সংযুক্তা চট্টোপাধ্যায়
এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আমি বুঝতেই পারছি না কী করব। জানেন, আমি বাড়িতে কিছুই সামলাতাম না। সবটাই সামলাতো অভিষেক। খাবার থেকে শুরু করে বাড়িতে আলু-পিঁয়াজ আছে কি না, বাড়িতে কে, কী খাবে, আমি কী খাব, ডল (অভিষেক-সংযুক্তা একমাত্র কন্যা) কী খাবে, কী রান্না হবে… সবটাই ও-ই দেখত। আমি ফাইন্যান্সের দিকটা দেখতাম। এরকমই সমঝোতা ছিল আমাদের দাম্পত্যে।
আমি অভিষেকের উপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল ছিলাম। স্বামী-স্ত্রী হিসেবে আমাদের বন্ডিংটাই আলাদা ছিল। সত্যি বলতে আমাদের পরিবার সুখী পরিবার ছিল। ঝগড়া কী জিনিস আমরা জানতাম না। অনেক সময় শুনতাম এর সমস্যা, ওর সমস্যা… কিন্তু আমাদের মধ্যে কখনওই ঝগড়া ছিল না। ডল ছিল অভিষেকের চোখের তারা। সেই মানুষকে নিজে চোখে চলে যেতে দেখব আমি ভাবতেও পারি না।
আমার খালি, প্রতিমুহূর্তে অভিষেকের শেষ কয়েকটা মিনিট মনে পড়ছে। হন্ট করছে। ফিরে ফিরে আসছে সবটা। আমার হাতে মাথা রেখে ও চলে গেল… আমি এখন কী নিয়ে থাকব?
চলে যাওয়ার আগেও, শেষ মুহূর্তেও বলছিল, ‘ডল ঠিক আছে তো!’ ডল আমাদের সঙ্গেই শুত। কিন্তু সেই রাতে ছিল না। ডলের ঘরটা অভিষেকই রেনোভেট করছিল। তাই ডল অন্য ঘরে শুয়েছিল। আমাদের বাড়িতে গতকাল যাঁরা যাঁরা এসেছেন, দেখেছেন কী খারাপ ছিল অবস্থা। কারণ কাজ চলছিল। সবটাই অভিষেকই করাচ্ছিল। শেষ মুহূর্তেও প্রাণ বেরনোর সময়ও ডলের কথাই বলে যাচ্ছিল বার বার।
সে দিন রাতে (মৃত্যুর রাতে) আমি দেখলাম অভিষেকের গ্যাস হচ্ছে। অস্বস্তি হচ্ছে শরীরে। আমি ওষুধ খেতে দিই। কিছুটা শান্তি পায়। সব শেষ মুহূর্তের কথা আপনাকে বলছি। সিগারেট খেতে চাইছিল। সিগারেট ধরানোর চেষ্টা করছিল। কিন্তু পারছিল না। ওর হাত কাঁপছিল। হাত থেকে সিগারেটটা পড়ে গেল। আমি তুলে নিজেই জ্বালিয়ে দিলাম। ও মুখে দিল। কিন্তু ব্লো করতে পারল না। তারপরই খুব জোরে নিঃশ্বাস নিতে লাগল। সেই দৃশ্যে দেখে আমি আরও ভয় পেলাম।
ধীরে-ধীরে দেখতে পেলাম ওর কথাগুলোও কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে। জড়িয়ে-জড়িয়ে যাচ্ছে। আমি ভয়ে অ্যাম্বুল্যান্স ডাকছি আর দেখছি অভিষেক আমার হাতেই দম ছাড়ছে… আমি বুঝতে পারছিলাম যে ও চলে যাচ্ছে… শেষ নিঃশ্বাস নিচ্ছে। ওই দৃশ্যটা আমাকে বার বার হন্ট করছে… বার বার…
শুটিং করেছিল। আমরা শুটিং ক্যান্সেল করতে চেয়েছিলাম। তার আগের দিন ‘খড়কুটো’র সেটে ছিল। সেখানেই শরীরটা খারাপ হতে শুরু করেছিল। সেট থেকে ফোন করে বলেছিল, ‘বউদি আপনি দাদাকে বাড়ি নিয়ে যান’। গিয়ে দেখি থরথর করে কাঁপছে। এসবই হচ্ছিল ফুড পয়েজ়নিংয়ের জন্য। ওকে অ্যালার্জির ওষুধ দিয়েছিলাম। কাঁপুনি কমেছিল। বাড়ি নিয়ে আনার সময় স্টুডিয়োর বাইরেই বমি করে দিয়েছিল। তারপর আরাম পেয়েছিল। কিন্তু কিছুতেই দাঁড়াতে পারছিল না। নিম্ন রক্তচাপ হয়েছিল।
সেই জন্যই পরের দিনের শুটিংটা ক্যান্সেল করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ডেটের প্রেশারের জন্য যেতেই হয়েছিল। সেখানে গিয়েও দাঁড়াতে পারছিল না। ওখানে গিয়েও শুয়েছিল। বমি করেছে। ‘ইস্মার্ট জোড়ি’র সেট থেকেই ডাক্তারের সঙ্গে ভিডিয়ো কনফারেন্স করে। ডাক্তার স্যালাইন দিতে বললেন। ডাক্তারই বলেন, হাসপাতালে নয়তো বাড়িতে নিয়ে যান। এবারও হাসপাতালে যেতে চায়নি অভিষেক। বাড়ি আসতে চেয়েছিল। স্যালাইন দেওয়ার জন্য লোক এল বাড়িতেই। সেসময় ওর শিরা খুঁজে পাননি তাঁরা। স্যালাইন দিতে আসা ব্যক্তিরা পরদিন সকালে স্যালাইন দেওয়ার কথা বললেন। কিন্তু সেই সকালটা আর এল না।
অভিষেককে হাসপাতালে নিয়ে গেলে আজ এই দিনটা আমাদের দেখতে হতে না। কিন্তু কিছুতেই হাসপাতালে ভর্তি হতে চাইত না। ওর কথা শোনা আমাদের ঠিক হয়নি।
জানেন তো আমার আর অভিষেকের ম্যাট্রিমোনিয়াল সাইটে বিজ্ঞাপন দেখে বিয়ে। ও কিন্তু তখন ছবি থেকে অনেকটাই সরে এসেছে। তবে ওর মুখে শুনেছিলাম, একসময় হাতে কোনও কাজই ছিল না। ঠাকুর ঘরে গিয়ে ৩-৪ ঘণ্টা খালি পুজো করে যেত…
আমাদের মেয়ে ডল। ওর বাবার নয়নের মণি। আপাতত ঠিক আছে, জানেন। মনে হয়তো অনেককিছু চলছে ওর। কিন্তু আমাকে ও-ই সামলাচ্ছে এখন…
(অনুলিখনের ভিত্তিতে লিখিত)
আরও পড়ুন: Abhishek Chatterjee Demise: ‘হয়তো ওঁর মনের মধ্যে অনেক ক্ষোভ ছিল,’ কাঁদতে-কাঁদতে কেন বললেন ঋতুপর্ণা?