বিহঙ্গী বিশ্বাস
রাজারহাট থানার কাছে বাড়ি সুমিত চক্রবর্তীর। বৃহস্পতিবার সকালের জন্য বসকে বলেই রেখেছেন, “আসতে দেরি হবে।” সদ্য বিবাহিত স্ত্রীকে সারপ্রাইজ দেবেন ঠিক করে রখেছেন। আর তাই রাজারহাটের একটি মাল্টিপ্লেক্সে ভোর পাঁচটায় আগাম কেটে রেখেছেন ‘জওয়ান’-এর টিকিট। বসও কিছু বলেননি। তাঁরও যে টিকিট কাটা আগে থেকেই। শুধু সুমিত বা তাঁর বসই নন। গোটা দেশই এই মুহূর্তে ভুগছে ‘জওয়ান’ জ্বরে। অগ্রিম বুকিংয়ের অঙ্কের হিসেবটা দেখলেই খানিক হলেও ঠাওর করা যাচ্ছে সাধারণের ‘অ্যাড্রিনালিন রাশ’। শুধু শাহরুখ খানই, দক্ষিণের অন্যতম হার্টথ্রব নয়নতারা আর সেনসেশন বিজয় সেতুপথি-সহ একগুচ্ছ দক্ষিণী তারকার ভিড়ে এই ছবি যেন মুক্তির আগেই সুপারহিট। আর এ রাজ্যে? সেখানে ‘জওয়ান’-এর জলওয়া কতটা? ৫৭ বছবর বয়সী এসআরকে-র ‘বু্ড়ো হাড়ের ভেলকি’ দেখার আগ্রহ নিয়ে শহুরে দর্শক ফেসবুকে গলা ফাটালেও দক্ষিণ ২৪ পরগণার প্রত্যন্ত কোনও হলে কি ‘শারুক খানের বই’ দেখার জন্য আগ্রহী হচ্ছে জনতা? TV9 Bangla খোঁজ নিতেই উঠে এল চমকে দেওয়া সব তথ্য।
ঠাকুরপুকুর হয়ে রায়পুর নদী পেরিয়ে দক্ষিণ ২৪ পরগণায় অবস্থিত শিবপ্রসাদ ঘোষের হল ‘উমা টকিজ’। মোলায়েম রিক্লাইনার, ব্রেকের মাঝে ক্যারামেল পপকর্নের বালাই নেই সেখানে। নেই ক্রপ টপ আর রিপড জিনসের মানুষও। সেখানকার মানুষও কি আক্রান্ত এই ‘জওয়ান’ জ্বরে? TV9 বাংলা প্রশ্ন করতেই শিবপ্রসাদবাবুর গলায় ফুটে উঠল আত্মবিশ্বাস। বললেন, “আমাদের তো আর অ্যাডভান্স বুকিং-টুকিং হয় না। তবে জানেন, পোস্টার যখন পড়ছিল, লোকজন এসে শো-টাইম জেনে যাচ্ছিল। প্রথমে দিনে (৭ সেপ্টেম্বর, বৃহস্পতিবার) চারটে করে শো রেখেছিলাম। প্রথম শো ছিল বেলা ১১টায়। কিন্তু পাবলিকের যা ডিমান্ড, তাতে শো এগিয়ে আনতে বাধ্য হলাম, বলতে পারেন।” ফোনের ওপার থেকে ভেসে এল সিঙ্গল স্ক্রিন মালিকের গর্বিত কণ্ঠ, “৯.৩৫-এ দেখাব। যা উৎসাহ দেখছি, লোকজন আসবে বলেই মনে হচ্ছে।”
সিনেমা রিলিজ়ের আগে প্রচারে, সপ্তাহান্তে সিনেমাহল ভিজ়িটে, সোশ্যাল মিডিয়ায় টলিউডের তাবড় শিল্পীকে যখন গলা ফাটাতে শোনা যায় ‘বাংলা ছবির পাঁশে দাঁড়ান’, তখন কোথাও যেন অনুচ্চারিতই থেকে যায় শহর থেকে শহরতলি হয়ে গ্রামেগঞ্জে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা সিঙ্গল স্ক্রিনের দুর্দশার কথা। করোনাকালে সিঙ্গল স্ক্রিনগুলোর কী অবস্থা হয়েছিল, তা একপ্রকার সকলেরই জানা। কর্মহীনদের হাহাকার, হল মালিকদের দীর্ঘশ্বাসকে সঙ্গী করে তখন ওঠা স্লোগান (‘বাংলা ছবির পাশে দাঁড়ান’) শোনা যায় এখনও। দাঁড়ানোর চেষ্টা যে জনগণ করেননি এমনটা কিন্তু নয়, কিন্তু ‘ওল্ড ওয়াইন ইন আ নিউ বটল’-এ ভর করে যে ব্যবসা হয় না, সে কথা এক সুরে স্বীকার করেছেন বহু হল মালিক। শাহরুখ খানের কামব্যাক ছবি ‘পাঠান’-এর সৌজন্যে দেশজুড়ে ২৫টি সিঙ্গল স্ক্রিন খুলেছিল আবারও।
