই তো’। অন্য দিকে, আর এক পক্ষের মন্তব্য, “২০০৭ থেকে দেখে আসছি, আজ পর্যন্ত মনে হয়নি মেয়েদের অবমাননা করা হয়েছে। যে ব্যক্তি এই অভিযোগ করেছেন, এর পর থেকে তো যে কোনও জায়গায় ইংরাজি ‘M’ অক্ষর দেখলেই তিনি প্রতিবাদ করবেন।”

বিতর্কের সূত্রপাত গত বছর ডিসেম্বরে। মুম্বইয়ের সমাজকর্মী নাজ পটেল পুলিশের কাছে মিন্ত্রার লোগো নিয়ে প্রথমবার অভিযোগ জানান। তিনি দাবি করেন , লোগোটি মহিলাদের পক্ষে অসম্মানজনক। নাজের বক্তব্য ছিল, মিন্ত্রার ‘M’ আদপে ‘M’ নয়। যেভাবে রঙের খেলা চলেছে ‘M’-এ, তাতে ‘M’ ইঙ্গিত করছে মহিলাদের যৌনাঙ্গের প্রতি। নাজ আরও জানান, বছর কয়েক আগে এক অনুষ্ঠানে তিনি দেখেন কিছু পুরুষ ‘মিন্ত্রা’র লোগো নিয়ে হাসাহাসি করছে। তাঁর আরও দাবি, এর পরে ‘মিন্ত্রা’কে একাধিকবার মেল মারফত লোগো বদলানোর জন্য অনুরোধ করলেও লাভ হয়নি। সে কারণেই এই আইনি ব্যবস্থা। নাজের সুরে সুর মেলান মুম্বই পুলিশের সাইবার ক্রাইম বিভাগের ডেপুটি কমিশনার রেশমী করণদিকরও। ফল মিন্ত্রার ‘নতুন লোগো’।

এ বার প্রশ্ন হল, ‘মিন্ত্রা’র ওই লোগো মহিলাদের পক্ষে কতটা অবামাননাকর? নাকি সোশ্যাল মিডিয়ার ‘অসহিষ্ণুতা ট্রেন্ডে’ তানিশকের পর এ বার টার্গেট ‘মিন্ত্রা’? তাড়াহুড়ো করে, আত্মপক্ষ সমর্থনের বিন্দুমাত্র চেষ্টা না করে এক দিনের মধ্যে রাতারাতি মিন্ত্রার লোগো বদলানোর সিদ্ধান্ত কি কোনওভাবে নেতিবাচক বার্তা বয়ে আনবে ব্র্যান্ডটির উপর? নাকি তানিশকের ঘটনা চাক্ষুষ করা মিন্ত্রা আদপে ‘ঘর পোড়া গরু’, যে সিঁদুরে মেঘ দেখে ‘ভয় পেয়েছে’? TV9 বাংলা যোগাযোগ করেছিল বিজ্ঞাপন-নির্মাতা থেকে শুরু করে অভিনেতা, ফ্যাশন ডিজাইনার, লোগো আর্টিস্টদের সঙ্গে। তাঁদের চোখে মিন্ত্রার ‘M’ কীভাবে ধরা দিয়েছে, তা রইল আমাদের আতসকাচে।

মিমে ভরেছে সোশ্যাল মিডিয়া 

ইন্দ্রনীল রায় চৌধুরী (বিজ্ঞাপন-নির্মাতা এবং পরিচালক) বছর দুয়েক আগে ‘মিন্ত্রা’ কলকাতায় ওদের যে পুজোর অ্যাডটা করেছিল, সেটা আমি করেছিলাম। তখন তো লোগোটা ব্যবহার করেছিলাম। কিছু চোখে পড়েনি। এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় একটা যুগ তৈরি হয়েছে, যেখানে যা-কিছু নিয়েই উত্তেজনার আবহাওয়া সৃষ্টি করা হয়। আগে যেটা হতো এরকম একটা লোগো যদি কারও একটু অন্যরকমও মনে হতো, তবে হয়তো তা নিয়ে ড্রয়িংরুমে একটু কথাবার্তা হতো, হাসাহাসি হতো। লোকে ভুলে যেত। কিন্তু এখন যেটা হচ্ছে… জানি না লোকের হাতে কাজ কম কি না অথবা সোশ্যাল মিডিয়ার সবকিছুকেই সত্যি বলে ভেবে নিচ্ছে কি না। সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রতিটা ঘটনার স্থায়িত্ব অনেক বেশি। আশেপাশে যোগ হচ্ছে আবর্জনা। সেগুলোই জমে-জমে একটা পাহাড় তৈরি করে ফেলছে।

অভিষেক রায় (ফ্যাশন ডিজাইনার) “আমার মনে হয় মানুষের দেখার মানসিকতাটা নোংরা হয়ে গিয়েছে। যে কোনও ডিজাইনই দেখার আলাদা নজর থাকে। প্রধান সমস্যা কৃষ্টি বা ডিজাইন ভ্যালুটা ভুলে গিয়ে বেশিরভাগ মানুষ এখন নোংরা দিকটা দেখতে শুরু করেছে। আমার ব্যক্তিগতভাবে এরকমটা মনে হয়নি। যতক্ষণ ব্যাপারটা আন্ডারলাইন না করা হচ্ছে, আমার মনে হয় ততক্ষণ সাধারণ মানুষ ব্যাপারটা এরকম ভাবে দেখবেও না, ভাববেও না। হতে পারে ‘মিন্ত্রা’ নিজেই এই প্রচারটা চালিয়েছে। কথাতেই তো বলে নেগেটিভ পাব্লিসিটিও একধরণের পাব্লিসিটি।”

