বাংলা ছবির পাশে দাঁড়ান, গত কয়েকবছর ধরে এই স্লোগান যেন ২০২৪-এর শেষে এসে সার্থক। এখন রমরমিয়ে চলছে বাংলা ছবি। গোটা বাংলা জুড়ে একের পর এক ছবি হাউসফুল। তবে কেবল বাংলাই নয়, ভারত পেরিয়ে বাংলাদেশেও বাংলা ছবির জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। টলিউড-ঢালিউডের সম্পর্ক বরাবরই বেজায় পোক্ত। দুই দেশের বাংলা ছবির দর্শকটানতে একযোগে ছবি তৈরি হয়েছে একাধিক। কখনও ফিরদৌস এসেছেন কলকাতায়, কখনও আবার ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত গিয়েছেন ওপারে। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে দুই বাংলার একযোগে ছবির ব্যবসা বেজায় চিন্তার ভাঁজ ফেলছে সিনেপ্রেমীদের কপালে। দিন-দিন ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক জটিল হয়ে উঠছে। আর দেশের অভ্যন্তরে এমন টালমাটাল পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে এর প্রভাব পড়ে প্রতিটি ক্ষেত্রের উপর। ওপার বাংলার আয়ের একটি বড় অংশ নির্ভর করে চলচ্চিত্রের ব্যবসা এবং সংস্কৃতির উপর।
কিছু দিন আগে পর্যন্তও ভারত-বাংলাদেশ যৌথভাবে বাংলা ছবির ব্যবসাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ভাবনা ভেবেছে। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্কে টানাপড়েন যেন বিপদ সঙ্কেত। সেই প্রভাব কি তবে পড়বে বাংলা ছবির ব্যবসার উপরও? ভারত-বাংলাদেশের যৌথ প্রযোজনায় একের পর এক ছবি উপহার পেয়েছেন দর্শক। আব্দুর রজ্জাক, বাপ্পারাজ থেকে বর্তমানে চঞ্চল চৌধুরী, শাকিব খান- এক দিকে বাংলাদেশের নায়করা যেমন কলকাতায় নিজেদের পসার বাড়িয়েছেন। আবার ঠিক তেমনই এ পার বাংলার ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত, জিত্, দেব থেকে মিমি চক্রবর্তী, পাওলি দাম-সহ একাধিক অভিনেতা অভিনেত্রীরা ওপার বাংলায় নিজেদের জমি শক্ত করেছেন। কিন্তু এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে ভারত-বাংলাদেশের তিক্ত সম্পর্কের জেরে মাশুল গুনতে হচ্ছে বা হবে কি দুই দেশের অভিনেতাদের?
২০২৩ সালে বাংলাদেশের ওটিটি প্ল্যাটফর্ম ‘চর্কি’ কলকাতায় এসে বড় চমক দিয়েছিল। একগুচ্ছ ওয়েব সিরিজের ঘোষণা করেছিল তাঁরা। যে সিরিজগুলিতে অভিনয় করার কথা ছিল এ পার বাংলার অনেক অভিনেতা-অভিনেত্রীদের। তেমনই আবার অন্য দিকে কলকাতার অন্যতম সফল ওটিটি প্ল্যাটফর্ম ‘হইচই’ও নিজেদের পরিধি বাড়িয়েছে ওপার বাংলায়। ইতিমধ্য়েই ‘হইচই অরিজিন্যালস’-এ ওপার বাংলার অনেক সিরিজ দেখে ফেলেছেন দর্শক। সেই তালিকায় রয়েছে ‘ঢাকা মেট্রো’, ‘তাকদির’, ‘মহানগর’-এর মতো বেশ কিছু সিরিজ। ফলে দুই বাংলার অভিনেতা অভিনেত্রীদের কাজের পরিধিও বেড়েছিল অনেকটা। তাই তো শহরে যখন ‘হাওয়া’ মুক্তি পেয়েছিল লাইন দিয়ে দর্শক সেই ছবি দেখেছিলেন। সব জায়গায় বাজছিল একটাই গান ‘সাদা সাদা কালা কালা’। এমনকি কলকাতা চলচ্চিত্র উত্সবেও অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরীকে বিশেষ সম্মান দেওয়া হয়েছিল। এই সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান শুধু ছবির ব্যবসা নয়, পারস্পরিক বন্ধনকেও আরও মজবুত করার একটা বড় পদক্ষেপ, এমনটাই মনে করেছিলেন কলকাতার প্রযোজক, পরিচালকদের একাংশ।
