সত্যজিতের ছোটগল্পের অডিয়োগুণ এতটাই, যেন ‘পারফেক্ট থিয়েটার অফ দ্য মাইন্ড’; ‘সানডে সাসপেন্স’-এর মাস্টারমাইন্ড ইন্দ্রাণী চক্রবর্তী

অমর্ত্য মুখোপাধ্য়ায় | Edited By: সঙ্ঘমিত্রা চক্রবর্ত্তী

May 02, 2021 | 12:53 PM

চলচ্চিত্রকার, ছোটগল্পকার, সঙ্গীত-পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের অসংখ্য ছোটগল্প জুড়ে যেভাবে ছড়িয়ে রয়েছে অডিয়োস্টোরির উপাদান, আজকের পৃথিবীতে যেখানে পডকাস্ট এবং অডিওবুক-এর রমরমা ক্রমশ বাড়ছে, সেখানে সত্যজিৎ-জন্মশতবর্ষে একটি ভিন্ন সাক্ষাৎকার। TV9 বাংলা কথা বলল 'সানডে সাসপেন্স'-এর মাস্টারমাইন্ড এবং প্রথম প্রজেক্ট ডিরেক্টর ইন্দ্রাণী চক্রবর্তীর সঙ্গে।

Follow Us

প্রশ্ন ১: ৪৪ মিনিট ১১ সেকেন্ড দৈর্ঘ্যের অডিয়োবুক ‘খগম’ যখন প্রথমবার শোনা গিয়েছিল রেডিও মির্চি ৯৮.৩ এফএম (এখন মির্চি ৯৮.৩)-এ, তখন ২২তম সেকেন্ডে মির্চি দীপের গলায় শোনা গিয়েছিল: “সত্যজিৎ রায়ের লেখা রোমাঞ্চকর কিছু গল্প দিয়ে সাজানো আমাদের এই বিশেষ নিবেদন ‘সানডে সাসপেন্স’ (Sunday Suspense)। আজকের গল্প ‘খগম’।” সত্যজিৎ-জন্মশতবর্ষে প্রথমেই যেটা জিজ্ঞেস করার সেটা হল, অডিয়োবুকের (Audiobook) মাধ্যমে ‘রে’-কে বাঙালি শ্রোতার কাছে ছড়িয়ে দেওয়ার ভাবনার গোড়ায় কী ছিল: সত্যজিৎ-পড়া বাঙালির কাছে ‘রে’-কে নতুন প্যাকেজিংয়ের মাধ্যমে তুলে ধরা নাকি সত্যজিৎ না-পড়া বাঙালির কাছে ‘রে’-কে পৌঁছে দেওয়া?
ইন্দ্রাণী:
সেভাবে ভেবে দেখতে গেলে হয়তো দু’টোই। কিন্তু যদি জিগ্যেস করা হয়, আগে কোন চিন্তাটা কাজ করেছে, তাহলে অবশ্যই বলব সত্যজিৎ না-পড়া বাঙালির কাছে ‘রে’-কে পৌঁছে দেওয়া বা তুলে ধরা। শুধু তাই-ই নয়, গোড়ার যে ভাবনাটা—যেখান থেকে ‘সানডে সাসপেন্স’ (Sunday Suspense)-এর মতো একটা অডিওবুক (Audiobook) বা অডিওড্রামা (Audiodrama) প্রেজ়েন্টেশনের ভাবনা—সেটা হল, বই পড়াটা কমে গিয়েছে। বাঙালি গল্পের বই পড়ছে না। বাংলাতে একটা অসাধারণ ছোটগল্পের সম্ভার রয়েছে। কিন্তু সাহিত্যের সঙ্গে আমাদের ইয়ং জেনারেশন—নতুন প্রজন্ম—তাদের পরিচয় নেই। তাদের কাছে নতুন কিছু একটা তুলে ধরা যায় কি না। এবং যদি সাহিত্য—বাংলা সাহিত্যকে—তুলে ধরতেই হয়, তাহলে সত্যজিৎ দিয়েই হোক হাতেখড়িটা। বলাই বাহুল্য, যারা বাংলা গল্প পড়তে ভালবাসে এবং পড়ে, সেই ৮ থেকে ৮০ সবার কাছেই সত্যজিৎ যেহেতু সমান প্রিয়, তাই অডিয়োর মাধ্যমেও তাদের কাছেও হয়তো সত্যজিৎ জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পারবেন। এ বার যারা জানে না—বিশেষত একটা বিপুল সংখ্যক ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে-পড়া ছেলেমেয়েরা—যারা হয়তো বাংলা বই পড়ে না বা বাংলা বই পড়তে যাদের অসুবিধে হয়, যে মুহূর্তে সেটাকে অডিয়ো মাধ্য়মে প্রেজ়েন্ট করছি, তাকে গল্পটা পড়ে শোনাচ্ছি, তার কাছে সেটা অনেক বেশি অ্যাক্সেসবল হয়ে যাচ্ছে। তাই-ই আমি বলব প্রথম ভাবনার দিক থেকে অবশ্যই যারা বাংলা বই পড়ে না বা সত্যজিৎ-সৃষ্ট সাহিত্যের সঙ্গে যারা পরিচিত নয়, তাদের কাছে সত্যজিতকে তুলে ধরাটাই অবশ্যই মূল ভাবনা। এবং যারা বাংলা বই পড়ে এবং সত্যজিতের সাহিত্যের সঙ্গে পরিচিত, তাদের কাছে নতুন মোড়কে—অডিয়োর মাধ্যমে—প্রেজ়েন্ট করা যাতে তারা নতুন করে আবিস্কার করতে পারে সত্যজিতকে, সেটাও একটা ভাবনা হিসেবে অবশ্য়ই ছিল। গল্প শুনতে কে না ভালবাসে? গল্প যদি না-ও পড়ি—বই পড়ার অভ্যেস যদি না-ও থাকে (নেশা তো ছেড়েই দিলাম)—সেক্ষেত্রেও সত্যজিতের গল্প কিন্তু একটা ড্রাগ-এর মতো কাজ করতে পারে। নেশা ধরিয়ে দিতে পারে। এবং সম্ভবত সেটাই হয়েছে পরবর্তীকালে।

 

আরও পড়ুন: রহস্য রোমাঞ্চের জগতে ভাটা! কোভিড আক্রান্ত হয়ে প্রয়াত সাহিত্যিক অনীশ দেব

 

 

প্রশ্ন ২: রবিবারের দুপুরে এফএম-এর পরিচিত ফর্ম্যাটের বাইরে বেরিয়ে এসে বাঙালিকে ‘রে’ শোনানো। ‘শোনানো’ শব্দটার উপর বিশেষ করে জোর দিচ্ছি, কারণ ‘রে’-কে ‘শোনা’য় বাঙালি সেভাবে অভ্যস্ত ছিল না একেবারেই। ‘রে’-কে নিয়ে এ হেন এক্সপেরিমেন্ট করার আগে মনে হয়নি পান থেকে চুন খসলেই রে-রে করে তেড়ে আসবে শহুরে, শিক্ষিত-মধ্যবিত্ত বাঙালি?
ইন্দ্রাণী: এখন যদি ভেবে দেখি—এই অনুষ্ঠানটি শুরু হওয়ার প্রায় এক যুগ পর—তাহলে নিশ্চয়ই মনে হয় যে, খানিকটা দুঃসাহস হয়তো দেখিয়েই ছিলাম আমরা সে সময়। কিন্তু মনে হয়নি যে পান থেকে চুন খসলেই বাঙালি রে-রে করে তেড়ে আসবে কারণ এটা এক্কেবারে গঙ্গাজলে গঙ্গাপুজোর মতোই একটা কাজ হয়েছিল। আমরা কিন্তু সত্যজিতের ছোটগল্পকে ‘অ্যাডাপ্ট’ করিনি অথবা নতুন চিত্রনাট্য বা শ্রুতিনাটক হিসেবে উপস্থাপনা করিনি। আমি যখন রেডিয়োর জন্য এই ভাবনাটা ভাবি, তখন কিন্তু সেটাকে অডিয়োবুক ফর্ম-এই রাখা হয়েছিল। গল্পটা যেমন রয়েছে, তার ভাষা যেমন রয়েছে, একেবারে প্রথম শব্দটা থেকে শেষ দাঁড়িটা পর্যন্ত, সব কিছু হুবহু একভাবে রাখা হয়েছে। একটা কমা, দাঁড়িও আলাদা করে বসাতে হয়নি। যেটা করা হয়েছিল, সেটা হল, অভিনয়ের মাধ্য়মে লেখাগুলোকে একটা অন্য় মাত্রা দেওয়া বা ‘এনহ্যান্স’ করা হয়েছে। নাটকীয়তা আনা হয়েছে। এবং সর্বোপরি যেটা আকর্ষণীয় সবার কাছে, সেটা হল একটা সাউন্ড ডিজ়াইনের (Sound Design) মাধ্যমে চলচ্চিত্রকার সত্যজিতের ছোটগল্পগুলোকে বেতারে সিনেমার রূপ দেওয়া হয়েছে। ফলে লোকে তেড়ে তো আসেইনি বা মনেও হয়নি যে তাঁরা তেড়ে আসতে পারেন কারণ সত্যজিতের উপর কলম চালানোর ধৃষ্টতা তো আমরা কেউ দেখাইনি। কিন্তু তাঁর ভিতরের যে ভাবনাগুলো, সেগুলোকে আমরা নিশ্চয়ই ‘ইন্টারপ্রেট’ করার চেষ্টা করেছি অভিনয়ের মাধ্যমে, মিউজ়িকের মাধ্যমে, সাউন্ড এফেক্টসের মাধ্যমে। কিন্তু যেটা হয়েছে—অর্থাৎ আগে যেটা বললাম—সেটা হল গঙ্গাজলে গঙ্গাপুজো। তাঁর লেখা এতটাই নিঁখুত যে একেবারেই হাত দিতে হয়নি। এবং চিত্রনাট্যটা যেন তৈরিই ছিল এবং অডিয়ো (Audio)-র জন্যই তৈরি ছিল। ফলে ওই টেনশনটা ছিল না। যারা সত্য়জিতের লেখা সম্পর্কে জানেন না, তাদের কাছে এটা তাই-ই সম্পূর্ণ একটা নতুন স্বাদ বয়ে আনল। যেন একটা সম্পূর্ণ নতুন জগৎ খুলে গেল। আর যাঁরা পরিচিত, যাঁরা ছোটবেলা থেকে সত্যজিৎ-সাহিত্য পড়ে বড় হয়েছেন, যাঁরা তাঁর সব গল্প মুখস্থ বলতে পারেন, তাঁরা গল্পগুলো নতুন করে আবিস্কার করতে পারলেন।