মধুমিতা সরকার (অভিনেত্রী) “ছোটবেলায় মেঘ দেখে আমরা বলতাম, ওই যে দেখ যেন মনে হচ্ছে ঘোড়া দৌড়চ্ছে। অনেকের অনেক কিছু দেখে অনেক কিছুই মনে হতে পারে। কিন্তু তার পিছনে সঠিক এবং সুচারু প্রমাণও দরকার। আমার মেঘ দেখে ঘোড়া মনে হচ্ছে মানেই যে মেঘটা ঘোড়া, তা তো নয়। আর তা ছাড়া ‘মিন্ত্রা’ শুধুমাত্র উওম্যান ক্লোদিং ব্র্যান্ড নয়। বা ‘মিন্ত্রা’য় শুধুমাত্র মেয়েদের অন্তর্বাস পাওয়া যায়, এমনটাও নয়। যিনি অভিযোগ জানিয়েছেন, জানি না কেন তাঁর এমন মনে হয়েছে। আর এখন মিমের যুগে মানুষ প্রমাণ খোঁজে না। একজন কেউ কিছু বললে বাকিরাও সমস্বরে চেঁচিয়ে ওঠে। আর অনলাইন শপিংয়ের সময় আমি জামাকাপড় খুঁজি। লোগোর ডাবল মিনিং বার করার চেষ্টা করি না।

মুম্বইয়ের সমাজকর্মী নাজ পটেল পুলিশের কাছে মিন্ত্রার লোগো নিয়ে প্রথমবার অভিযোগ জানান

কৃষ্টি কর্মকার (আর্ট ডিরেক্টর, লিও বার্নেট) “আর্ট ক্য়ান বি সিন ইন ডিফারেন্ট ফর্মস। আমার যেটা মনে হয়েছে ‘মিন্ত্রা’র ‘M’ নেওয়া হয়েছে তার কোম্পানির ইনিশিয়াল থেকে। যদি আপনি ‘মিন্ত্রা’র গোটা লোগোটা দেখেন (MYNTRA), তাহলে দেখবেন গোটা লোগোটাতেই ওই ট্রান্সপ্য়ারেন্ট আর্ট ফর্মটাকে নিয়ে কাজ করা হয়েছে। সব ডিজাইনের পিছনেই একটা লজিক থাকে। আমি জানি না, ‘মিন্ত্রা’ তাদের লোগো ডিজাইনিংয়ের সময় কী লজিক ব্যবহার করেছে। তবে একজন আর্ট ডিরেক্টর হিসেবে আমার খারাপ তো কিছু লাগেনি। ‘মিন্ত্রা’ লোগো চেঞ্জ করলেও বিশেষ হেরফের ঘটেনি। কারণ একটা লোগো একটা ব্র্যান্ডের আইডেন্টিটি বা পরিচিতি হয়ে যায়। যেমন আপনি হঠাৎ করে অ্যাপেলের লোগো দেখলেই চিনতে পারবেন যে, ওটা অ্যাপেলের লোগো। সেটা যদি পুরোটা বদলে দেওয়া হতো, তাহলে একেবারে অন্য রকম নতুন লোগো দিয়ে আবারও ব্র্যান্ডের পরিচয় রি-এস্ট্যাব্লিশ করাটা বেশ সময়সাপেক্ষ।”

সৈকত সামন্ত (‘মিন্ত্রা’র ডেলিভারি বয় হিসেবে কাজ করেছেন একসময়) “যে সংস্থার লোগো নিয়ে এত কথা হচ্ছে, সেই সংস্থার ডেলিভারি বয় হিসেবে আমিও কাজ করেছি একটা দীর্ঘ সময়। খবরে পড়লাম যিনি অভিযোগ করেছেন, তিনি বলেছেন, কিছু পুরুষ নাকি ওই লোগো নিয়ে হাসাহাসি করছিল। আমরা যারা ডেলিভারি বয় হিসেবে কাজ করি, তাঁরা মাঝেমধ্যেই একসঙ্গে দেখা হলে এটা-ওটা-সেটা… কেন আরেকটু বেশি মাইনে পাচ্ছি না… কোথায় ভাল কী সেল চলছে… এসব নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করি। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনও আড্ডাতেই ওই লোগো নিয়ে কোনও কথা হয়নি। তবে ভদ্রমহিলা যখন অভিযোগ করেছেন, তাঁর নিশ্চয়ই খারাপ মনে হয়েছে বলেই করেছেন।”

একতা ভট্টাচার্য (গ্রাফিক্স ডিজাইনার) এ প্রসঙ্গে যখন বিভিন্ন মানুষের ফেসবুক পোস্ট দেখছিলাম, তাঁদের মধ্যে ৯৯% মানুষ লিখেছেন এর আগে ওই লোগোকে ‘এম’ ছাড়া অন্য কিছু মনেই হয়নি তাঁদের। যে ভদ্রমহিলা অভিযোগ করেছেন, তাঁকে আমি অসম্মান করছি না এতটুকুও। তবে এটুকু বলতে চাই উনি যখন এই ব্যাপারটা নিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছেন, তখন মেয়েদের নিয়ে আরও যে সব গুরুতর ঘটনা ঘটে চলেছে সে সব নিয়েও যেন উনি প্রতিবাদ করেন। আশা রাখছি , শুধু প্রতিবাদই নয়, লড়ার ক্ষমতা নিয়ে যেন জিতে দেখান।