তাঁকে ‘রাজনৈতিকভাবে সচেতন’ বলেই গণ্য করা হয় টলিউড ইন্ডাস্ট্রিতে। আদতে পেশায় চিকিৎসক এই চলচ্চিত্র পরিচালক বিভিন্ন ঘটনা, বিশেষত রাজনৈতিক ঘটনাকে কেন্দ্র করে, নির্দ্বিধ মন্তব্য় করতে পিছপা হন না। বড় ব্যানারের ছবি থেকে শুরু করে স্মল বাজেট ছবি অথবা স্টার-নির্ভর সিনেমা থেকে নবাগতদের নিয়ে তৈরি ছবি, সবক্ষেত্রেই দক্ষতার সঙ্গে গল্প বুনে চলেছেন এই পরিচালক—কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়। তবে নিজের পরবর্তী ছবি রিলিজ়ের আগে এহেন ‘রাজনৈতিকভাবে সচেতন’ কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায় কি ‘সমসাময়িক’ বিযয় নিয়ে গল্প বলার পর কিছুটা সন্দিহান? ঋত্বিক চক্রবর্তী-পাওলি দাম অভিনীত ‘একটু সরে বসুন’ রিলিজ়ের পর ‘সরকারি বাধা’ আসতে পারে, এমনটা কি ভাবাচ্ছে আইকনিক ‘মেঘে ঢাকা তারা’র পুনর্নির্মাণ ঘটানো কমলেশ্বর? TV9 বাংলাকে অকপটেই বলেছেন তিনি, “সরকারি, বেসরকারি—নানা দিক থেকেই বাধা আসতেই পারে।” হঠাৎ এমন কথা কেন বললেন কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়? মন দিয়ে শুনল TV9 বাংলা।
বনফুলের লেখা ‘পাশাপাশি’ শীর্ষক ছোটগল্পকে কেন্দ্র করে নিয়ে কমলেশ্বরের আগামী ছবি ‘একটু সরে বসুন’, যা বড়পর্দায় রিলিজ় করছে ২৪ নভেম্বর। ২০২৩ সালে এসে বনফুলের ছোটগল্পের প্রাসঙ্গিকতা বোঝাতে গিয়ে আরও একবার তাঁর ‘রাজনৈতিকভাবে সচেতন’ দিকটির প্রতিই অনায়াসে আকৃষ্ট করলেন ‘চাঁদের পাহাড়’-এর পরিচালক কমলেশ্বর। বললেন, “বনফুল অনেক বছর আগে এই ‘পাশাপাশি’ গল্পটা লিখেছেন। তবে এই গল্পের মুল বিষয় হল চাকরি পাওয়া, না-পাওয়ার কথা।” প্রসঙ্গত, পশ্চিমবঙ্গে দীর্ঘদিন ধরেই বেকারত্ব এক বড় সমস্যা। শুধু তাই-ই নয়, ‘যোগ্য’ শিক্ষক পদপ্রার্থীরা চাকরি পাচ্ছেন না, এই অভিযোগে কলকাতার রাজপথে ধরনার দৃশ্য মোটেই অচেনা নয়।
বেকারত্বের সঙ্গে সঙ্গে একের পর এক নিয়োগ দুর্নীতিকে কেন্দ্র করে রাজ্যের প্রাক্তন ও বর্তমান মন্ত্রীদের হাজতবাসের ঘটনারও সাক্ষী থেকেছে বাংলা। ‘পাশাপাশি’ গল্পের প্রাসঙ্গিকতাকে কেন্দ্র করে এবার কমলেশ্বরের সংযোজন, “এখন আমাদের চারপাশে যা চলছে, তা চূড়ান্ত আনএমপ্লয়মেন্ট (বেকারত্ব)। চাকরিপ্রার্থীরা রাস্তায় বসে রয়েছেন। চারিদিকে চাকরি নিয়ে বিক্ষোভ চলছে। বহুদিন চাকরিতে নিয়োগ করা হচ্ছে না। এবং যারা এই নিয়োগের কাজে দায়িত্ব প্রাপ্ত ছিল তারাই এই যোগ্য প্রার্থীদের বঞ্চিত করেছেন। এমন পরিস্থিতিতে মনে হল, এই গল্পটাকে (বনফুলের লেখা ‘পাশাপাশি’) ব্যবহারের মাধ্যমে সমসাময়িক হিসেবে তৈরি করে যদি বর্তমান পরিস্থিতিতে সিনেমার পর্দায় ধরে রাখা যায়। সেখান থেকেই ‘একটু সরে বসুন’ ছবিটি বানানো।”
