স্নেহা সেনগুপ্ত
প্রশ্ন: বাংলাদেশ থেকে ফিরে কোথায় গিয়েছিলেন?
সব্য়সাচী: আমি একটু শিলিগুড়ি গিয়েছিলাম। ফটো এগজ়িবিশন ছিল এবং সেমিনার ছিল। এগজ়িবিশনে আমারও ছবি ছিল একটা।
প্রশ্ন: কিছুদিন আগে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে গিয়ে আপনি বলেছিলেন, আর ছবিতে অভিনয় করবেন না। অবসর নিয়ে নিয়েছেন। এটা কিন্তু দর্শকের কাছে একটা শক!
সব্যসাচী: এবার আমি একটা কথা স্পষ্ট করে বলি, যা বলা হয়, তা লেখা হয় না।
প্রশ্ন: আচ্ছা!
সব্যসাচী: যে ক্লিপটা দেখে এত হইচই পড়ে গেল, সেখানে ওদের প্রশ্নগুলো ছিল কি?
প্রশ্ন: না, তা ছিল না… শুধু আপনার বক্তব্যটুকুই ছিল!
সব্যসাচী: হ্যাঁ, সেটাই তো ব্যাপার। গোলমেলে। ওরা প্রশ্ন করল, এই যে বাংলাদেশের ছবি ‘জে কে ১৯৭১’, এটা তো অনেকদিন আগের ছবি। আমি বলি, হ্যাঁ। করোনার আগে শুটিংটা হয়েছিল। কোভিডের মধ্যেই আমরা কোনওভাবে ছবির শুটিং শেষ করেছিলাম। মার্চেই মুক্তি। জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, এ ছাড়া আর কী-কী কাজ করেছি। আমি বলেছিলাম, ওটিটি প্ল্যাটফর্মের কিছু কাজ আমি করেছি। বলিউডের ‘বাবলি বাউন্সার’ ছবিতে অভিনয় করেছিলাম। সে দিন এ-ও বলেছিলাম যে, করোনার পরে আমি একটু অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। কাহিল হয়ে গিয়েছিলাম। তাই তুলনায় কম ছবিতে অভিনয় করেছি। জিজ্ঞেস করা হয়, “তাহলে কি আপনি আর অভিনয় করছেন না?” আমি জবাবে বলেছিলাম, “না, করছি না।” জিজ্ঞেস করা হয়, “কবে করবেন?” আমি বলেছিলাম, “জানি না।” তখনই জিজ্ঞেস করে, “তাহলে কি আপনি অবসর নিলেন?”
প্রশ্ন: তারপর তোলপাড় হয়ে গেল নেটদুনিয়া…
সব্যসাচী: প্রশ্নটা তো জোর করে আমার উপর বসানো হল। এবং জোর করেই স্টেটমেন্টটা নেওয়া হল যে, আমি রিটায়ার করেছি।
প্রশ্ন: এর পর সকলে ধরেই নিলেন আপনি অবসর নিয়েছেন। কেউ আসল ঘটনা জানতেও চাননি…
সব্যসাচী: না, জানতে চাননি এবং আমার তাতে কিছুই যায় আসে না। আমি অবসর নিলে কার কী এসে যায়। নির্মলকুমার চক্রবর্তী তো বহুদিন আগে অভিনয় জগৎ থেকে অবসর নিয়েছিলেন। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এবং তিনি তো একসঙ্গে অভিনয় করতেন। কেউ তো প্রশ্ন করতে আসেননি।
প্রশ্ন: কিন্তু ডাক্তার-আইনজীবীদের মতো অভিনেতাদেরও তো অবসর বলে কিছু থাকে না…
সব্যসাচী: নিশ্চয়ই থাকে। ব্যক্তির ইচ্ছা অনুযায়ী থাকে। কিন্তু কোনও কনট্র্যাক্ট থাকে না।
প্রশ্ন: তা হলে আপনি অবসর নেননি?
সব্যসাচী: আমার আসলে করোনা সংক্রমণ হওয়ার পর আর ভাল লাগছে না। শারীরিকভাবে আমার অনেক রকম অসুবিধে হচ্ছে। এটাকে বলে লং কোভিড। গা-হাত-পায়ে ব্যথা হয়। ঘুম কমে যায়। ক্লান্ত লাগে সবসময়।
প্রশ্ন: ভাল করে ডাক্তার দেখাচ্ছেন তো?
সব্যসাচী: না, আমি কোনও চিকিৎসা করাচ্ছি না। কারণ, এর কোনও চিকিৎসা নেই। কোভিড রোগটা সম্পর্কেই কেউ ভাল করে জানেন না। সবই অনুমানের ভিত্তিতে চলছে। সে রকমই কেউ-কেউ অনুমান করে নিলেন যে, আমি অবসর নিয়েছি।
প্রশ্ন: কিন্তু আমরা কিছুই অনুমান করতে চাই না। আপনার কথাটাই শুনতে চাই…
সব্যসাচী: আমার তো কোনও ঠিক নেই। আবার ইচ্ছা করলে আমি কাজ করব। ইচ্ছা না করলে করব না। আসলে ভাল লাগার কাজে এনার্জি পাওয়া যায়।
প্রশ্ন: অভিনয়ও তো আপনার ভাল লাগার বিষয়…
সব্যসাচী: না, আর ভাল লাগছে না।
প্রশ্ন: ওহ্, তা-ই বুঝি…
সব্যসাচী: এমন কোনও রোল নেই যেগুলো আমার ভাল লাগাতে পারে। ‘বাবলি বাউন্সার’ ছবিতে আমার চরিত্রটা করতে ভাল লেগেছিল। তা-ই করেছিলাম। মনের আনন্দের রোল ছিল ‘ফেলুদা’… এখন আমার যা বয়স হয়েছে, তাতে তো ‘ফেলুদা’ করা উচিত নয়। তাই ছেড়ে দিয়েছি।
প্রশ্ন: কোনও পরিচালক যদি মনে করেন আপনাকে দিয়ে বেশি বয়সি ফেলুদা করাবেন, করবেন?
