বিন্দুমাসি নাকি অনামিকা—এত বছর পরেও লোকে কী নামে ডাকে?
(হাসি) হাহাহাহা, আজও আমি গ্রামেগঞ্জে সেই বিন্দুমাসিই …
কিন্তু কেরিয়ারের শুরুটা তো খলনায়িকা হিসেবে ছিল না…
একেবারেই না। বিয়ের আগে, মানে সেই ১৭ বছর বয়স থেকে তো সিনেমায়। তরুণ মজুমদারের ‘সংসার সীমান্তে’ দিয়ে শুরু। তারপর উনি করলেন ‘খেলার পুতুল’, অনুপ কুমারের স্ত্রী আমি। সে একেবারে মারমার কাটকাট ছবি। এর পর এল ‘গণদেবতা’। তনুদা (তরুণ মজুমদার) বললেন, ওই ছবিতে কোনও ছোটদের চরিত্রে নেই। আমায় নাকি নাচতে হবে, এক ঝুমুর দলের হেড।
তারপর?
তারপর হল এক কাণ্ড। ওই ছবির পর বেশ কয়েকটি ছবিতে নাচের অফার পেলাম। সবাই বলতে লাগল আমি নাকি কলকাতার রেহানা সুলতানা। তখন তো তিনি ভীষণ সেক্সি গার্ল। আর আমিও এরকম মোটা নই, দারুণ ফিগার। সবাই ওই বাইজির চরিত্রই দিতে শুরু করে।
এখনকার দিনের আইটেম গার্ল?
হ্যাঁ বলতেই পারেন, আমি ভ্যাম্প গার্ল হয়ে গেলাম। সেক্সি রোল ছাড়া আমায় আর কেউ কিচ্ছু দিতে চাইত না। ওই যে আমার সেই বিখ্যাত গান, মান্না দে গেয়েছিলেন (গান গেয়ে), ‘কী বিষের ছোবল দিলি, কালনাগিনী তুই…’। আমি আর সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নাচছি। এই সব করতেই-করতেই বিয়ে পাকা হয়ে গেল আমার।
শ্বশুরবাড়ি ‘আইটেম ডান্সার’ বৌমা মেনে নিলেন? সেসময় দাঁড়িয়ে আপত্তি করেননি?
না না, আমার তো সম্বন্ধ করে বিয়েই হয়নি। আমি তো প্রেম করছিলাম। শাশুড়ি তো আমায় একদম পছন্দ করত না। আমায় দেখেই ভেউভেউ করে কান্না শুরু করে দিয়েছিলেন।
সেকী!
শ্বশুরমশাই আবার উকিল ছিলেন। যাই-ই হোক, আমার বিয়ে হল। একদিন ডেকে বললেন, “আমাদের বংশের তো একটা নাম আছে। আমাদের এ সব সিনেমা করা যাবে না।” ব্যস, ওই আমার সিনেমা বন্ধ।
আর আপনার স্বামী? তিনি কিছু বলেননি?
একটা গল্প বলি। বিয়ের আগে নারায়ণ সান্যালের উপন্যাস ‘অশ্লীলতার দায়ে’ অবলম্বনে আমি ছবি করি। জানেন, আমার দু’টো পা দিয়ে পোস্টার করা হয়েছিল। শুধু দু’টো পা। বিপ্লব চট্টোপাধ্যায় রাস্তায় ল্যাম্পপোস্টে সেই পোস্টার দেখে আমার স্বামীকে বলেছিল, “এ রাম, তুই আর মেয়ে পেলি না, পা দেখিয়ে কলকাতা নাচাচ্ছে। এ কে বিয়ে করলি?”
খারাপ লেগেছিল?
না, বিপ্লবদা মজাই করেছিলেন। কী যে পিছনে লাগতেন…
খলনায়িকার প্রসঙ্গে আসা যাক, সেটা কবে থেকে শুরু?
বিয়ের পর আমার কাজ বন্ধ। একদিন আমার শ্বশুরমশাই এসে বললেন, আমার গলাটা তাঁর পছন্দ। আমি যেন রেডিয়ো-নাটক করি। করতে শুরু করলাম। সে সময় বলিউডের কত অভিনেত্রীর বাংলা ডাবিং করেছি। আমার তো নামই হয়ে গেল ‘ডাবিনেত্রী’। (কিছুটা থেমে) এরপর প্রায় পাঁচ ছয় বছর পর… আমার তখন মেয়েও হয়ে গিয়েছে। একদিন ডাবিং করে বের হচ্ছি, হঠাৎ করে দেখি বাংলাদেশ থেকে কিছু লোক দেখা করতে এসেছেন। এসেই বলে, “দিদি বাংলাদেশ থেকে আইসি, ছবি করুম বইল্লা, আপনি আমাগো ফেরাবেন না।” আমি বলি, যদি করতেই হয়, তবে শ্বশুরমশাইকে রাজি করাতে হবে। ওঁরাও গেলেন বাড়ি।
শ্বশুরমশাই রাজি হলেন?
হ্যাঁ হলেন, তবে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘বাংলাদেশ যেতে হবে না তো’? যেতে হয়নি। ওই ছবিই হল বাংলা সিনেমার অন্যতম আলোচিত ছবি ‘বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না’। এর আগে অবশ্য চিরঞ্জিতের কথা শুনে খেয়েদেয়ে একটু মোটা হয়ে নিয়েছিলাম।
তখন তো বয়স অত অল্প, ফিরলেনই যখন দিদা (জ্যোৎস্নার দিদা) হয়ে ফিরলেন?