 

 

 

 

নিজস্ব চিত্র

 

প্রশ্ন ৩: এই যে সত্যজিৎ না-পড়া বাঙালির কাছে রে‘-কে পৌঁছে দেওয়া এবং ধীরে-ধীরে সেই শ্রোতাকে তাঁর গল্পের প্রতি অ্যাডিক্টকরে তোলা… প্রক্রিয়াটা যখন চলছে, তখন এটা কখনও মনে হয়েছে যে সত্যজিতের লিখনশৈলী এতটাই স্বয়ংসম্পূর্ণ যে বইয়ের পাতা থেকে রেডিয়োতে—যে রেডিয়োকে থিয়েটার অফ দ্য মাইন্ডবলা হয়—ট্রান্সফর্মডহওয়ার ক্ষেত্রে ওঁর সাহিত্য খুব সহজেই প্ল্যাটফর্ম বদল করে নিতে পারে? মানে বই থেকে সিনেমা… বই থেকে রেডিয়ো… রে‘-র গল্প বলার স্টাইলটা এতটাই স্বকীয় অথচ সহজ যে ওঁর লেখা নিয়ে বারবার কাজ করা যায়?
ইন্দ্রাণী: এটা একদম ঠিক কথা যে সত্যজিতের লেখা এতটাই স্বয়ংসম্পূর্ণ, যে বইয়ের পাতা থেকে রেডিয়োতে তুলে আনতে কোনওই অসুবিধে হয়নি। হয়তো সে কারণেই রেডিয়োতে এটা করার কথা মাথায় এসেছিল। বাংলায় তো অডিয়োবুক-এর চল ছিল না সেরকমভাবে কখনওই। বেতার-নাটকের (Radio Drama) কথা আমরা অনেকেই বা সকলেই জানি। যদিও সেটা ৫০, ৬০, ৭০-এর দশকে অনেক বেশি জনপ্রিয় ছিল। তারপর বেতার-নাটকের ব্যাপারটা অনেকটাই কমে যায়। নাটক না-বলে আমি বলি রেডিয়োতে এই প্রথম বই পড়ার মজা। ‘বই পড়া’—এটা কিন্তু এই অনুষ্ঠানের শুরুতে প্রথম থেকেই বলা ছিল। সাহিত্য থেকে নিয়ে শ্রেষ্ঠ কিছু গল্পকে তুলে ধরা হচ্ছে। সেক্ষেত্রে এ কথা একেবারেই সত্যি যে অডিয়োর জন্য আলাদা করে কোনও স্ক্রিপ্ট করার প্রয়োজন কোনও দিনই মনে হয়নি। এবং সবথেকে যেটা ইন্টারেস্টিং জিনিস—বিশেষ করে আমি ওঁর ছোটগল্পের কথা বলতে চাই (ফেলুদার কথা বলছি না কারণ ফেলুদা নিয়ে প্রচুর কথা হয়েছে এবং হয়)—যেহেতু উনি মূলত ফিল্ম-মেকার, সেহেতু যেটা হয়েছে, ওঁর লেখাও কিন্তু ছবির চিত্রনাট্যের মতো এগিয়েছে। কিছুই না, যদি গল্পটাকে একটু সুন্দর করে পড়া যায়, তাহলেই কিন্তু একটা অপূর্ব ছবি চোখের সামনে সিনেমার মতো রোল করতে শুরু করবে। এবং আমরা যারা রেডিয়ো শেখেছি এককালে, তাদের একটা কথা বলা হত ‘রেডিও মেকস বেস্ট পিকচার্স’। মানে কল্পনাশক্তি দিয়ে ছবি আঁকা—এটা রেডিয়োর থেকে ভাল কেউ করে না। ‘রেডিও ইজ় দ্য থিয়েটার অফ দ্য মাইন্ড’—অর্থাৎ কেউ চোখ বন্ধ করে আছেন আর গোটা একটা নাটক ধীরে-ধীরে উন্মোচিত হচ্ছে, এমনটা যদি হয়, তাহলে সেটাকে সত্যজিৎ একেবারে হাড়েহাড়ে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর লেখনীর মাধ্যমে। আমি একাধিক উদাহরণ দিতে পারি যেখানে প্ল্যাটফর্মটা বদল হচ্ছে ঠিকই—অর্থাৎ বইয়ের পাতা থেকে অডিয়োতে যাচ্ছে এবং অডিয়োয় একটা সিনেমা হয়ে সেটা ফুটে উঠছে—কিন্তু অন্য় লেখকদের সব গল্পের ক্ষেত্রে আমি হয়তো এতটা জোর দিয়ে বলতে পারব না। সত্যজিতের গল্পের ক্ষেত্রে আমি একশোবার বলতে পারি ‘পারফেক্ট থিয়েটার অফ দ্য মাইন্ড’। ফলে ওঁর লেখা ছোট গল্প নিয়ে বারবার, একশোবার নিশ্চয়ই কাজ করা যায়।

 

 

 

নিজস্ব চিত্র

 

