‘এই দুনিয়া ঘোরে বনবন…ছন্দে ছন্দে কত রঙ বদলায়…রঙ বদলায়’…
রঙ বদলাচ্ছে প্রতিনিয়ত। আসন্ন নির্বাচনের আগে পশ্চিমবঙ্গে এখন ‘লাল নীল সবুজ আর গেরুয়ার মেলা বসেছে’। ঠিক যেন রোলার কোস্টার রাইড। বুধবার বিজেপিতে যোগদান করেছেন অভিনেতা যশ দাশগুপ্ত। আর আজ বৃহস্পতিবার বিজেপিতে যোগদান করলেন টলিপাড়ার আরও এক চেনা মুখ হিরণ চট্টোপাধ্যায়। সেই হিরণ যিনি একটা সময় তৃণমূলের যুব কংগ্রেসের সহ সভাপতিও ছিলেন। সেই হিরণ যিনি একসময় পরিচিত ছিলেন তৃণমূল নেতা মদন মিত্রের ঘনিষ্ঠ হিসেবেও। সেই হিরণ যার বাড়িতে বসে একদা লাইভ করেছিলেন মদন মিত্র। তাই হিরণের দলবদলের খবর প্রকাশ্যে আসতেই টিভিনাইন বাংলার কাছে মদন মিত্রর আক্ষেপ, “কষ্ট পেয়েছি”। তারপরেই গেয়ে উঠলেন, “আজ দু’জনার দুটি পথ ওগো দু’টি দিকে গেছে বেঁকে…”। আর হিরণ? “মদনদা’র সঙ্গে সম্পর্ক একই থাকবে… এই তো কয়েক দিন আগেও কথা হল…”, বললেন তিনি।
হিরণ যে বিজেপিতে যোগ দিতে পারেন সেই ‘গোপন কথাটি ছিল না গোপনে’। এক মাস আগে থেকেই আকার ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন অভিনেতা। গত বছর ২৩ জুলাই তৃণমূলের যুব কংগ্রেসের যে তালিকা প্রকাশ্যে এসেছিল তাতে ছিল না হিরণের নাম। হিরণের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বললেন, “মানুষের দুঃখ কষ্ট বঞ্চনা দেখে বড় হয়েছি। কর্মসূত্রে অভিনয় করলেও আমি তো সাধারণ মানুষ। সিস্টেমের পরিবর্তন আনতে চাইলে সবচেয়ে বড় হাতিয়ার রাজনীতি। করতাম কুড়ি বছর ধরে। তৃণমূল সরকার ক্ষমতায় এলে ভাবলাম আমূল পরিবর্তন হবে। ৩৪ বছরের অপশাসন থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে… দেখলাম কিছু মানুষের পরিবর্তন হল, উন্নয়ন হল… বাংলার উন্নয়ন বলতে নীল-সাদা রঙ…”।
বিশেষ সূত্র বলছে, বারংবার তৃণমূলে নিজের অবস্থান সম্পর্কে আশাহত হিরণকে বিজেপি ‘টার্গেট’ করেছিল বেশ অনেক দিন ধরেই। অথচ হিরণ জানাচ্ছেন, শেষ মুহূর্তেও রাজ্য সরকারের তরফে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করে ‘সমস্যা’ জানার চেষ্টা করাই হয়নি। হিরণের কথায়, “আমি কিন্তু রাজ্য সরকারের সঙ্গে যুক্ত সরকারের কোনও কমিশনারেট ছিলাম না, মাইনেও পাইনি। তৃণমূল দলটাকে ভালবেসেছিলাম। স্বপ্ন দেখেছিলাম সাধারণ মানুষের জন্য কর্মসংস্থান হবে।” এর পরেই তৃণমূল যুব কংগ্রেসের সভাপতি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে পরোক্ষে কটাক্ষ করে হিরণের বক্তব্য, “আমি আমার সভাপতিকে বার বার ফোন করেছি, এসএমএস করেছি। হোয়াটসঅ্যাপ করেছি। তাঁর সহকারীকে ফোন করেছি। তাঁর সহকারী বারবারেই বলেছেন সভাপতি ব্যস্ত। সেটা একমাস, দু’মাস, তিন মাস নয়। বছরের পর বছর ধরে তিনি ব্যস্ত থাকেন। কিন্তু যেই নির্বাচন চলে আসে তাঁর সহকারী আমায় তালিকা পাঠিয়ে দিয়ে বলেম যাও নির্বাচনী প্রচার করে চলে এস। আমার কাছে এই কার্যকরী সভাপতি, সহ সভাপতির অর্থ স্পষ্ট ছিল না।”