তাতে কী হয়েছে? আমি তো ২৯ বছর বয়সে বুম্বার মা (প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়) করেছি।
তখনও তো খলনায়িকা হয়ে ওঠা হয়নি…
না, না। ‘বেদের মেয়ে…’ সুপারহিট হওয়ার পর আমার তো অফারের পর অফার। তখন শচীন অধিকারী একটা ছবি করলেন, নাম; ‘শয়তান’। আমি আর আমার বিপরীতে দীপঙ্কর দে। তাপস পাল আর ইন্দ্রাণী দত্ত হিরো হিরোইন। শ্বশুর-শাশুড়ি—মানে আমরা—বৌকে বালিশ চাপা দিয়ে মারব, এটাই ছিল ছবির গল্প। ‘শয়তান’ সুপারহিট হয়। ব্যস, তারপর থেকে সবাই নেগেটিভ চরিত্রের জন্য ডাকতে শুরু করল।
স্টিরিওটাইপ হয়ে গেলেন বলছেন?
এখানে তো তাই-ই হয়। একটা চরিত্রে কেউ একটু নাম করে গেলে তাঁকে সেই চরিত্রই দেওয়া হতে থাকে। তবে একদিন একটা ব্যাপার ঘটল…
কী ব্যাপার?
মেয়ে তখন ক্লাস ফাইভে। দেখি মুখ ভার করে বসে আছে। বললাম: কী হয়েছে? বলছে, স্কুলে সবাই বলে, তোর মা কেমন দুষ্টু-দুষ্টু রোল করে, আমার একদম ভাল লাগে না। তুমি করবে না…। আমার সেদিন মনে খুব কষ্ট হয়েছিল। নেগেটিভ চরিত্র ছেড়ে দিতে লাগলাম।
আবারও কেরিয়ার থেকে ফুল স্টপ?
না, না। অনুপ সেনগুপ্তকে বলেছিলাম, নেগেটিভ আর করব না গো। পজ়িটিভ হলে বোলো। সে সময় ও একটা ছবি বানাচ্ছিল ‘মায়ের আঁচল’। আমায় এসে বলল, ‘আপনি মা হবেন। নেগেটিভ করে দেখিয়ে দিয়েছেন। এবার পজ়িটিভ করে প্রমাণ করতে হবে আপনি কত বড় অভিনেত্রী।’ ব্যস, ‘মায়ের আঁচল’ও হিট। চুল ছেড়ে, শাড়ি পরে আমি মা…এরপর আবার ক্রমাগত পজ়িটিভ চরিত্র আসা শুরু করল। ‘অভিমান’, ‘পরিবার’, ‘সূর্য’ সব হিট। দেখতে-দেখতে ২০০০ সাল চলে এল…
‘শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ’?
হ্যাঁ। হরদার কাণ্ড (পরিচালক হরনাথ চক্রবর্তী)। আমায় নেগেটিভ করাল। সেই ছবিও হিট। এরপরেই ভেঙ্কটেশ ঠিক করে এক তামিল ছবির রিমেক করবে। পরিচালক হরদা। আমাকে নেগেটিভ চরিত্রটার জন্য বলা হয়। কী কারণে যেন সেই ছবি হরদা করল না। স্বপন সাহা তখন নিসপাল রানের সঙ্গে মিলে ছবিটা তৈরি করল। আর এই যে আজও আমি করে খাচ্ছি, গ্রামেগঞ্জে আজও যে আমি গেলে এত মাতামাতি, তা ব্যস, ওই ছবির জন্যেই। ছবির নাম ‘ঘাতক’। আর আমি ‘বিন্দুমাসি’। আমার নামই হয়ে গেল ওইটা। সম্প্রতি একটা ছবি করলাম, যেখানে বিন্দুমাসি ফিরে এসেছে, সে এখন মুখ্যমন্ত্রী। শৌভিক বসুর ছবি। পয়লা বৈশাখে রিলিজ।
সেই বিন্দুমাসি এখন সিরিয়ালে মিষ্টি ঠাম্মি, নেগেটিভ করতে চান না?
চাইব না কেন? দেয় না তো। এখন তো সব ২২ বছরের বাচ্চা মেয়েরা খলনায়িকা। আমাদের তো শিখতে হয়েছে। কীরকম চাহনি হবে, কীভাবে কথা বলব এগুলো শিখতে হয়েছে। ওরা তো করতেই পারে না। না শিখে করলে যা হয় , জায়গা করে নিতে পারছে না।
আপনি কেন শেখান না তাঁদের?
না, না। ওই সব নেই এখন। এখন কেউ বলে না, ‘একটু শিখিয়ে দাও’। তাঁরা জানে, তাঁরা যা দিচ্ছে, সেটাই নাকি বেস্ট।
এত যে নেগেটিভ করলেন, তা থেকে ইতিবাচক কী পেলেন?
সবটাই পাওয়া আমার। আজ থেকে কুড়ি বছর আগে করেছি ছবি। তার ডায়লগও সবার মুখস্থ। যখন মঞ্চে দাঁড়িয়ে বলি, ‘কত টাকা? পাঁচ হাজার, দশ হাজার… ‘বাকিটা দর্শকই বলে দেয়। এখনও যে এত লোক ভালবাসে, এত লোক পছন্দ করে আর কী চাই… সৃজিত-কৌশিক আমায় ডাকে না। আর হয়তো বেশিদিন বাঁচবও না। তবে এ জীবনে যে ভালবাসা পেয়ে গেলাম, তাই বা কয়জনের ভাগ্যে জোটে?