শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী না গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের আভাস– চণ্ডীপুর সোহমের জন্য কতটা কঠিন?

বিহঙ্গী বিশ্বাস | Edited By: ঋদ্ধীশ দত্ত

Mar 31, 2021 | 9:10 PM

বৃহস্পতিবার চণ্ডীপুরে নির্বাচন। ওই কেন্দ্রে তৃণমূল কংগ্রেসের তারকা প্রার্থী সোহম চক্রবর্তীর শেষ মুহূর্তের প্রচারের সাক্ষী ছিল TV9 বাংলা। স্টু দিয়ে ভাত আর গরমে ব্ল্যাকআউট... স্ত্রী তনয়ার ফোন এলে 'পরে করছি'... আরও অনেক কিছুই বন্দি হল ক্যামেরার লেন্সে। কী-কী উঠে এল?

শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী না গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের আভাস-- চণ্ডীপুর সোহমের জন্য কতটা কঠিন?
পথে প্রচারে।

Follow Us

“সে তো অসুস্থ হেইকি কলকাতা যাইথিলা, আবার এটকু আইলা কেবে?”– চণ্ডীপুরে ঢোকার মুখেই সংবাদমাধ্যমের গাড়ি দেখে প্রশ্ন করলেন স্থানীয় বাসিন্দা মিতালি জানা। (মিতালি জানা স্থানীয় ভাষায় যা বলেছেন, তার বাংলা তর্জমা: সে তো অসুস্থ হয়ে কলকাতা গিয়েছিল। ফিরল কবে? ) তারপর দূর থেকে সোহম চক্রবর্তীর প্রচারের গাড়ি দেখতে পেয়েই ছুট দিলেন বছর পঞ্চাশের মহিলা… পিছনে তখন ভিড় করেছে তারকা ক্যারিশ্মায় বোল্ড হওয়া আরও পঁচিশ জোড়া পা।

বৃহস্পতিবার চণ্ডীপুরে নির্বাচন। ওই কেন্দ্রে তৃণমূল কংগ্রেসের তারকা প্রার্থী সোহম চক্রবর্তীর শেষ মুহূর্তের প্রচারের সাক্ষী ছিল TV9 বাংলা। স্টু দিয়ে ভাত আর গরমে ব্ল্যাকআউট… স্ত্রী তনয়ার ফোন এলে ‘পরে করছি’… আরও অনেক কিছুই বন্দি হল ক্যামেরার লেন্সে। কী-কী উঠে এল?

 

সাদা কুর্তা, সাদা পাজামা– চণ্ডীপুর বাজারে প্রথম দেখা মিলল সোহমের। সে দিনের প্রচার শুরু সেখান থেকেই। ভিড় জমে গিয়েছিল নিমেষেই। তার মধ্যে ছোট মাথার সংখ্যাও অনেক। বলাই বাহুল্য, তারা ভোটার নয়। “কেন এসেছ?” জিজ্ঞেস করতেই সটান উত্তর, “সোহমদাদার বই খুব ভাল লাগে।” চণ্ডীপুর সেজেছে ভালই। পাশেই হটস্পট নন্দীগ্রাম। উত্তাপ পৌঁছেছে সেখানেও। শহর ছেড়ে খানিক ভিতরে ঢুকতেই ‘নিজের মেয়ে…’ পোস্টারের পাশে জ্বলজ্বল করছে সোহমের নাম। ঝুলছে জোড়া ফুলের পতাকা, ফেস্টুন।

গ্রামের ভিতরে বড় গাড়ি ঢোকে না। দু’পাশে পুকুর আর সরু রাস্তায় সোহমের তখন ভরসা বাইক। সঙ্গে স্লোগান, “সোহম চক্রবর্তী অমর রহে।” তা শুনে বাইকবাহিনীরই এক বছর কুড়ির টিপ্পনি, “দাদা যে বেঁচে!”

 

বাইক যত ভেতরে ঢুকতে শুরু করে, ভিড়ও বাড়তে থাকে পাল্লা দিয়ে। চেনা তারকাকে সামনা-সামনি দেখার বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস আর করতালিতে চণ্ডীপুরে তখন ‘পুজোর আমেজ’। স্থানীয় এক মন্দিরে আয়োজন করা হয়েছিল সভার। মাইক ছিল না। অথচ উপস্থিত ছিলেন জনা তিনশো। স্থানীয় এক তৃণমূল নেতা জনগণের উদ্দেশে প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন, “সোহম চক্রবর্তীকে দেখতে এসেছেন নাকি তৃণমূল কংগ্রেসে ভোট দেবেন বলে এসেছেন?”… ঘোলাটে চোখ, ঝুলে যাওয়া চামড়া, চওড়া লাল সিঁথির সদ্য বিবাহিত মুখেদের মধ্যে তখন চোরচাপা গুঞ্জন।

উত্তর দিলেন সোহম নিজেই। মাইক ছাড়াই বলতে শুরু করলেন, “তারকা নই, অভিনেতা নই, আমি সোহম, আপনাদের ঘরের ছেলে… ভোট দেবেন তো আমায়? দেবেন তো ভোট?” এ বার ভিড়ের মধ্যে সমস্বরে আওয়াজ উঠল, “হ্যাঁ-এ-এ-এ, দেব…”

 