প্রশ্ন ৪: ছোটগল্প, ফেলুদা, প্রফেসর শঙ্কু, তারিণীখুড়ো, সত্যজিৎ-অনূদিত সাহিত্য—সানডে সাসপেন্স‘-রেফিরে-ফিরে এসেছেন বিভিন্ন রূপে। এই যে বারবার রে‘-কে পুনরাবিষ্কার করা, সেটার ক্ষেত্রে তো ভীষণ জরুরি হল ওঁর ডিটেইলিংয়ের প্রতি ষোল আনার পরিবর্তে আঠেরো আনা যত্নশীল থাকা… টেক্সটে যেটা সহজে লেখা যায়, হুবহু সেটা উদ্ধৃত করে অডিয়োবুকে তুলে দেওয়া যায় না এবং উচিতও নয়। সেক্ষেত্রে ইম্প্রোভাইজ়েশনকতটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল নাট্য-রূপান্তর এবং ন্যারেশন‘-এর ক্ষেত্রে? সেরা ইম্প্রম্পটুরি-অ্যাকশনের কয়েকটা স্মৃতি (পরিচালক হিসেবে আপনার এবং আরজে-দের) যদি শেয়ার করেন…
ইন্দ্রাণী: ফেলুদা, শঙ্কুর একটা বিশাল শ্রোতা-দর্শক সবই আছে। আমি বিশেষ করে ছোটগল্প এবং তার সঙ্গে তারিণীখুড়োর কথা আলাদাভাবে উল্লেখ করতে চাই। প্রথম একটা বছর, প্রায় ৫২টা ছোটগল্প নিয়ে ‘সানডে সাসপেন্স’ অনুষ্ঠানটা সাজানো হয়েছিল। সেখানে সত্যি কথা বলতে যেটা আগেও বললাম, একটা শব্দকেও উনিশ-বিশ করতে হয়নি কারণ সত্যজিতের ডিটেইলিং এতটাই নিখুঁত। আমাদের যেটা চ্যালেঞ্জ ছিল সেটা হল, উই হ্যাড টু ডু জাস্টিস টু দ্য টেক্সট উইথ দ্য হেল্প অফ মিউজ়িক অ্যান্ড অ্যাক্টিং। সেইজন্য আমি যেটা বললাম যে আমার কতগুলো গল্পকে নতুন করে আবিস্কার করেছি। দু’-একটা উদাহরণ দিচ্ছি, যেটার ক্ষেত্রে ডিটেইলিং এবং ইম্প্রোভাইজ়েশন ভীষণভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। যেমন ‘বঙ্কুবাবুর বন্ধু’, এটা সম্ভবত সানডে সাসপেন্স-এর দ্বিতীয় বা তৃতীয় গল্প ছিল। এই অর্ডারে কতগুলো গল্প পরপর হয়েছিল—’সেপ্টোপাসের খিদে’, ‘বঙ্কুবাবুর বন্ধু’, ‘ভূতো’… প্রত্যেকটা গল্পের ক্ষেত্রে—অভিনয় তো ছেড়েই দাও—সাউন্ডের একটা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। না-বলা যেটা, সেটাকে সাউন্ডের মাধ্যমে বলা বা ক্রিয়েট করার একটা বড় চ্যালেঞ্জ আমাদের সামনে ছিল। অভিনয়ের মাধ্যমে যতটা ক্যারেক্টারাইজ়েশন করতে হয়েছে, তার সঙ্গে ডিটেইলিংটা হয়েছে কিন্তু এই সাউন্ডের মাধ্যমে। তাই ‘বঙ্কুবাবুর বন্ধু’-র ক্ষেত্রে ইম্প্রোভাইজ়েশন যদি বলো, তাহলে সাউন্ডের মাধ্যমে ‘অ্যাং’-এর গলা তৈরি করা বা ‘প্রফেসর হিজবিজবিজ’-এর মতো একটি অত্যন্ত ইউনিক গল্প—পড়ে তো একরকম মজা লাগেই, কিন্তু শুনলে, অন্তত যাঁরা শুনবেন, ওটার একটা অন্য রস তাঁরা গ্রহণ করতে পারবেন। আজ যদি আমাকে কেউ বলে একটা গল্প যেটা অডিয়োস্টোরি হিসেবে আমার সবথেকে পছন্দ, তাহলে আমি বলব ‘রতনবাবু আর সেই লোকটা’। এই গল্পটার মধ্যে এমন একটা ম্যাজিক আছে, যে ম্যাজিকটা পাঠক হিসেবে আমি যখন পড়েছিলাম, তখন আবিস্কার করিনি। কিন্তু যখন শ্রোতা হিসেবে আমি শুনছি, তখন সেটা একটা ওয়ার্ল্ড ক্লাস গল্প হিসেবে আমার কাছে উন্নীত হয়েছে। গ্লোবাল স্ট্যান্ডার্ডের গল্প তো অনেকগুলোই… বিশেষ করে ছোটগল্পের কথা তো আমি বলবই। ‘ফ্রিৎস’, ‘রতনবাবু আর সেই লোকটা’, ‘বাতিকবাবু’—প্রত্যেকটা গল্পের যে চরিত্রায়ণ বা তার ডিটেইলিং, ওঁর টেক্সটের মধ্যে এতটাই রসদ রয়েছে যে, আমার কাজ ছিল পরিচালক হিসেবে অভিনয় করিয়ে নেওয়া। অত্যন্ত ভাল দু’জন অভিনেতা-ভয়েস অ্যাক্টরকে পেয়েছি—মীর (Mir Afsar Ali) আর দীপ (RJ Deep)—এবং সাউন্ড ডিজ়াইনের মাধ্যমে—ডিজে রিচার্ড (DJ Richard)। বিশেষ করে ‘খগম’—যেটা দিয়ে এই সাক্ষাৎকার শুরু হয়েছে—তার যে গায়ে কাঁটা দেওয়া, দমবন্ধ করা পরিবেশটা যে সৃষ্টি করা হয়েছিল, সেটা কিন্তু সাউন্ড এবং অভিনয়ের মিশেল। একইভাবে ‘রতনবাবু আর সেই লোকটা’, ‘প্রফেসর হিজবিজবিজ’, ‘নীল আতঙ্ক’ এই গল্পগুলোর ক্ষেত্রেও।
এটাতে আমার কৃতিত্ব যতটা না-আছে, তার চেয়েও বেশি মীরের মতো একজন দক্ষ ও প্রতিভাবান ভয়েস অ্যাক্টরের। যখন ‘প্রফেসর হিজবিজবিজ’ হচ্ছে, তার গলাটা কীরকম হতে পারে, তার যে শারীরিক যে বর্ণনাটা আছে, সত্যজিতই হাত ধরে দেখিয়ে দিয়েছেন, কিন্তু গলাটা কীরকম হতে পারে, সেটা তো একটু কল্পনা করে নিতেই হবে। ফলে সেইগুলো কিন্তু সম্পূর্ণ ইম্প্রোভাইজ় করা। অথবা ‘অ্যাং’-এর গলা তৈরির সময়… বা ‘ফার্স্ট ক্লাস কামরা’-র মতো একটা গল্প যেখানে একজন জলজ্যান্ত মানুষ সাহেব ভূত সেজে প্যাসেঞ্জারকে ভয় দেখাচ্ছে, সেইরকম জায়গায় ইম্প্রোভাইজ় করে ভূতকে সাহেবের গলায় কথা বলানো… এগুলো সম্পূর্ণই আমরা কল্পনার আশ্রয় নিয়ে করেছি এবং এসব ক্ষেত্রে অভিনেতার দক্ষতাটাই বেশি। আমরা কিছু ক্ষেত্রে নিশ্চয়ই আলোচনা করেছি। কিন্তু সেখানে মীর-দীপের মতো ভয়েস অ্যাক্টর থাকায় কাজটা অন্য পর্যায়ে পৌঁছেছে। সত্যজিতের বেশিরভাগ ছোটগল্পের ক্ষেত্রে মীর প্রাইম্য়ারি ন্যারেটর হিসেবে ছিল। প্রফেসর শঙ্কুর ক্ষেত্রে একচেটিয়া দীপ। সেখানে শঙ্কুর ব্যাক্তিত্বটাকে তুলে ধরাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল, কারণ তার আগে শঙ্কুর কোনও অডিও রেফারেন্স ছিল না। শঙ্কুকে বইয়ের পাতায় এবং কমিকস-এর পাতাতেই লোকেরা পড়েছে, দেখেছে। সিনেমা তো হালের ঘটনা। তাই শঙ্কুকে একটা প্রাণ দেওয়ার কাজটা অনেকটাই হয়েছে দীপের হাত ধরে। এটা আসলে একটা টিম গেম।

 

নিজস্ব চিত্র

 

 

আমি বারবার ফিরে যাই সত্যজিতের ছোটগল্পের কাছে, তারিণীখুড়োর কাছে। ছোটগল্পগুলোর ক্ষেত্রে আমার সবসময়ই মনে হয় সত্যজিতকে প্রথম সারির ছোটগল্পকারদের সঙ্গে এক সারিতে দাঁড় করানো যায়। এবং এই যে সত্যজিৎ-জন্মশতবর্ষে আমরা নানাভাবে তাঁকে সেলিব্রেট করছি, আমার মনে হয় যে অডিয়ো আর্কাইভটা তৈর হয়েছে ‘সানডে সাসপেন্স’-এর মাধ্যমে, নতুন প্রজন্ম যদি ছোটগল্পকার হিসেবে সত্যজিতের মূল্যায়ন করতে চায়-শুধুমাত্র ডিটেকটিভ গল্পকার বা সায়েন্স-ফিকশন গল্প রচয়িতা হিসেবে নয়, তাহলে অবশ্যই এই অডিয়োস্টোরিগুলো তাদের সাহায্য করবে এবং এগুলোই হয়ে উঠতে পারে ‘রে-দ্য় মাস্টার’কে চেনার ক্ষেত্রে ইন্ট্রোডাকশন।

 

 

 