সব্যসাচী: সেটা একমাত্র সন্দীপ রায় করলেই করব, অন্য কোনও পরিচালক করলে করব না।
প্রশ্ন: কলকাতা থেকে কেউ আপনার এই ‘রটে যাওয়া অবসর’-এর খবর সত্যি না মিথ্যা জানতে চেয়েছেন?
সব্যসাচী: অনেকেই জানতে চেয়েছেন। আর আমি বলেছি, হ্যাঁ, আমি অবসর নিয়ে নিয়েছি’।
প্রশ্ন: কাছের মানুষের দেওয়া চরিত্রেই কি তবে অভিনয় করবেন…?
সব্যসাচী: হ্যাঁ। ধরুন আমার ছেলে যদি ভাবে কোনও ছবির একটা চরিত্র আমাকে করতে হবে… তখন তো আমি না বলতে পারব না। এছাড়া, এখন যদি সত্যিই কোনও পরিচালক আমার ভাললাগাকে জাগিয়ে তুলতে পারে, তা হলে আমি করব, নচেৎ করব না। আমার যেটা ভাল লাগে, আমি সেটাই এখন করব। ১৯৮৮ সাল থেকে অভিনয় করছি। অনেক অভিনয় করেছি।
প্রশ্ন: ‘অবসর’ বিষয়টা যখন বাড়ির লোকে জানলেন, তাঁরা কী বললেন?
সব্যসাচী: আমার ছেলেরা-বউমারা খুব হতাশ হয়েছিল। সবাই বলেছে, “কী করছ?” আমি বললাম, “আমার ইচ্ছা!” আমি সাফ জানিয়েছি, “যখন ইচ্ছা করবে, তখন করব, এখন করছে না।” কারণ, এখন করার মতো কোনও চরিত্র নেই, কোনও পরিবেশও নেই। জানেন, ৩-৪টে ভাল ছবিতে অভিনয় করেছি, সেগুলো রিলিজ়ই করল না একটাও।
প্রশ্ন: তাই নাকি?
সব্যসাচী: আমার ভীষণ হতাশ লেগেছে। এত পরিশ্রম করে কাজ করার পর সেগুলো মুক্তি না পেলে বিরক্ত বোধ করি। মনমরা লাগে। তাই কাজের প্রতি, এই ইন্ডাস্ট্রির প্রতি অনীহা তৈরি হয়েছে। নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছি। সত্যিই তো, কাজ করে লাভ কী!
প্রশ্ন: তার মানে ইন্ডাস্ট্রির পরিবেশও আপনার ভাল লাগছে না…
সব্যসাচী: পরিবেশ খুব খারাপ হয়ে গিয়েছে। একটা ছবি তৈরি হচ্ছিল। দু’নম্বরি করে শুটিং করছিল। আমি জিজ্ঞেস করায় আমাকে বাদ দিয়ে দিল। আমি বলেছিলাম, ফেডারেশন এবং গিল্ডের নিয়ম মেনে করতে হবে তো কাজটা। তাঁরা সেটা মানল না। আমাকেই ধরে বাদ দিয়ে দিল। তাই এসব কিছু থেকে আমি নিজেকে সরিয়ে নিয়েছি।
প্রশ্ন: আর্টিস্ট ফোরাম থেকে সরেছিলেন কেন?
সব্যসাচী: আর্টিস্ট ফোরামের আর্টিস্টরা আমার নামে অভিযোগ করেছিল। আমি নাকি আর্টিস্ট ফোরামের টাকা নয়ছয় করছি।
প্রশ্ন: তারপর?
সব্যসাচী: আমার নামে এ সব হয়েছিল জানেন, এবং আমি শেষমেশ রিজ়াইন করেছিলাম। তাই সেসব থেকেও নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলাম। আমি জানিয়েছিলাম, এই ইন্ডাস্ট্রিতে আমি থাকতেই রাজি নই। তারপর নাটক করতে গেলাম। সেখানে পরিশ্রম করে মহড়া হল। এক জায়গা থেকে ফোন করে বলা হল, নাটক বন্ধ করে দিতে হবে।
প্রশ্ন: কেন?
সব্যসাচী: কারণ, তাঁদের বক্তব্য ছিল, তাঁরা সেই এক নাটক করছিলেন। কাজেই এগুলো ঘটেছে দিনের পর-দিন। আমার এখন কারও নামেই নালিশ করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নেই। আমি পরিবেশের কথা বলছি। এখানে বড়-বড় নাটকের দলকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়। এটা কিন্তু ২০১৯ সালের পরের ঘটনা। আমাদের গোডাউন থেকে পোশাকও চুরি গিয়েছিল। প্রচুর দেনা হয়ে গেল। আমি, খেয়ালি ঘোষ দোস্তিদার, অরিন্দম গঙ্গোপাধ্যায় এবং অন্যরা… আমাদের খুবই বড় ক্ষতি হল (‘চার্বাক’ নাটকের দলের ঘটনা)।