সূর্য তখন মধ্যগগনে। ঝলসে যাচ্ছে গোটা অঞ্চল। সোহমের সাদা কুর্তায় তখন ক্লান্তির ঘাম। চলছে হাত মেলানো, হাসিমুখে সেলফির আবদার মেটানো… চলছিল সবই…। বেলা তিনটে নাগাদ অভিনেতা ফিরলেন চণ্ডীপুরে নিজের অস্থায়ী ঠিকানায়… ফ্রেশ হয়ে জলের মতো চিকেনের হাল্কা স্টু দিয়ে ভাত খেয়েই সেরে ফেললেন দু’-তিনটে জরুরি ফোন। স্ত্রী তনয়া ফোন করেছিলেন বেশ কয়েক বার, ধরতে পারেননি। ছোট ছেলের জন্মদিনের দিনও চণ্ডীপুরে প্রচারে ছিলেন তিনি। মাঝে শরীর খারাপ নিয়ে হাসপাতালেও ভর্তি হতে হয়েছিল তাঁকে। সোহম যখন ভাত মাখছেন, তখন বাড়ির বাইরে আকাশ ফাটান ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি দিতে-দিতে বেরিয়ে গেল বেশ কয়েকটি লরি।

খাওয়া শেষ হতেই আবার ‘পরিভ্রমণ’। হাতে সময় কম। হাতের তালুর মতো চিনে ফেলতে হবে সমস্ত ওয়ার্ড। সোহমের এক ঘনিষ্ঠ এরই মধ্যে চুপিসারে বলে গেলেন, “মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিল একটু আগে। বললাম, আজ বাদ দাও। শুনছে না।”

সোহম এর আগেও নির্বাচনে দাঁড়িয়েছেন। ২০১৬-র বিধানসভা নির্বাচনে মাত্র ৬১৫ ভোটে সিপিএম প্রার্থীর কাছে হেরে গিয়েছিলেন তিনি। সে কারণেই কি এ বার গোড়া থেকেই মাটি কামড়ে তিনি? নাকি রয়েছে অন্য কারণ? সোহমকে জিজ্ঞাসা করতেই তাঁর উত্তর, “এ অস্তিত্বের লড়াই।” এ বারে চন্ডীপুরে বিজেপি প্রার্থী পুলককান্তি গুড়িয়া। অন্যদিকে সংযুক্ত মোর্চার তরফে এই কেন্দ্রে দাঁড়িয়েছেন সিপিআইএমের আশিস গুছাইত। স্থানীয়দের বক্তব্য অনুযায়ী, প্রচারের নিরিখে  কম যান না বাকি দু’জনও। জোড়াফুলের পাশাপাশি গোটা চন্ডীপুর ছেয়েছে অন্য দুই দলের ব্যানারেও। ৪০% মহিলা ভোটার রয়েছে চন্ডীপুরে। স্থানীয় সূত্র বলছে, দল  নির্বিশেষে এবারের ‘ভোটব্যাঙ্ক’ তাঁরাই।

 

ওই দিনই দ্বিতীয় ধাপের প্রচারে আবারও সোহমের সঙ্গী বাইক। গন্তব্য চউখালি। সোহমের সঙ্গে বাউন্সার একজন। আর স্থানীয় এক নেতা গোছের ভদ্রলোক। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, চণ্ডীপুরে সোহম আসার পর থেকে অভিনেতার অলিখিত ‘গারজিয়ান’ তিনিই। স্থানীয় মানুষ। বয়স বছর পঞ্চাশ। সোহম কোথায় যাবেন, এরপর কী কী প্ল্যান রয়েছে, তদারকির অনেকটা দায়িত্ব তাঁরই উপর।
অলিগলি রাস্তা দিয়ে যেতে-যেতেই চোখ আটকে গেলে প্রকাণ্ড এক সাদা বাড়ির উপর। চণ্ডীপুরের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এই বাড়ি কার? জানা গেল, চণ্ডীপুরের বর্তমান বিধায়ক অমিয় ভট্টাচার্যর। সোহমের এই ধাপের প্রচারে তিনিও সঙ্গে যাবেন।

বিকেলের প্রচারে জায়গাটা তুলনামূলক বড়। লোকও হয়েছিল ভালই। সোহমকে বরণ করে নেওয়া হল। শাঁখে ফুঁ দিলেন মহিলারা। না, সোহম নয়, অমিয়বাবুই শুরু করলেন বলা, “মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর প্রিয় সোহম চক্রবর্তীকে যোগ্য মনে করছেন… তিনি মনে করেছেন ওই-ই যোগ্য… আপনারা জবাব দিন ও কি যোগ্য…”।

 

চণ্ডীপুরের বর্তমান বিধায়ক অমিয় ভট্টাচার্যর সঙ্গে সোহম 

সোহম চুপ। প্রায় ২০ মিনিট পর মঞ্চ পেতেই বলা শুরু করলেন, “চণ্ডীপুরের ছেলে নই আমি, বাংলার ছেলে তো… আপনারাও বাংলার মানুষ। আমাকে ভালবাসবেন না আপনারা? উত্তর দিন…” চণ্ডীপুরের মাঠ জুড়ে তখন প্রিয় নায়ককে বড় পর্দায় ভিলেনকে কুপোকাত করতে দেখার পরমুহূর্তের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া অর্থাৎ হাততালির ঝড়।

বিকেল গড়িয়ে এরপর রাত… গ্রামের দিকে রাত ঝুপ করেই নামে সে যতই গরম কাল হোক… কান আটকে গেল জনা পাঁচেকের এক আলোচনায়, “ছেলেটা ভাল, তবে জিততে পারবে কি? দলই না হারিয়ে দেয়! এমএলএ (অমিয় ভট্টাচার্য) কি ওকে জিততে দেবে?” ফের ‘গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব’র খাঁড়া অভিনেতার কপালে! হাতে সংবাদমাধ্যমের বুম দেখেই চোখ চাওয়া-চাওয়ি করেই চুপ করে গেলেন ওরা। আর মুখ খুললেন না।

Next Article