যে গল্পগুলোর কথা এখানে বলা হচ্ছে, সেগুলোর ক্ষেত্রে আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক হল এই গল্পগুলোর কোনও সিনেমার রেফারেন্স ছিল না (ফেলুদার ক্ষেত্রে সিনেমার রেফারেন্স ছিল)। ‘সানডে সাসপেন্স’-এ ফেলুদা করার আগে বিগ এফএম ফেলুদাকে নিয়ে ২টো গল্প করেছিল। ছোটগল্প নিয়ে তিনি নিজেই ‘সত্যজিৎ রায় প্রেজ়েন্টস’ বলে একটা সিরিজ় করেছিলেন। যদিও সেভাবে কেউ দেখেননি বা শোনেননি। ফলে সেই ইন্টারপ্রিটেশনটা অন্তত পরিচালক হিসেবে খুব ইন্টারেস্টিং আমার কাছে ব্য়ক্তিগতভাবে। কিন্তু এই ছোটগল্পগুলো, ‘রতনবাবু আর সেই লোকটা’, ‘খগম’ এই গল্পগুলো কিন্তু লোকে আগে কখনও দেখেনি, এখনও দেখেনি। ভবিষ্যতে হয়তো দেখবে যখন বিভিন্ন ওটিট প্ল্যাটফর্মে এই গল্পগুলো নিয়ে কাজ করা হবে। কিন্তু আমরা যখন এগুলো নিয়ে কাজ করেছি, তার আগে এগুলো ছিল না। এমনকী তারিণীখুড়োরও কোনও রেফারেন্স ছিল না। পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে তারিণীখুড়ো রূপে অডিয়োতে আবিস্কার করা এবং ঠিক এটা মনে হওয়া যে, আজ যদি সত্যজিৎ তারিণীখুড়ো নিয়ে ছবি বানাতেন, তাহলে ওঁকেই কাস্ট করতেন (যদিও সন্দীপ রায় পরবর্তীতে নিয়েছিলেন)… এই ইম্প্রোভাইজ়েশনগুলো আমার কাছে স্পেশ্যাল।

 

প্রশ্ন ৫: ‘সাউন্ডস্কেপ’—অডিওবুক বা অডিওড্রামার ক্ষেত্রে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এই ‘সাউন্ডস্কেপ’। কখনও মনে হয়েছে সত্যজিতের লেখার স্টাইলের পরতে-পরতে মিশে আছে অদৃশ্য এই আবহসঙ্গীত? যেটা ‘রেডিওতে গল্প পড়া’-টাকে ‘ড্রামাটাইজ়’ করার ক্ষেত্রে অনুঘটকের মতো কাজ করেছে?
ইন্দ্রাণী: এটা ঠিক যে ওঁর খেরোর খাতায় উনি যেভাবে ডিটেইলিং করতেন সবকিছুর (চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে বিশেষ করে), সেটা কখনও পরিবেশের, কখনও কোনও চরিত্রের লুক অ্যান্ড  ফিলের ক্ষেত্রে এবং অফকোর্স তার যে আবহটা, সেটা থাকার ফলেই আবহসঙ্গীতটা তৈরি করাটা খুব সহজ হয়ে গিয়েছে। সত্যজিৎ বেঁচে থাকাকালীন ওঁর একটা গল্প রেডিয়োতে নাটক হয়েছিল (এই গল্পটা আমরা শ্রদ্ধেয় জগন্নাথ বসুর কাছ থেকে শুনেছি) এবং ওঁর একটি বইও আছে এ নিয়ে। সেখানে ‘সেপ্টোপাসের খিদে’ তৈরি হওয়ার পিছনে যে গল্পটা আছে, সেটা উনি খুব সুন্দরভাবে বর্ণনা করেছেন। জগন্নাথদা (বসু) গল্পটিকে রেডিয়ো-রূপ দেওয়ার আগে সত্যজিতের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। প্রথমে খুব অল্প সময়ের জন্য সত্যজিতকে পাবেন বলে মনে করলেও রায়বাবু অনেকটাই সময় দিয়েছিলেন এবং বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে, আবহতে সবসময় যে মিউজ়িক (Music) বা সাউন্ড এফেক্টস (Sound Effects) লাগে, তা নয়। সাইলেন্স, পজ়, গ্য়াপের একটা বিরাট ভূমিকা আছে। এবং সেখান থেকেই ড্রামাটা আরও সুন্দরভাবে তৈরি করা যায়। এটা একটা বিরাট শিক্ষা। ‘সেপ্টোপাসের খিদে’ একটা অসাধারণ গল্প। এটা ‘এক ডজন গল্প’-এর প্রথম গল্প যেটা দিয়ে আমাদের অডিয়োবুক প্রজেক্টও (Audiobook Project) শুরু হয়। সম্ভবত ৭০-এর দশকে গল্পটা আকাশবাণীতে হয়েছিল। কিন্তু আমরা যখন করেছি, তখন সময় অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছে। হাতে তখন সাউন্ড এফেক্টস-এর জন্য নতুন টেকনোলজি এসেছে। নতুন সফটওয়্যার এসেছে। নানা ধরনের মিউজ়িক নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করারও সুযোগ এসেছে। রিচার্ড (সাউন্ড ডিজ়াইনার)-ও খুব অভিনবভাবে তাঁর আবহটা ব্যবহার করতে পেরেছে। তার মানে সত্যজিতের লেখনীর মধ্যেই এই জিনিসটা ছিল বা আছে। একটা বিশেষ গল্পের কথা বলতে পারি, যেটা পড়ে তো মজা লাগেই। কিন্তু আমার মনে হয় শুনে আরও মজা লাগে—যদিও এভাবে দাবি করাটা সমীচীন হচ্ছে কি না, জানি না—তবু এই দাবিটা করতে পারি। গল্পটার নাম ‘ব্রাউন সাহেবের বাড়ি’। এই গল্পের শেষ দৃশ্যে সাইমনের আবির্ভাব এবং সাইমনকে দেখে ব্রাউন সাহেবের সেই বিখ্যাত ভুতুড়ে হাসি। এই ব্যাপারটা তো সত্যজিতের লেখায়, তাঁর বর্ণনাতেই ছিল… আমরা যখন অডিয়ো মাধ্য়মে সেটা করছি, তখন সেই পিলে-চমকানো হাসি অডিয়োর মাধ্য়মে রিক্রিয়েট করা গিয়েছে। এবং যাঁরা এই গল্পটা প্রথমবার রাত্তিরে শুনেছেন, তাঁদের কাছ থেকে দারুণ সব ফিডব্যাক পেয়েছিলাম। আসলে নিজের লেখায় অডিয়োস্কেপ-এর সেই প্রভিশনটা তিনি এমনভাবে তৈরি করে গিয়েছেন যেন পুরোটাই স্টোরি-বোর্ডের মতো। ফলে যিনি রিক্রিয়েট করছেন, তাঁকে শুধু মিউজ়িক আর প্রয়োজনীয় সাউন্ড এফেক্টস বসিয়ে দিতে হবে। তাহলেই হবে।

 

নিজস্ব চিত্র

 

প্রশ্ন ৬: রেডিও… সিডি… ইউটিউব… এই যে তিনটে ভিন্ন ফর্ম-এ ছোটগল্পকার ‘রে’ ধীরে-ধীরে গ্লোবাল বাঙালির কাছে ছড়িয়ে গেলেন ‘সানডে সাসপেন্স’-এর সৌজন্যে—এই জার্নি বা বহমানতাটাকে সত্যজিৎ-জন্মশতবর্ষে কীভাবে দেখছেন?
ইন্দ্রাণী: অনুষ্ঠানটি প্রথম ২০০৯-এ শুরু হয় এবং কিছুদিনের মধ্যেই অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। কয়েক বছরের মধ্যেই সিডি প্রকাশিত হয়। সিডিও পাইরেটেড হতে শুরু করে। একথাও শুনেছিলাম যে আইটি সেক্টরের কর্মীদের কেউ-কেউ পাইরেটেড ভার্সান আপলোড করছেন ইউটিউবে। এবং নানাভাবে গ্লোবাল বাঙালির কাছে তা ছড়িয়ে পড়ছে। সত্যি কথা বলতে কী, এগুলো রায়বাবুর লেখা, তাঁর লেখার টানেই সম্ভব হয়েছ। আমি এখনকার যে প্রজন্ম, যে শিল্পীরা এই অডিয়োস্টোরির সঙ্গে এখন যুক্ত, তাঁরা নিঃসন্দেহে খুব ভাল কাজ করছেন। কিন্তু আমি বিশেষ করে মীর, দীপ, রিচার্ডের কথা বলব, কারণ এই গ্লোবাল আবেদনের পিছনে এই ‘ট্রায়ো’-র ভূমিকা এবং অবদানের কথা আলাদা করে বলতেই হয়।

 

 

প্রশ্ন ৭: সত্যজিৎ তাঁর ছোটগল্প ও সাহিত্য় ‘রেডিয়োতে গল্প পড়া’-র ফর্ম্যাটে শুনে যেতে পারলেন না। উনি আজ বেঁচে থাকলে ওঁকে কোন পাঁচটা ছোটগল্প শোনাতেন?
ইন্দ্রাণী: ‘খগম’ অবশ্যই আমার অলটাইম ফেভারিট, যদিও কাফকার ‘মেটামরফোসিস’-এর সঙ্গে গল্পটার তুলনা করা হয়। আমি অডিয়ো প্রেজ়েন্টেশনটাই ওঁকে শোনাতে চাইতাম।
তবে নির্দিষ্ট করে পাঁচটা বলতে হলে বলব:
‘রতনবাবু আর সেই লোকটা’, আজ অব্দি যেটা ছবির পর্দায় অথবা অন্য কোনও ফর্ম্যটে দেখিনি।
‘প্রফেসর হিজবিজবিজ’। খুবই মজার, বিনোদনমূলক একটা গল্প।
‘অসমঞ্জবাবুর কুকুর’।
তারিণীখুড়োর যে কোনও একটি গল্প।
প্রফেসর শঙ্কুর যে কোনও একটি গল্প।

