Tarun Majumdar: ‘আমাকে তো লাথি মেরে বের করে দেওয়া হল…’, অনীক দত্তের কাছে কেঁদে আক্ষেপ তরুণ মজুমদারের

EXCLUSIVE: ঠিক কেন লাথি মেরে বের করে দেওয়া হয়েছিল ৯২ বছরের কিংবদন্তি পরিচালক তরুণ মজুমদারকে?

Tarun Majumdar: ‘আমাকে তো লাথি মেরে বের করে দেওয়া হল...’, অনীক দত্তের কাছে কেঁদে আক্ষেপ তরুণ মজুমদারের
তরুণ মজুমদারের আরোগ্য কামনায় অনীক দত্ত।
Follow Us:
| Edited By: | Updated on: Jul 04, 2022 | 11:46 AM

অনীক দত্ত

গত কয়েকদিন তরুণ মজুমদার হাসপাতালে ভর্তি। প্রথমে শুনলাম তিনি এসএসকেএম হাসপাতালের উডবার্ন ওয়ার্ডে রয়েছেন। যিনি আমাকে কথাটি জানিয়েছিলেন, তিনি বলেছিলেন, অনেকদিন বাদে সত্যি-সত্যিই কেউ অসুস্থ হয়ে উডবার্ন ওয়ার্ডে ভর্তি হয়েছেন। তারপরই তরুণ মজুমদারের শারীরিক অবস্থা সঙ্কটজনক হয়ে যায়। তাঁকে স্থানান্তরিত করা হয় সিসিইউতে। আমি অনেকদিনের জন্য বিদেশ চলে যাচ্ছি। ওঁর এই শারীরিক অবস্থার কথা শুনে দৌড়ে হাসপাতালে গিয়েছিলাম দেখতে…

কিছুদিন আগের কথা। তরুণবাবু সিনেমা হলে আমার ‘অপরাজিত’ ছবিটা দেখতে এসেছিলেন। এই খবর পেয়ে সেদিন আমি দৌড়ে গিয়েছিলাম সিনেমা হলে। পৌঁছে দেখি, শো প্রায় শেষ হতে চলেছে। শেষ হওয়ার কিছুক্ষণ পর তরুণবাবু মাথায় হাত দিয়ে বসেছিলেন…

তারপর উঠে এসে আমাকে হঠাৎ জড়িয়ে ধরেন তরুণবাবু। আগে ২-৩ বার ওঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। কখনও এরকম অতিরিক্ত আবেগপ্রবণ হতে দেখিনি ওঁকে (তিনি নিশ্চয়ই আবেগপ্রবণ, না হলে এরকম সুন্দর-সুন্দর ছবি তৈরি করতে পারতেন না)। আগে সেরকমভাবে আমার সঙ্গে তরুণ মজুমদারের দেখা হয়নি। ওঁর রাজনৈতিক-সামাজিক অবস্থান সম্পর্কেও সেভাবে কিছু জানতাম না। ছোটবেলায় ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’ দেখে প্রভুত আনন্দ পেয়েছিলাম। তারপর টিভিতে ওঁর তৈরি অনেক ছবি দেখেছি। যে ছবিগুলি তথাকথিক বাণিজ্যিক ও আর্ট ফিল্মের মধ্যে সেতুবন্ধুন ঘটিয়েছিল। সেটা চিরকালই খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে মনে হয়েছে আমার। বাঙালি পরিচালকদের সেরা ৫ কিংবা ৬-এ যাঁরা রয়েছেন, তাঁদের মধ্যে তিনিই শেষ জীবিত মোহিকান।

হাসপাতালে তরুণবাবুর শরীরে অত নল ঢোকানো অবস্থায় রয়েছে দেখে আমার ভাল লাগছিল না। চোখ বন্ধ ছিল। আমার কথায় চোখ খুললেন। কথা বলতে পারলেন না। হাল্কা মাথা নাড়লেন। আমি বললাম, ‘‘শুনুন আমি বাইরে থেকে আসছি, আপনি কিন্তু থাকবেন। লড়াই করবেন… হোল্ড অন।’’