‘রাজনীতিসচেতন’ পরিচালক যখন ‘সমসাময়িক’ ও ‘প্রাসঙ্গিক’ থাকার চেষ্টা করছেন এই ধরনের গল্প বাছার মাধ্যমে, তখন জিগ্যেস না করলেই নয়: আমাদের রাজ্যে চাকরি নিয়ে যে বিভ্রাট, সেই বিষয়গুলো কি এই ছবিতে দেখা যাবে? পরিচালকের বক্তব্য, “এতো একবারেই সত্যি যে, সিনেমা ইতিহাসের দলিল।” চাকরিপ্রার্থীদের আন্দোলন ও দাবিকে কেন্দ্র করে এরপর কমলেশ্বরের যোগ করলেন, “আমার ধারণা এই ছবির মাধ্যমেই সে বিষয়ের আঁচ পাওয়া যাবে। এই ছবি একটি স্যোশাল স্যাটায়ার। মজার ছলে হলেও সমাজের নানা বিষয় উঠে আসবে। সবথেকে বড় কথা হল, মানুষ এই সিনেমার গল্পের সঙ্গে নিজেকে রিলেট করতে পারবেন, মিল খুঁজে পাবেন। এটা নিছক হাসির ছবি নয়।”
ছবির বিষয় যখন এতটাই ‘রাজনৈতিকভাবে’ ও ‘সমসাময়িক’, তখন প্রদর্শনের ক্ষেত্রে বাধা আসে যদি? একটা আশঙ্কা কি থেকে যায় না যে, সরকারি তরফ থেকে ‘একটু সরে বসুন’-এর প্রদর্শনে সমস্যা হতে পারে? আশঙ্কার কথা যে তিনি উড়িয়ে দিচ্ছেন না, তা ধরা পড়ে কমলেশ্বরের গলায়—যদিও প্রতিবেদকের প্রশ্নের উত্তরে কণ্ঠস্বর তাঁর অকম্পিত, নির্ভীক। খুব স্বাভাবিকভাবেই উত্তর দিলেন পরিচালক, “আমার অভিজ্ঞতা থেকে মনে হয়, সরকারি, বেসরকারি—নানা দিক থেকেই বাধা আসতে পারে। আসলে সামাজিক বাস্তবতাকে নিয়ে শুধু সিনেমা নয়, যে কোন শিল্প মাধ্যমেই যদি তা উঠে আসে অথবা সেরকম কথা বলার প্রয়াস থাকে, তা বাধাপ্রাপ্ত হয়। আর বাধাপ্রাপ্ত হয় বলেই ক্ষমতার অলিন্দে যাঁদের আনাগোনা, তাঁদের অসুবিধা হয় না। কিন্তু যাঁরা প্রতিবাদী বা প্রতিবাদের কথা বলেন, তাঁদের অবশ্যই বিভিন্ন সমস্যার মধ্যে পড়তে হয়।” আন্দোলনকারীদের প্রতি কমলেশ্বরের গলায় স্পষ্ট ‘সংবেদনশীলতা’ ও ‘সহমর্মিতা’। তাঁর উদ্দেশে TV9 বাংলার পরবর্তী প্রশ্ন, তার মানে বাধা আসতে পারে এক্ষেত্রে? উত্তরে মৃদু হেসে কমলেশ্বর বললেন, “হ্যাঁ, বাধা আসতেই পারে। আবার না-ও আসতে পারে। আসলে এই ছবি দেখে যাঁরা বেরোবেন, তাঁরা কী বলছেন, তাঁদের কী মনে হচ্ছে, পুরোটা তাঁর উপরই নির্ভর করবে।”
দর্শকরা তবে কী আশা নিয়ে যাবেন প্রেক্ষাগৃহে, উত্তরে পরিচালক বলেছেন, “এই ছবিটিতে মজার মোড়কে সামাজিক ও বর্তমান এক পরিস্থিতি তুলে ধরা রয়েছে। সেই অর্থে আমার তৈরি প্রথম কমিক-সামাজিক ছবি এটি। গোটা পরিবার একসঙ্গে ছবিটি দেখতে পারে। আর এই ছবির অভিনেতাদের অভিনয় দেখার মতো হয়েছে, তা দেখে উপভোগ করবেন দর্শকেরা। নিজের সঙ্গে মিল খুঁজে পাবেন।” দুর্নীতির টাকা ঘুরপথে টলিউডের ছবি নির্মাণে ব্যবহার করে কালো থেকে সাদা করা হচ্ছে বলে অভিযোগ ওঠে প্রায়শই।
সেক্ষেত্রে আপনারা যাঁরা ছবি তৈরির প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত, তাঁদের কতটা সচেতন হতে হবে ভবিষ্যতে? উত্তরে পরিচালকের সাফ জবাব, “এর সঙ্গে পরিচালকের কোনও যোগাযোগ নেই। এটা প্রযোজকদের দেখতে হবে। একটি কাহিনি বা চিত্রনাট্য নিয়ে পরিচালক পৌঁছন প্রযোজকের কাছে, তার পর সেই চিত্রনাট্য নিয়ে সিনেমা হলে পরিচালক বা অভিনেতা বা কলাকুশলীরা কর্মচারীর মতো প্রযোজকের কাছে কাজ করেন। ছবি তৈরির সোর্স বা উৎস কী, সেটা আমাদের পক্ষে জানা সম্ভব নয়। এই বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে যেমন তদন্ত চলছে, তেমনই চালিয়ে যাওয়া উচিত। এবং উৎস খুঁজে এর সঙ্গে যারা যুক্ত, সরাসরি তাদের ধরা দরকার।”