যদিও মদন মিত্র পাল্টা দাবি করেছেন, হিরণকে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় অনেক সম্মান দিয়ে কাজকর্ম করাতেন। তাঁর কথায়, “বহু বিধানসভায় ও কাজ করেছে। এখন কী কমিটির ব্যাপার সে ব্যাপারে আমি বলতে পারব না। তবে আমি তৃণমূল যুব কংগ্রেসের সভায় দেখেছি তাঁকে দিয়ে খুবই সম্মানের সঙ্গে পার্টির অনেক কাজ করানো হয়েছে।”
হিরণ জানাচ্ছেন ‘মেরে দেব’, ‘কেটে ফেলব’, ‘কবজি কেটে নেব’র রাজনীতির সঙ্গে নিজেকে জড়াতে চাইছেন না বলেই তাঁর রঙবদল। প্রশ্ন হল, বর্তমানে যে দলের সঙ্গে তিনি যুক্ত সেই দল থেকে যদি কোনও হিংসাত্মক কাজকর্ম হয় সেক্ষেত্রে তিনি কী করবেন? আবারও দলবদল? প্রশ্ন শেষ করতে না দিয়েই হিরণ বললেন, “দিন কয়েক আগে বিজেপির এক নেতা এক অভিনেত্রীকে যৌনকর্মী বলেছিলেন তখন তো প্রতিবাদ করেছিলাম। কার অধিকার রয়েছে এমন কথা বলার? বিজেপি থেকে ক্ষমাও চেয়ে নেওয়া হয়। এমন নয় যে, আমি এই দল থেকে ওই দলে চলে গেলাম বলে সেই দলের সব কিছু ভাল হয়ে গেল, তা তো নয়। যদি দলের কোনও কর্মীর মন্তব্য খারাপ লাগে তবে আবার প্রতিবাদ করব।”
তবে হিরণ চলে যাওয়ায় মন ভাল নেই মদন মিত্রর। বললেন, “কেউ যদি কোথাও যেতে চায় আটকাতে পারব না। হিরণ ছোট ভাই। ওকে স্নেহ করতাম। ওর পরিবারের সঙ্গেও সদ্ভাব ছিল। হিরণ শুধু নয়, বিজেপিতে যে বা যারাই চলে গেল তাঁরা শত্রু নয়, তবে প্রিয়জন আর থাকল না। হিরণকে নয়, ঈশ্বরকে বলব, হে ঈশ্বর ও জানে না ও কী করছে… তুমি ওকে ক্ষমা কোরো” অন্যদিকে হিরণের বক্তব্য যে দলেই তিনি যান না কেন, মদন মিত্রের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক আগের মতোই থাকবে।
অভিনেতা যশ জানিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রীর আশীর্বাদ নিয়েই বিজেপির সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন তিনি। আজ হিরণের বিজেপিতে যোগদান নিয়ে মদন মিত্রের বক্তব্য, “দিদির আশীর্বাদ নিয়ে তবে সবাই মিলে বিজেপির মধ্যে তৃণমূলের একটা সমর্থক দল তৈরি কর।” দলবদলের এই সিদ্ধান্ত মদন-হিরণের ব্যক্তিগত সম্পর্কে আদৌ প্রভাব ফেলবে কি না তা তো সময়ই বলবে তবে ফোন রাখার আগে হিরণের উদ্দেশে একটা টুলাইনার হাওয়ার ভাসিয়ে দিলেন মদন মিত্র। ‘মদন মিত্র স্টাইলে’ বললেন, ” (তৃণমূলের) জার্সি থাকলে হিরো, খুলে নিলেই জিরো…”।