কলকাতা: ‘সিমপ্লিসিটি ইজ় আ ডিফিকাল্ট থিং টু অ্যাচিভ’। সত্যিই তাই। সাধারণত্ব অর্জন করা আসলে সহজ নয়, বলেছিলেন স্যার চার্লস চ্যাপলিন। তার জন্য হতে হয় ‘অসাধারণ’। প্রয়োজন হয় নিরলস সাধনার। ধরুন, আপনি কখনও সিগারেট খাননি। বা মাঝাসাঝে, কখনও সখনও, একটু আধটু, এক আধটা সিগারেট ঠোঁটে তুলেছেন। জানেন, কোন টানে সুখ, আর কোন টানে অসুখ। সেই আপনাকেই যদি ঘণ্টায় ৩০টা সিগারেট খেতে বলা হয়, পারবেন? আরও একবার বলছি, ঘণ্টায় ৩ প্যাকেট, ৩০টি সিগারেট পরপর, পারবেন?আপনি দয়া করে ‘অনুপ্রাণিত’ হবেন না। একজনের উদাহরণ দিচ্ছি। মৃণাল সেন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পর এক সাক্ষাৎকারে নিজে বলেছিলেন, তিনি দিনে ৬০টি সিগারেট খান। এরপর বিগত দশকে এমন স্বগতোক্তি আর কারও মুখে শুনিনি।
বছর দশেক পর। দীর্ঘ জাম্প কাটের মাঝে শুধু একবার, নীলকণ্ঠ বাগচীকে দেখেছি সাদা গরল ঢকঢক করে গিলে খেয়ে নিতে। জানা নেই, ‘মেঘে ঢাকা তারা’ করতে গিয়েঠিক কতটা‘বিষ’ পান করতে হয়েছিল শ্বাশত চট্টোপাধ্যায়কে। কখনও জিজ্ঞাসা করার সুযোগও হয়নি। তবে অপরাজিত রায়কে দেখে আসার পর সুযোগটা হল। প্রস্থেটিক মেকআপে ম্যাজিকটা আগেই করে ফেলেছেন শিল্পী সোমনাথ কুণ্ডু। বাকি ফিনিশিং টাচ্ জিতু কমলের। ‘ঢ্যাঙার মতো চেহারা’, আরোপিত বলতে শুধু এইটুকুই। বাকি সবটাই জিতুর ‘কামাল’। অর্জিত।
অভিনেতারা মূলত দু’টি প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে নিজেকে নিয়ে যান। চরিত্র হতে গিয়ে নিজেই চরিত্র হয়ে যান, আরেকটি একেবারেই ‘মেথোডিক্যাল’। একেবারে ব্যাকরণ মেনে, কারণ জেনে কর্ম করা। অনির্বাণ ভট্টাচার্য যেমন দ্বিতীয় ধারার অভিনেতাদের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। আরও অনেকেই এই প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যান। জিতু কমলও ব্যতিক্রম নন।
অনীক দত্তের ‘অপরাজিত’ হয়ে উঠতে গিয়ে জিতু প্রথমেই যেটা করেছেন, যাকে সহজে বলা যায় ‘জ়োন ক্রিয়েট’ করা। স্ত্রীকে অন্য ফ্ল্যাটে পাঠিয়ে দিয়েছেন। থেকেছেন একা। বিচ্ছিন্ন। ‘বিচ্ছেদ পর্ব’ ছিল ২৩ দিনের। ভিডিয়ো কলে স্ত্রী থেকেছেন শুধু মাত্র সহকারীর ভূমিকায়। শুধুই কিউ দিয়েছেন অপরাজিতের বিজয়া হয়ে।
হলুদ রঙের প্যাকেট। ইংরেজিতে লেখা ‘গোল্ড ফ্লেক’। ট্রেড মার্ক, ডব্লুই ডি অ্যান্ড এইচ ও উইলস। লালের মাঝে আবার হলুদ অক্ষরে লেখা হানি ডিউ। একাবারে নীচের দিকে ব্রিস্টল অ্যান্ড লন্ডন লেখাও আলাদা করে নজরে পড়বে। এমন কতগুলো প্যাকেট প্রয়োজন হয়েছে? জিতু কমল বলতে পারেননি। তবে মনে রাখার মতো যেটা বললেন, সেটা হল: অনীক দত্তর ‘অপরাজিত’ হয়ে ওঠার জন্যএকটা শট দিতে গিয়ে ৩৪টা সিগারেট খেতে হয়েছিল তাঁকে।
এখানেই শেষ নয়, স্রেফ চরিত্রের মধ্যে থাকবেন বলেই বাড়িতে এসে কখনও সাদা কাগজ মুড়িয়ে ‘সত্যজিৎ রায়ের সিগারেট এটিকেট’ শিখেছেন। জ্বলন্ত সিগারেট থেকে ধোঁয়া বেরিয়ে আসার পরও কীভাবে আঙুলের ফাঁকে রেখে দিতে হবে ফিল্টার ছাড়া গোল্ড ফ্লেক, তা-ও আয়ত্ত করছেন নিরলস প্রচেষ্টায়।শেখার তালিকা এখানেই শেষ নয়। হাঁটাচলা এবং কথা বলা। গাড়ি থেকে নেমে গাড়ির দরজা বন্ধ পর্যন্ত, জিতুর ধ্যান, জ্ঞান ছিল — অনুকরণ এবং অনুসরণ।
ব্যারিটোন ভয়েস (অতিরিক্ত ধূমপান এবং বয়সের কারণে যা ছিল সত্যজিৎ রায়ের সহজাত) বাদ দিয়ে, কতটা পেরেছেন? অপরাজিত রায়কে কত নম্বর দেবেন?‘ছোটবেলায় যে পরীক্ষা ভাল হত সেই পরীক্ষায় নম্বর কম, আর যে পরীক্ষা তুলনায় খারাপ হয়েছে, ভাল ফল হয়েছে সেই বিষয়েই’, তাই জিতুর উত্তর, একশো শতাংশ দিয়েছেন, তবে আসল সুদ হয়ে কতটা ফিরেছে নিজে তাঁর হিসেব কষবেন না। আবির চট্টোপাধ্যায় এই চরিত্রটা করলে কত নম্বর দিতেন? জিতুর বিনয়ী উত্তর, ‘‘আমি যেমন চেষ্টা করেছি, আবিরদাও সুবিচারই করতেন।’’