অলঙ্করণ: অভিজিৎ বিশ্বাস

প্রশ্ন ১: ৪৪ মিনিট ১১ সেকেন্ড দৈর্ঘ্যের অডিয়োবুক ‘খগম’ যখন প্রথমবার শোনা গিয়েছিল রেডিও মির্চি ৯৮.৩ এফএম (এখন মির্চি ৯৮.৩)-এ, তখন ২২তম সেকেন্ডে মির্চি দীপের গলায় শোনা গিয়েছিল: “সত্যজিৎ রায়ের লেখা রোমাঞ্চকর কিছু গল্প দিয়ে সাজানো আমাদের এই বিশেষ নিবেদন ‘সানডে সাসপেন্স’ (Sunday Suspense)। আজকের গল্প ‘খগম’।” সত্যজিৎ-জন্মশতবর্ষে প্রথমেই যেটা জিজ্ঞেস করার সেটা হল, অডিয়োবুকের (Audiobook) মাধ্যমে ‘রে’-কে বাঙালি শ্রোতার কাছে ছড়িয়ে দেওয়ার ভাবনার গোড়ায় কী ছিল: সত্যজিৎ-পড়া বাঙালির কাছে ‘রে’-কে নতুন প্যাকেজিংয়ের মাধ্যমে তুলে ধরা নাকি সত্যজিৎ না-পড়া বাঙালির কাছে ‘রে’-কে পৌঁছে দেওয়া?
ইন্দ্রাণী:
সেভাবে ভেবে দেখতে গেলে হয়তো দু’টোই। কিন্তু যদি জিগ্যেস করা হয়, আগে কোন চিন্তাটা কাজ করেছে, তাহলে অবশ্যই বলব সত্যজিৎ না-পড়া বাঙালির কাছে ‘রে’-কে পৌঁছে দেওয়া বা তুলে ধরা। শুধু তাই-ই নয়, গোড়ার যে ভাবনাটা—যেখান থেকে ‘সানডে সাসপেন্স’ (Sunday Suspense)-এর মতো একটা অডিওবুক (Audiobook) বা অডিওড্রামা (Audiodrama) প্রেজ়েন্টেশনের ভাবনা—সেটা হল, বই পড়াটা কমে গিয়েছে। বাঙালি গল্পের বই পড়ছে না। বাংলাতে একটা অসাধারণ ছোটগল্পের সম্ভার রয়েছে। কিন্তু সাহিত্যের সঙ্গে আমাদের ইয়ং জেনারেশন—নতুন প্রজন্ম—তাদের পরিচয় নেই। তাদের কাছে নতুন কিছু একটা তুলে ধরা যায় কি না। এবং যদি সাহিত্য—বাংলা সাহিত্যকে—তুলে ধরতেই হয়, তাহলে সত্যজিৎ দিয়েই হোক হাতেখড়িটা। বলাই বাহুল্য, যারা বাংলা গল্প পড়তে ভালবাসে এবং পড়ে, সেই ৮ থেকে ৮০ সবার কাছেই সত্যজিৎ যেহেতু সমান প্রিয়, তাই অডিয়োর মাধ্যমেও তাদের কাছেও হয়তো সত্যজিৎ জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পারবেন। এ বার যারা জানে না—বিশেষত একটা বিপুল সংখ্যক ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে-পড়া ছেলেমেয়েরা—যারা হয়তো বাংলা বই পড়ে না বা বাংলা বই পড়তে যাদের অসুবিধে হয়, যে মুহূর্তে সেটাকে অডিয়ো মাধ্য়মে প্রেজ়েন্ট করছি, তাকে গল্পটা পড়ে শোনাচ্ছি, তার কাছে সেটা অনেক বেশি অ্যাক্সেসবল হয়ে যাচ্ছে। তাই-ই আমি বলব প্রথম ভাবনার দিক থেকে অবশ্যই যারা বাংলা বই পড়ে না বা সত্যজিৎ-সৃষ্ট সাহিত্যের সঙ্গে যারা পরিচিত নয়, তাদের কাছে সত্যজিতকে তুলে ধরাটাই অবশ্যই মূল ভাবনা। এবং যারা বাংলা বই পড়ে এবং সত্যজিতের সাহিত্যের সঙ্গে পরিচিত, তাদের কাছে নতুন মোড়কে—অডিয়োর মাধ্যমে—প্রেজ়েন্ট করা যাতে তারা নতুন করে আবিস্কার করতে পারে সত্যজিতকে, সেটাও একটা ভাবনা হিসেবে অবশ্য়ই ছিল। গল্প শুনতে কে না ভালবাসে? গল্প যদি না-ও পড়ি—বই পড়ার অভ্যেস যদি না-ও থাকে (নেশা তো ছেড়েই দিলাম)—সেক্ষেত্রেও সত্যজিতের গল্প কিন্তু একটা ড্রাগ-এর মতো কাজ করতে পারে। নেশা ধরিয়ে দিতে পারে। এবং সম্ভবত সেটাই হয়েছে পরবর্তীকালে।

 

আরও পড়ুন: রহস্য রোমাঞ্চের জগতে ভাটা! কোভিড আক্রান্ত হয়ে প্রয়াত সাহিত্যিক অনীশ দেব

 

 

প্রশ্ন ২: রবিবারের দুপুরে এফএম-এর পরিচিত ফর্ম্যাটের বাইরে বেরিয়ে এসে বাঙালিকে ‘রে’ শোনানো। ‘শোনানো’ শব্দটার উপর বিশেষ করে জোর দিচ্ছি, কারণ ‘রে’-কে ‘শোনা’য় বাঙালি সেভাবে অভ্যস্ত ছিল না একেবারেই। ‘রে’-কে নিয়ে এ হেন এক্সপেরিমেন্ট করার আগে মনে হয়নি পান থেকে চুন খসলেই রে-রে করে তেড়ে আসবে শহুরে, শিক্ষিত-মধ্যবিত্ত বাঙালি?
ইন্দ্রাণী: এখন যদি ভেবে দেখি—এই অনুষ্ঠানটি শুরু হওয়ার প্রায় এক যুগ পর—তাহলে নিশ্চয়ই মনে হয় যে, খানিকটা দুঃসাহস হয়তো দেখিয়েই ছিলাম আমরা সে সময়। কিন্তু মনে হয়নি যে পান থেকে চুন খসলেই বাঙালি রে-রে করে তেড়ে আসবে কারণ এটা এক্কেবারে গঙ্গাজলে গঙ্গাপুজোর মতোই একটা কাজ হয়েছিল। আমরা কিন্তু সত্যজিতের ছোটগল্পকে ‘অ্যাডাপ্ট’ করিনি অথবা নতুন চিত্রনাট্য বা শ্রুতিনাটক হিসেবে উপস্থাপনা করিনি। আমি যখন রেডিয়োর জন্য এই ভাবনাটা ভাবি, তখন কিন্তু সেটাকে অডিয়োবুক ফর্ম-এই রাখা হয়েছিল। গল্পটা যেমন রয়েছে, তার ভাষা যেমন রয়েছে, একেবারে প্রথম শব্দটা থেকে শেষ দাঁড়িটা পর্যন্ত, সব কিছু হুবহু একভাবে রাখা হয়েছে। একটা কমা, দাঁড়িও আলাদা করে বসাতে হয়নি। যেটা করা হয়েছিল, সেটা হল, অভিনয়ের মাধ্য়মে লেখাগুলোকে একটা অন্য় মাত্রা দেওয়া বা ‘এনহ্যান্স’ করা হয়েছে। নাটকীয়তা আনা হয়েছে। এবং সর্বোপরি যেটা আকর্ষণীয় সবার কাছে, সেটা হল একটা সাউন্ড ডিজ়াইনের (Sound Design) মাধ্যমে চলচ্চিত্রকার সত্যজিতের ছোটগল্পগুলোকে বেতারে সিনেমার রূপ দেওয়া হয়েছে। ফলে লোকে তেড়ে তো আসেইনি বা মনেও হয়নি যে তাঁরা তেড়ে আসতে পারেন কারণ সত্যজিতের উপর কলম চালানোর ধৃষ্টতা তো আমরা কেউ দেখাইনি। কিন্তু তাঁর ভিতরের যে ভাবনাগুলো, সেগুলোকে আমরা নিশ্চয়ই ‘ইন্টারপ্রেট’ করার চেষ্টা করেছি অভিনয়ের মাধ্যমে, মিউজ়িকের মাধ্যমে, সাউন্ড এফেক্টসের মাধ্যমে। কিন্তু যেটা হয়েছে—অর্থাৎ আগে যেটা বললাম—সেটা হল গঙ্গাজলে গঙ্গাপুজো। তাঁর লেখা এতটাই নিঁখুত যে একেবারেই হাত দিতে হয়নি। এবং চিত্রনাট্যটা যেন তৈরিই ছিল এবং অডিয়ো (Audio)-র জন্যই তৈরি ছিল। ফলে ওই টেনশনটা ছিল না। যারা সত্য়জিতের লেখা সম্পর্কে জানেন না, তাদের কাছে এটা তাই-ই সম্পূর্ণ একটা নতুন স্বাদ বয়ে আনল। যেন একটা সম্পূর্ণ নতুন জগৎ খুলে গেল। আর যাঁরা পরিচিত, যাঁরা ছোটবেলা থেকে সত্যজিৎ-সাহিত্য পড়ে বড় হয়েছেন, যাঁরা তাঁর সব গল্প মুখস্থ বলতে পারেন, তাঁরা গল্পগুলো নতুন করে আবিস্কার করতে পারলেন।