আমার মনে হয় বড়সড় রেট্রো গোছের একটা কিছু করা উচিত। এতদিন তা হয়নি কেন, ভগবানই জানেন। অনেক ক্ষোভ জমে আছে তরুণবাবুর মনে। এটা হয়তো এখন বলার সঠিক সময়ও নয়। চিরকাল সকলকে ‘আপনি’ সম্বোধন করে কথা বলেন মানুষটা। যখন আমার ছবি ‘ভবিষ্যতের ভূত’ হল থেকে নামিয়ে দেওয়া হয়, ওই বয়সে তিনি সশরীরে এসেছিলেন। কোথা থেকে জেনেছিলেন আমি জানি না। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ফোন করেছিলেন। বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, অপর্ণা সেন নিজে থেকে এসেছিলেন। প্রথম যেদিন প্রতিবাদ হল, তরুণবাবু সকলের আগে এসে হাজির হয়ে চাঁচাছোলা ভাষায় বক্তৃতা রেখেছিলেন।

এখনও মানুষটা ঋজুভাবে থাকেন। ঋজুভাবে কথা বলেন। আমার খালি মনে হয়, মানুষটাকে আমরা সম্মান জানাতে পারলাম না… যে সম্মান তাঁর প্রাপ্য ছিল। আজ বলেই ফেলি তাহলে, যদি দুর্ভাগ্য়বশত সত্য়িই উনি আর ফিরে না আসেন, তাহলে বলব এই সব বন্দুক-টন্দুক না দাগিয়ে মানুষটাকে সম্মান দেওয়া হোক। সেটাই মনে হয় উনি চান। মৃণাল সেন যেমন শান্তভাবে চলে গেলেন। সেরকম…

কেবল ছোট্ট দু’টো লাইন আমি বলতে চাই, আজ যা না বলে আর থাকতে পারছি না:

‘অপরাজিত’ দেখে আমাকে তিনি কাছে টেনে নিয়ে বলেছিলেন, ‘‘আপনি কী করে ফেলেছেন, তা নিজেই জানেন না। আপনারাই পারবেন বাংলা ছবিকে এই পঙ্কিল পরিস্থিতি থেকে মুক্তি দিতে।’’ পঙ্কিল অবস্থা বলতে তিনি কী বাংলা ছবির মানের কথা বলেছিলেন, নাকি চারপাশের অস্বস্তিকর পরিবেশের কথা বলেছিলেন, বলতে পারব না। আর একটা জিনিস আমার ভীষণ মনে হয়েছে, তখন উনি কাঁদছিলেন আর বলছিলেন, ‘‘আমাকে তো লাথি মেরে বের করে দেওয়া হল…’’ তরুণবাবুর মুখ থেকে উচ্চারিত এই কথাটা আমাকে ভয়ানকভাবে নাড়িয়ে দিয়েছিল সেদিন। আমি চুপ করে গিয়েছিলাম। কিছুই বলতে পারিনি, সত্যি…

তরুণবাবুর যে যোগ্য সম্মান পাওয়ার কথা, সেটা দিতে না পারলেও, তাঁকে যেন কোনওভাবেই অসম্মান না করা হয়। শুনলাম, একজন আপাত রাজনৈতিক নেতা (তিনি এখন ভার্চুয়াল বিদূষকও) নাকি সিসিইউতে ঢুকে ফেসবুক লাইভ করতে চেয়েছিলেন। ৭-৮জন লোক নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। তাঁদের বাইরে বের করে দেওয়া হয়। আর একজন খোঁজখবর নিতে এসেছিলেন। তলাতেই ফটো-অপ সেরে চলে গেলেন। তরুণবাবু নিষেধ করে রেখেছিলেন।

এটাই বুঝলাম, তরুণবাবু কথা বলতে না পারলেও মাথা নাড়তে পারছেন। অবস্থা সঙ্কটজনক হলেও স্থিতিশীল। আমি চাই উনি ফিরে আসুন। আগের মতো চলাফেরা করুন। কথা বলুন। মানুষটার যে রকম মনের জোর দেখেছি, তাতে তিনি লড়াই করতে পারবেন। এতদিন লড়াই করে এসেছেন। শারীরিক লড়াইটা কতদিন করতে পারবেন, সেটা অবশ্য জানি না। কিন্তু মন বলছে পারবেন। আমাদের অভিভাবক তিনি। আমাদের ফোনে খুব একটা কথা হত না। কিন্তু কিছু একটা হলেই কথা হত। ওঁর মতো অভিভাবক কোথায় পাব এখন?