শিবপ্রসাদবাবুর সুরে সুর মিলিয়ে একই কথা বলেছেন শেওড়াফুলির ‘বাণীরূপা’ সিনেমা হলের মালিক সুভাষ সেনও। ৭ সেপ্টেম্বর, বৃহস্পতিবার বেলা ১২টায় সেখানে প্রথম শো। ‘লস’ হবে না প্রায় ধরেই নিচ্ছেন সুভাষবাবু। বললেন, “এরকমটা হয়েছিল ‘পাঠান’-এর সময়ও। তবে এবার যেন আরও বেশি চাহিদা। শুধু তো আর শাহরুখ-দীপিকা নয়, সাউথের কত কে রয়েছেন। না, মনে হচ্ছে হলটা ভরেই যাবে।” স্বস্তির শ্বাস ফেলেছেন ‘একা’ (পড়ুন সিঙ্গল) স্ক্রিনের মালিক। মঙ্গলবার (৫ সেপ্টেম্বর) সকালেই অগ্রিম বুকিংয়ের কাউন্টার খুলে দিয়েছেন ‘সোনালি’ সিনেমা হলের মালিক দীপাঞ্জন। মাত্র কয়েক ঘণ্টাতেই প্রায় ৫০ শতাংশ ভর্তি হয়ে গিয়েছে। উচ্ছ্বাস ঝরে পড়ছে তাঁর গলাতেও। বললেন, “যা ভেবেছিলাম, সেটাই হচ্ছে। আমাদের তো অনেক আগে বুকিং হয় না। দু’দিন আগে থেকে খুললাম। এখনই এই অবস্থা। মনে হয় প্রথম দিনে সবক’টা শো-ই হাউজফুলই হবে।” মেদিনীপুরের এক সিনেমা হলের মালিক যিনি নাম প্রকাশ করতে চাননি, তাঁর আবার মনে দানা বাঁধছে আশঙ্কা। বললেন, “রেসপন্স তো ভালই। তবে প্রথম দিন যদি দর্শকের প্রত্যাশা মেটাতে না পারে, তবে তো ওই ‘আদিপুরুষ’-এর মতো অবস্থা হবে।” আগে থেকে এতটা ভাবতে যদিও রাজি নন অজন্তা সিনেমা হলের শতদীপ সাহা। বললেন, “পাঠান-এর থেকে বিক্রি ভাল এবার। সকাল ছ’টায় শো টাইম রেখেছি। সেটাও প্রায় হাউজফুল। এই শো সুপারহিট।” বাংলায় এই ছবির ডিস্ট্রিবিউটার এসভিএফ। এসভিএফ-এর তরফে মহেন্দ্র সোনি বলছেন, “বাংলায় রেকর্ড তৈরি করেছে ‘জওয়ান’। এক লক্ষ পঁচিশ হাজার টিকিট বিক্রি হয়ে গিয়েছে।” যদিও শহুরে সিঙ্গল স্ক্রিন ‘প্রিয়া’র মালিক অরিজিৎ দত্ত ও এসভিএফের মধ্যে বয়ে চলা চোরাস্রোতের জেরে ওই হলে এই ছবির ভবিষ্যত বিশ বাঁও জলে। অরিজিৎ অবশ্য জানিয়েছেন, এসভিএফের তরফে একটি টুইট করা হয়েছে। রিলিজের আগেই ছবি মুক্তি নিয়ে কোনও সদর্থক সিদ্ধান্তের দিকেই যাবেন তাঁরা, দাবি অরিজিতের।
‘পাঠান’-এর সৌজন্যে পায়ের তলায় জমি শক্ত হয়েছিল কত মানুষের। আর এবার? প্রায় ৬০ ছুঁইছুঁই সানি দেওলের (‘গদর ২’) ওই মারকাটারি হিটের পর আবারও কি এক ‘বুড়ো হিরো’র কাঁধে ভর করে ঘুরে দাঁড়াবে সিঙ্গল স্ক্রিন? ওরা আশাবাদী, উত্তর পেতে অপেক্ষা করতে হবে আরও ৪৮ ঘণ্টা।