 

 

 

 

নিজস্ব চিত্র

 

প্রশ্ন ৩: এই যে সত্যজিৎ না-পড়া বাঙালির কাছে রে‘-কে পৌঁছে দেওয়া এবং ধীরে-ধীরে সেই শ্রোতাকে তাঁর গল্পের প্রতি অ্যাডিক্টকরে তোলা… প্রক্রিয়াটা যখন চলছে, তখন এটা কখনও মনে হয়েছে যে সত্যজিতের লিখনশৈলী এতটাই স্বয়ংসম্পূর্ণ যে বইয়ের পাতা থেকে রেডিয়োতে—যে রেডিয়োকে থিয়েটার অফ দ্য মাইন্ডবলা হয়—ট্রান্সফর্মডহওয়ার ক্ষেত্রে ওঁর সাহিত্য খুব সহজেই প্ল্যাটফর্ম বদল করে নিতে পারে? মানে বই থেকে সিনেমা… বই থেকে রেডিয়ো… রে‘-র গল্প বলার স্টাইলটা এতটাই স্বকীয় অথচ সহজ যে ওঁর লেখা নিয়ে বারবার কাজ করা যায়?
ইন্দ্রাণী: এটা একদম ঠিক কথা যে সত্যজিতের লেখা এতটাই স্বয়ংসম্পূর্ণ, যে বইয়ের পাতা থেকে রেডিয়োতে তুলে আনতে কোনওই অসুবিধে হয়নি। হয়তো সে কারণেই রেডিয়োতে এটা করার কথা মাথায় এসেছিল। বাংলায় তো অডিয়োবুক-এর চল ছিল না সেরকমভাবে কখনওই। বেতার-নাটকের (Radio Drama) কথা আমরা অনেকেই বা সকলেই জানি। যদিও সেটা ৫০, ৬০, ৭০-এর দশকে অনেক বেশি জনপ্রিয় ছিল। তারপর বেতার-নাটকের ব্যাপারটা অনেকটাই কমে যায়। নাটক না-বলে আমি বলি রেডিয়োতে এই প্রথম বই পড়ার মজা। ‘বই পড়া’—এটা কিন্তু এই অনুষ্ঠানের শুরুতে প্রথম থেকেই বলা ছিল। সাহিত্য থেকে নিয়ে শ্রেষ্ঠ কিছু গল্পকে তুলে ধরা হচ্ছে। সেক্ষেত্রে এ কথা একেবারেই সত্যি যে অডিয়োর জন্য আলাদা করে কোনও স্ক্রিপ্ট করার প্রয়োজন কোনও দিনই মনে হয়নি। এবং সবথেকে যেটা ইন্টারেস্টিং জিনিস—বিশেষ করে আমি ওঁর ছোটগল্পের কথা বলতে চাই (ফেলুদার কথা বলছি না কারণ ফেলুদা নিয়ে প্রচুর কথা হয়েছে এবং হয়)—যেহেতু উনি মূলত ফিল্ম-মেকার, সেহেতু যেটা হয়েছে, ওঁর লেখাও কিন্তু ছবির চিত্রনাট্যের মতো এগিয়েছে। কিছুই না, যদি গল্পটাকে একটু সুন্দর করে পড়া যায়, তাহলেই কিন্তু একটা অপূর্ব ছবি চোখের সামনে সিনেমার মতো রোল করতে শুরু করবে। এবং আমরা যারা রেডিয়ো শেখেছি এককালে, তাদের একটা কথা বলা হত ‘রেডিও মেকস বেস্ট পিকচার্স’। মানে কল্পনাশক্তি দিয়ে ছবি আঁকা—এটা রেডিয়োর থেকে ভাল কেউ করে না। ‘রেডিও ইজ় দ্য থিয়েটার অফ দ্য মাইন্ড’—অর্থাৎ কেউ চোখ বন্ধ করে আছেন আর গোটা একটা নাটক ধীরে-ধীরে উন্মোচিত হচ্ছে, এমনটা যদি হয়, তাহলে সেটাকে সত্যজিৎ একেবারে হাড়েহাড়ে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর লেখনীর মাধ্যমে। আমি একাধিক উদাহরণ দিতে পারি যেখানে প্ল্যাটফর্মটা বদল হচ্ছে ঠিকই—অর্থাৎ বইয়ের পাতা থেকে অডিয়োতে যাচ্ছে এবং অডিয়োয় একটা সিনেমা হয়ে সেটা ফুটে উঠছে—কিন্তু অন্য় লেখকদের সব গল্পের ক্ষেত্রে আমি হয়তো এতটা জোর দিয়ে বলতে পারব না। সত্যজিতের গল্পের ক্ষেত্রে আমি একশোবার বলতে পারি ‘পারফেক্ট থিয়েটার অফ দ্য মাইন্ড’। ফলে ওঁর লেখা ছোট গল্প নিয়ে বারবার, একশোবার নিশ্চয়ই কাজ করা যায়।

 

 

 

নিজস্ব চিত্র

 

