বিগত কয়েক মাসের প্রস্তুতি। নিজের যা কিছু আছে সবটা ভুলে, বাক্সে তালাবন্ধ করে, অন্য একজন মানুষকে নিজের মধ্যে ধারণ করা কম ঝক্কি নয়। তাও আবার সেই অন্য মানুষটি যদি হন স্বয়ং সত্যজিৎ রায়। তাঁর চলনবলন, কথা বলার ধরন, বাচনভঙ্গি, ছোট ছোট ম্যানারিজ়ম – সবটা আত্মস্থ করে নেওয়া। করতে হয়েছে অভিনেতা জিতু কামালকে। জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া চরিত্র। কীভাবে ‘পথের পাঁচালী’ তৈরি করেছিলেন সত্যজিৎ রায়, সেই কাহিনিই পরিচালক অনীক দত্ত তুলে ধরতে চেয়েছেন সেলুলয়েডে। ছবির নাম ‘অপরাজিত’। বুধবার ছিল ছবির শেষ শুটিং। ট্রামে অপরাজিতর (সত্যজিৎ রায়ের আদলে তৈরি চরিত্র) বইপড়ার সিন দিয়ে শেষ। সেই শট দিতে যাওয়ার আগে জিতু কমলের কণ্ঠ দিয়ে বয়ে গিয়েছিল নিঃশব্দ আকুল আর্তি। এক কণ্ঠরোধ করা কষ্ট। TV9 বাংলাকে একান্ত সাক্ষাৎকারে বললেন, “কীভাবে থাকব আমি এখন?”
চরিত্রটির সঙ্গে শেষমেশ যাপনের ইতি… কেমন আছেন এই মুহূর্তে?
জিতু: কাজটা যখন শুরু হয়েছিল, মনে হয়েছিল, সুইচ অন-সুইচ অফ আমাদের অভিনেতাদের হয়েই থাকে। গতকাল আমার শেষ শুটিং ছিল। আগের দিন রাতে চরম কষ্টে কাটিয়েছি। মনে হচ্ছিল আত্মীয় বিয়োগ হয়েছে। শরীর থেকে একটা অংশ কে যেন কেটে বাদ দিয়েছে। এতটাই তীব্র অনুভূতি! আমার সারা বিছানাময় বইপত্র, ছবি… সবই ওই মানুষটাকে ঘিরে ছিল।
এই সময়টায় আপনার স্ত্রীও নাকি ছিলেন না আপনার সঙ্গে?
জিতু: না, ও ছিল না। নবনীতা আমার সঙ্গে থাকছিল না। একটা ফ্ল্যাটে পুরোপুরি একা কাটিয়েছি। আমার সঙ্গে থাকতেন সত্যজিৎ রায়। অনেক ধরনের অনুভূতির মধ্যে দিয়ে এই সময়টা কাটিয়েছি। একেক সময় গায়ে কাটা দিয়ে উঠত। অনেক ধরনের সমস্যা হচ্ছিল।
কী ধরনের সমস্যা?
জিতু: এই চরিত্রটা তো আর আমি করছি না। সুতরাং, চরিত্রটা থেকে বেরিয়ে আসা খুবই কঠিন। আমি নবনীতাকে বলেছিলাম, আমার তো আর কয়েকদিন সত্যজিৎ সাজা, তারপর তো সব শেষ। অনীকদা লিখল, শুটিং শেষ হতে পারে, কিন্তু আমার মধ্যে হয়তো কিছু থেকে যাবে। আমাদের সঙ্গে ছবিতে অঞ্জনা বসু কাজ করেছেন। তিনি আমাকে বলেছিলেন, “তুমি কি এভাবে দাঁড়ানো প্ল্যাকটিস করেছ, না সাবলীলভাবে এসেছে।” আমি বলেছিলাম, এর জন্য অনেক ওয়ার্কশপ করতে হয়েছে। সেদিন বিবেকানন্দ স্টাইলে দাঁড়িয়েছিলাম। যেভাবে সত্যজিৎ বাবু দাঁড়াতেন। আমার মনে হল এটাই সেই থেকে যাওয়া বিষয়টা।
‘মুন্নাভাই’-এর মতো কেমিক্যাল লোচাও হচ্ছে?
জিতু: এটাই আমি বলতে চাইছিলাম। আমার কিন্তু এরকম কেমিক্যাল লোচা হচ্ছে। সত্যজিৎ বাবুকে আমার চারপাশে অনুভব করতে পারছি। ‘লাগে রাহো মুন্নাভাই’-এ যেরকম সিনেম্যাটিক বিষয় ঘটেছিল, ততটা নয়। কিন্তু অদ্ভুত অদৃশ্য শক্তি আমাকে সাহায্য করে চলেছে প্রতিমুহূর্তে। আপনার সঙ্গে কথা বলতে বলতেও আমার শরীরে কাটা দিচ্ছে।
শুটিং তো শেষ, এখনও সেই অদৃশ্য শক্তিকে ফিল করতে পারছেন?
জিতু: এই প্রশ্ন আমার মনেও ঘুরপাক খাচ্ছে। আমি চরিত্রটাকে ছাড়তে চাইলে কি উনি ছাড়তে চাইবেন। জানি না। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।
পরিচালক অনীক দত্ত কিন্তু আপনার পারফরম্যান্সে খুশি…
জিতু: লুক বেরিয়ে যাওয়ার পর মানুষের থেকে অবিস্মরণীয় প্রতিক্রিয়া পেয়েছি। খুব দুশ্চিন্তায় ছিলাম। খুব বেশি চাপ অনুভব করতাম। মনে হত, সবাইকে আশাহত করে ফেলব। নিজেকে বুঝিয়েছিলাম, সবটাই গ্রহণ করতে হবে। ছবির শেষ শট দেওয়ার সময়ও অনীকদাকে দেখেছি কী পরিমাণ প্যাশন তাঁর মধ্যে রয়েছে। সারাদিন চরিত্রগুলোর সঙ্গে তিনি থাকেন। আমার মনে একটাই বিষয় এসেছে, তাঁকে আমাকে কিছু ফিরিয়ে দিতে হবে।
‘অপরাজিত’-তে নাকি নামের অনেক পরিবর্তন হয়েছে?
জিতু: একেবারেই। ‘পথের পাঁচালী’র নাম বদলে হয়েছে ‘পথের পদাবলী’। ইন্দিরা ঠাকুরণের নাম ননীবালা দেবী।
একটি যাপনের ইতি। ফের রোজনামচায় ফিরে যাওয়া। কিন্তু এই ফেরা সহজ নয়। মন খারাপের সকালেরা ফিরে ফিরে আসবে নতুন আলো নিয়ে, নতুন গল্প করবে রচন…।
আরও পড়ুন: Rabi Ghosh Birth Anniversary: খেতে খেতে সমানতালে অভিনয় করতে পারতেন রবিকাকা: সন্দীপ রায়