প্রশ্ন ৪: ছোটগল্প, ফেলুদা, প্রফেসর শঙ্কু, তারিণীখুড়ো, সত্যজিৎ-অনূদিত সাহিত্য—সানডে সাসপেন্স‘-রেফিরে-ফিরে এসেছেন বিভিন্ন রূপে। এই যে বারবার রে‘-কে পুনরাবিষ্কার করা, সেটার ক্ষেত্রে তো ভীষণ জরুরি হল ওঁর ডিটেইলিংয়ের প্রতি ষোল আনার পরিবর্তে আঠেরো আনা যত্নশীল থাকা… টেক্সটে যেটা সহজে লেখা যায়, হুবহু সেটা উদ্ধৃত করে অডিয়োবুকে তুলে দেওয়া যায় না এবং উচিতও নয়। সেক্ষেত্রে ইম্প্রোভাইজ়েশনকতটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল নাট্য-রূপান্তর এবং ন্যারেশন‘-এর ক্ষেত্রে? সেরা ইম্প্রম্পটুরি-অ্যাকশনের কয়েকটা স্মৃতি (পরিচালক হিসেবে আপনার এবং আরজে-দের) যদি শেয়ার করেন…
ইন্দ্রাণী: ফেলুদা, শঙ্কুর একটা বিশাল শ্রোতা-দর্শক সবই আছে। আমি বিশেষ করে ছোটগল্প এবং তার সঙ্গে তারিণীখুড়োর কথা আলাদাভাবে উল্লেখ করতে চাই। প্রথম একটা বছর, প্রায় ৫২টা ছোটগল্প নিয়ে ‘সানডে সাসপেন্স’ অনুষ্ঠানটা সাজানো হয়েছিল। সেখানে সত্যি কথা বলতে যেটা আগেও বললাম, একটা শব্দকেও উনিশ-বিশ করতে হয়নি কারণ সত্যজিতের ডিটেইলিং এতটাই নিখুঁত। আমাদের যেটা চ্যালেঞ্জ ছিল সেটা হল, উই হ্যাড টু ডু জাস্টিস টু দ্য টেক্সট উইথ দ্য হেল্প অফ মিউজ়িক অ্যান্ড অ্যাক্টিং। সেইজন্য আমি যেটা বললাম যে আমার কতগুলো গল্পকে নতুন করে আবিস্কার করেছি। দু’-একটা উদাহরণ দিচ্ছি, যেটার ক্ষেত্রে ডিটেইলিং এবং ইম্প্রোভাইজ়েশন ভীষণভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। যেমন ‘বঙ্কুবাবুর বন্ধু’, এটা সম্ভবত সানডে সাসপেন্স-এর দ্বিতীয় বা তৃতীয় গল্প ছিল। এই অর্ডারে কতগুলো গল্প পরপর হয়েছিল—’সেপ্টোপাসের খিদে’, ‘বঙ্কুবাবুর বন্ধু’, ‘ভূতো’… প্রত্যেকটা গল্পের ক্ষেত্রে—অভিনয় তো ছেড়েই দাও—সাউন্ডের একটা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। না-বলা যেটা, সেটাকে সাউন্ডের মাধ্যমে বলা বা ক্রিয়েট করার একটা বড় চ্যালেঞ্জ আমাদের সামনে ছিল। অভিনয়ের মাধ্যমে যতটা ক্যারেক্টারাইজ়েশন করতে হয়েছে, তার সঙ্গে ডিটেইলিংটা হয়েছে কিন্তু এই সাউন্ডের মাধ্যমে। তাই ‘বঙ্কুবাবুর বন্ধু’-র ক্ষেত্রে ইম্প্রোভাইজ়েশন যদি বলো, তাহলে সাউন্ডের মাধ্যমে ‘অ্যাং’-এর গলা তৈরি করা বা ‘প্রফেসর হিজবিজবিজ’-এর মতো একটি অত্যন্ত ইউনিক গল্প—পড়ে তো একরকম মজা লাগেই, কিন্তু শুনলে, অন্তত যাঁরা শুনবেন, ওটার একটা অন্য রস তাঁরা গ্রহণ করতে পারবেন। আজ যদি আমাকে কেউ বলে একটা গল্প যেটা অডিয়োস্টোরি হিসেবে আমার সবথেকে পছন্দ, তাহলে আমি বলব ‘রতনবাবু আর সেই লোকটা’। এই গল্পটার মধ্যে এমন একটা ম্যাজিক আছে, যে ম্যাজিকটা পাঠক হিসেবে আমি যখন পড়েছিলাম, তখন আবিস্কার করিনি। কিন্তু যখন শ্রোতা হিসেবে আমি শুনছি, তখন সেটা একটা ওয়ার্ল্ড ক্লাস গল্প হিসেবে আমার কাছে উন্নীত হয়েছে। গ্লোবাল স্ট্যান্ডার্ডের গল্প তো অনেকগুলোই… বিশেষ করে ছোটগল্পের কথা তো আমি বলবই। ‘ফ্রিৎস’, ‘রতনবাবু আর সেই লোকটা’, ‘বাতিকবাবু’—প্রত্যেকটা গল্পের যে চরিত্রায়ণ বা তার ডিটেইলিং, ওঁর টেক্সটের মধ্যে এতটাই রসদ রয়েছে যে, আমার কাজ ছিল পরিচালক হিসেবে অভিনয় করিয়ে নেওয়া। অত্যন্ত ভাল দু’জন অভিনেতা-ভয়েস অ্যাক্টরকে পেয়েছি—মীর (Mir Afsar Ali) আর দীপ (RJ Deep)—এবং সাউন্ড ডিজ়াইনের মাধ্যমে—ডিজে রিচার্ড (DJ Richard)। বিশেষ করে ‘খগম’—যেটা দিয়ে এই সাক্ষাৎকার শুরু হয়েছে—তার যে গায়ে কাঁটা দেওয়া, দমবন্ধ করা পরিবেশটা যে সৃষ্টি করা হয়েছিল, সেটা কিন্তু সাউন্ড এবং অভিনয়ের মিশেল। একইভাবে ‘রতনবাবু আর সেই লোকটা’, ‘প্রফেসর হিজবিজবিজ’, ‘নীল আতঙ্ক’ এই গল্পগুলোর ক্ষেত্রেও।
এটাতে আমার কৃতিত্ব যতটা না-আছে, তার চেয়েও বেশি মীরের মতো একজন দক্ষ ও প্রতিভাবান ভয়েস অ্যাক্টরের। যখন ‘প্রফেসর হিজবিজবিজ’ হচ্ছে, তার গলাটা কীরকম হতে পারে, তার যে শারীরিক যে বর্ণনাটা আছে, সত্যজিতই হাত ধরে দেখিয়ে দিয়েছেন, কিন্তু গলাটা কীরকম হতে পারে, সেটা তো একটু কল্পনা করে নিতেই হবে। ফলে সেইগুলো কিন্তু সম্পূর্ণ ইম্প্রোভাইজ় করা। অথবা ‘অ্যাং’-এর গলা তৈরির সময়… বা ‘ফার্স্ট ক্লাস কামরা’-র মতো একটা গল্প যেখানে একজন জলজ্যান্ত মানুষ সাহেব ভূত সেজে প্যাসেঞ্জারকে ভয় দেখাচ্ছে, সেইরকম জায়গায় ইম্প্রোভাইজ় করে ভূতকে সাহেবের গলায় কথা বলানো… এগুলো সম্পূর্ণই আমরা কল্পনার আশ্রয় নিয়ে করেছি এবং এসব ক্ষেত্রে অভিনেতার দক্ষতাটাই বেশি। আমরা কিছু ক্ষেত্রে নিশ্চয়ই আলোচনা করেছি। কিন্তু সেখানে মীর-দীপের মতো ভয়েস অ্যাক্টর থাকায় কাজটা অন্য পর্যায়ে পৌঁছেছে। সত্যজিতের বেশিরভাগ ছোটগল্পের ক্ষেত্রে মীর প্রাইম্য়ারি ন্যারেটর হিসেবে ছিল। প্রফেসর শঙ্কুর ক্ষেত্রে একচেটিয়া দীপ। সেখানে শঙ্কুর ব্যাক্তিত্বটাকে তুলে ধরাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল, কারণ তার আগে শঙ্কুর কোনও অডিও রেফারেন্স ছিল না। শঙ্কুকে বইয়ের পাতায় এবং কমিকস-এর পাতাতেই লোকেরা পড়েছে, দেখেছে। সিনেমা তো হালের ঘটনা। তাই শঙ্কুকে একটা প্রাণ দেওয়ার কাজটা অনেকটাই হয়েছে দীপের হাত ধরে। এটা আসলে একটা টিম গেম।

 

নিজস্ব চিত্র

 

 

আমি বারবার ফিরে যাই সত্যজিতের ছোটগল্পের কাছে, তারিণীখুড়োর কাছে। ছোটগল্পগুলোর ক্ষেত্রে আমার সবসময়ই মনে হয় সত্যজিতকে প্রথম সারির ছোটগল্পকারদের সঙ্গে এক সারিতে দাঁড় করানো যায়। এবং এই যে সত্যজিৎ-জন্মশতবর্ষে আমরা নানাভাবে তাঁকে সেলিব্রেট করছি, আমার মনে হয় যে অডিয়ো আর্কাইভটা তৈর হয়েছে ‘সানডে সাসপেন্স’-এর মাধ্যমে, নতুন প্রজন্ম যদি ছোটগল্পকার হিসেবে সত্যজিতের মূল্যায়ন করতে চায়-শুধুমাত্র ডিটেকটিভ গল্পকার বা সায়েন্স-ফিকশন গল্প রচয়িতা হিসেবে নয়, তাহলে অবশ্যই এই অডিয়োস্টোরিগুলো তাদের সাহায্য করবে এবং এগুলোই হয়ে উঠতে পারে ‘রে-দ্য় মাস্টার’কে চেনার ক্ষেত্রে ইন্ট্রোডাকশন।

 

 

 

যে গল্পগুলোর কথা এখানে বলা হচ্ছে, সেগুলোর ক্ষেত্রে আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক হল এই গল্পগুলোর কোনও সিনেমার রেফারেন্স ছিল না (ফেলুদার ক্ষেত্রে সিনেমার রেফারেন্স ছিল)। ‘সানডে সাসপেন্স’-এ ফেলুদা করার আগে বিগ এফএম ফেলুদাকে নিয়ে ২টো গল্প করেছিল। ছোটগল্প নিয়ে তিনি নিজেই ‘সত্যজিৎ রায় প্রেজ়েন্টস’ বলে একটা সিরিজ় করেছিলেন। যদিও সেভাবে কেউ দেখেননি বা শোনেননি। ফলে সেই ইন্টারপ্রিটেশনটা অন্তত পরিচালক হিসেবে খুব ইন্টারেস্টিং আমার কাছে ব্য়ক্তিগতভাবে। কিন্তু এই ছোটগল্পগুলো, ‘রতনবাবু আর সেই লোকটা’, ‘খগম’ এই গল্পগুলো কিন্তু লোকে আগে কখনও দেখেনি, এখনও দেখেনি। ভবিষ্যতে হয়তো দেখবে যখন বিভিন্ন ওটিট প্ল্যাটফর্মে এই গল্পগুলো নিয়ে কাজ করা হবে। কিন্তু আমরা যখন এগুলো নিয়ে কাজ করেছি, তার আগে এগুলো ছিল না। এমনকী তারিণীখুড়োরও কোনও রেফারেন্স ছিল না। পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে তারিণীখুড়ো রূপে অডিয়োতে আবিস্কার করা এবং ঠিক এটা মনে হওয়া যে, আজ যদি সত্যজিৎ তারিণীখুড়ো নিয়ে ছবি বানাতেন, তাহলে ওঁকেই কাস্ট করতেন (যদিও সন্দীপ রায় পরবর্তীতে নিয়েছিলেন)… এই ইম্প্রোভাইজ়েশনগুলো আমার কাছে স্পেশ্যাল।

 

প্রশ্ন ৫: ‘সাউন্ডস্কেপ’—অডিওবুক বা অডিওড্রামার ক্ষেত্রে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এই ‘সাউন্ডস্কেপ’। কখনও মনে হয়েছে সত্যজিতের লেখার স্টাইলের পরতে-পরতে মিশে আছে অদৃশ্য এই আবহসঙ্গীত? যেটা ‘রেডিওতে গল্প পড়া’-টাকে ‘ড্রামাটাইজ়’ করার ক্ষেত্রে অনুঘটকের মতো কাজ করেছে?
ইন্দ্রাণী: এটা ঠিক যে ওঁর খেরোর খাতায় উনি যেভাবে ডিটেইলিং করতেন সবকিছুর (চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে বিশেষ করে), সেটা কখনও পরিবেশের, কখনও কোনও চরিত্রের লুক অ্যান্ড  ফিলের ক্ষেত্রে এবং অফকোর্স তার যে আবহটা, সেটা থাকার ফলেই আবহসঙ্গীতটা তৈরি করাটা খুব সহজ হয়ে গিয়েছে। সত্যজিৎ বেঁচে থাকাকালীন ওঁর একটা গল্প রেডিয়োতে নাটক হয়েছিল (এই গল্পটা আমরা শ্রদ্ধেয় জগন্নাথ বসুর কাছ থেকে শুনেছি) এবং ওঁর একটি বইও আছে এ নিয়ে। সেখানে ‘সেপ্টোপাসের খিদে’ তৈরি হওয়ার পিছনে যে গল্পটা আছে, সেটা উনি খুব সুন্দরভাবে বর্ণনা করেছেন। জগন্নাথদা (বসু) গল্পটিকে রেডিয়ো-রূপ দেওয়ার আগে সত্যজিতের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। প্রথমে খুব অল্প সময়ের জন্য সত্যজিতকে পাবেন বলে মনে করলেও রায়বাবু অনেকটাই সময় দিয়েছিলেন এবং বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে, আবহতে সবসময় যে মিউজ়িক (Music) বা সাউন্ড এফেক্টস (Sound Effects) লাগে, তা নয়। সাইলেন্স, পজ়, গ্য়াপের একটা বিরাট ভূমিকা আছে। এবং সেখান থেকেই ড্রামাটা আরও সুন্দরভাবে তৈরি করা যায়। এটা একটা বিরাট শিক্ষা। ‘সেপ্টোপাসের খিদে’ একটা অসাধারণ গল্প। এটা ‘এক ডজন গল্প’-এর প্রথম গল্প যেটা দিয়ে আমাদের অডিয়োবুক প্রজেক্টও (Audiobook Project) শুরু হয়। সম্ভবত ৭০-এর দশকে গল্পটা আকাশবাণীতে হয়েছিল। কিন্তু আমরা যখন করেছি, তখন সময় অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছে। হাতে তখন সাউন্ড এফেক্টস-এর জন্য নতুন টেকনোলজি এসেছে। নতুন সফটওয়্যার এসেছে। নানা ধরনের মিউজ়িক নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করারও সুযোগ এসেছে। রিচার্ড (সাউন্ড ডিজ়াইনার)-ও খুব অভিনবভাবে তাঁর আবহটা ব্যবহার করতে পেরেছে। তার মানে সত্যজিতের লেখনীর মধ্যেই এই জিনিসটা ছিল বা আছে। একটা বিশেষ গল্পের কথা বলতে পারি, যেটা পড়ে তো মজা লাগেই। কিন্তু আমার মনে হয় শুনে আরও মজা লাগে—যদিও এভাবে দাবি করাটা সমীচীন হচ্ছে কি না, জানি না—তবু এই দাবিটা করতে পারি। গল্পটার নাম ‘ব্রাউন সাহেবের বাড়ি’। এই গল্পের শেষ দৃশ্যে সাইমনের আবির্ভাব এবং সাইমনকে দেখে ব্রাউন সাহেবের সেই বিখ্যাত ভুতুড়ে হাসি। এই ব্যাপারটা তো সত্যজিতের লেখায়, তাঁর বর্ণনাতেই ছিল… আমরা যখন অডিয়ো মাধ্য়মে সেটা করছি, তখন সেই পিলে-চমকানো হাসি অডিয়োর মাধ্য়মে রিক্রিয়েট করা গিয়েছে। এবং যাঁরা এই গল্পটা প্রথমবার রাত্তিরে শুনেছেন, তাঁদের কাছ থেকে দারুণ সব ফিডব্যাক পেয়েছিলাম। আসলে নিজের লেখায় অডিয়োস্কেপ-এর সেই প্রভিশনটা তিনি এমনভাবে তৈরি করে গিয়েছেন যেন পুরোটাই স্টোরি-বোর্ডের মতো। ফলে যিনি রিক্রিয়েট করছেন, তাঁকে শুধু মিউজ়িক আর প্রয়োজনীয় সাউন্ড এফেক্টস বসিয়ে দিতে হবে। তাহলেই হবে।

 

নিজস্ব চিত্র

 

প্রশ্ন ৬: রেডিও… সিডি… ইউটিউব… এই যে তিনটে ভিন্ন ফর্ম-এ ছোটগল্পকার ‘রে’ ধীরে-ধীরে গ্লোবাল বাঙালির কাছে ছড়িয়ে গেলেন ‘সানডে সাসপেন্স’-এর সৌজন্যে—এই জার্নি বা বহমানতাটাকে সত্যজিৎ-জন্মশতবর্ষে কীভাবে দেখছেন?
ইন্দ্রাণী: অনুষ্ঠানটি প্রথম ২০০৯-এ শুরু হয় এবং কিছুদিনের মধ্যেই অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। কয়েক বছরের মধ্যেই সিডি প্রকাশিত হয়। সিডিও পাইরেটেড হতে শুরু করে। একথাও শুনেছিলাম যে আইটি সেক্টরের কর্মীদের কেউ-কেউ পাইরেটেড ভার্সান আপলোড করছেন ইউটিউবে। এবং নানাভাবে গ্লোবাল বাঙালির কাছে তা ছড়িয়ে পড়ছে। সত্যি কথা বলতে কী, এগুলো রায়বাবুর লেখা, তাঁর লেখার টানেই সম্ভব হয়েছ। আমি এখনকার যে প্রজন্ম, যে শিল্পীরা এই অডিয়োস্টোরির সঙ্গে এখন যুক্ত, তাঁরা নিঃসন্দেহে খুব ভাল কাজ করছেন। কিন্তু আমি বিশেষ করে মীর, দীপ, রিচার্ডের কথা বলব, কারণ এই গ্লোবাল আবেদনের পিছনে এই ‘ট্রায়ো’-র ভূমিকা এবং অবদানের কথা আলাদা করে বলতেই হয়।

 

 

প্রশ্ন ৭: সত্যজিৎ তাঁর ছোটগল্প ও সাহিত্য় ‘রেডিয়োতে গল্প পড়া’-র ফর্ম্যাটে শুনে যেতে পারলেন না। উনি আজ বেঁচে থাকলে ওঁকে কোন পাঁচটা ছোটগল্প শোনাতেন?
ইন্দ্রাণী: ‘খগম’ অবশ্যই আমার অলটাইম ফেভারিট, যদিও কাফকার ‘মেটামরফোসিস’-এর সঙ্গে গল্পটার তুলনা করা হয়। আমি অডিয়ো প্রেজ়েন্টেশনটাই ওঁকে শোনাতে চাইতাম।
তবে নির্দিষ্ট করে পাঁচটা বলতে হলে বলব:
‘রতনবাবু আর সেই লোকটা’, আজ অব্দি যেটা ছবির পর্দায় অথবা অন্য কোনও ফর্ম্যটে দেখিনি।
‘প্রফেসর হিজবিজবিজ’। খুবই মজার, বিনোদনমূলক একটা গল্প।
‘অসমঞ্জবাবুর কুকুর’।
তারিণীখুড়োর যে কোনও একটি গল্প।
প্রফেসর শঙ্কুর যে কোনও একটি গল্প।

অলঙ্করণ: অভিজিৎ বিশ্বাস

Next Article