২০২৪ সালের জুলাই মাস থেকে পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটে। পাল্টে যায় চেনা সমীকরণ। আর সেই উত্তপ্ত পরিস্থিতি যে ভারত-বাংলাদেশ সুসম্পর্কে অনেকটাই প্রভাব ফেলেছে তা বোঝা গিয়েছে সদ্য সমাপ্ত কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবেই। এই বছর কলকাতার আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উত্সবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ওপার বাংলার কোনও অভিনেতাদের যেমন দেখা যায়নি তেমনই সাত দিনের চলচ্চিত্র উত্সবে বাংলাদেশের ছবি দেখানো হয়নি। দেখা যায়নি বাংলাদেশের কোনও অতিথিকে। শোনা যাচ্ছে, চলতি বছরের কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলাতেও বাংলাদেশ অনুপস্থিত থাকবে। এছাড়া, বাংলাদেশ যেভাবে হুমকির সুরে কথা বলছে তাতে ওপার বাংলার শিল্পীদের প্রতি বিরূপ মনোভাব তারি হচ্ছে ভারতের একাংশের জনগণের মধ্যে।
বহু বার দুই দেশের যৌথ প্রযোজনা সাফল্য পেয়েছে দুই বাংলাতেই। সম্প্রতি মিমি চক্রবর্তীর আইটেম সং ‘উরা ধুরা’ গানটি ওপার বাংলায় চুটিয়ে ব্যবসা করেছে। তেমনই আবার ইধিকা পালের প্রিয়তমা মন মজিয়েছে দুই বাংলায়। তবে বর্তমান বাংলাদেশের পরিস্থিতি যে সিনেমা ব্যবসায় অনেকটাই ক্ষতি করেছে এমনই ধারণা করছেন পরিচালক-প্রযোজকদের একাংশ । কেউ কেউ আবার সেই মতের বিরোধিতাও করেছেন। একাংশের মত, পশ্চিমবঙ্গের বাংলা ছবিতে হয়তো সেই রকম প্রভাব পড়বে না। এ প্রসঙ্গে পরিচালক গৌতম ঘোষের দাবি, আসলে যে কোনও দেশ অশান্ত হলে তার প্রভাব শুধু চলচ্চিত্র জগত্ নয়, বহু ইন্ডাস্ট্রির উপরই পড়ে। প্রযোজক ফিরদৌসুল হাসান বলেন, “ভারতের চেয়েও বাংলাদেশে ভাল ব্যবসা করেছিল ‘হুব্বা’। তাই পরিকল্পনা করেছিলাম ওপার বাংলাতেও প্রচার করব। কিন্তু এই মুহূর্তে আমরা ছবিটা নিয়ে ওখানে সে ভাবে কিছু পরিকল্পনা করতে পারছি না।” বাংলাদেশের পরিস্থিতি যখন চরম উত্তপ্ত সেই সময় সেখানে শুটিং করছিলেন অভিনেত্রী পাওলি দাম। পরিস্থিতির জন্য তাঁকে দেশে ফিরে আসতে হয়। নায়িকার কথায়, “যদি ছবির শুটিংটা শেষ করে আসতে পারতাম, তাহলে ভাল হত।” ইন্ডাস্ট্রির অন্দরের বিশিষ্টজনদের দাবি, এপার বাংলায় ছবির ব্যবসায় তেমন প্রভাব না পড়লেও যৌথ প্রযোজনা বা যে আদান-প্রদান তৈরি হয়েছিল সেই রাস্তা হয়তো বিঘ্নিত হতে পারে।
সম্প্রতি যে ছবি গুলিতে ওপার বাংলার অভিনেতারা কাজ করছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল প্রতিম ডি গুপ্তর ছবি ‘চালচিত্র ‘, এই ছবিতে রয়েছেন বাংলাদেশের অভিনেতা জিয়াউল ফারুক অপূর্ব। অনিরুদ্ধ রায় চৌধুরীর ছবিতে রয়েছেন জয়া আহসান। অন্যদিকে, বাংলাদেশের পরিচালক রায়হান রফির ছবিতে কাজ করছেন অভিনেতা জিৎ। যদিও এই পরিস্থিতি প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে অভিনেতা চিরঞ্জিত চক্রবর্তীর কথায় ক্ষোভ ধরা পড়েছে। অভিনেতা বলেন, “প্রথমত, আমাদের হিরোদের ওরা ওখানে ঢুকতে দেয় না। ওদের হিরোরা এখান থেকে কিছু নায়িকাদের নিয়ে যায় ওপার বাংলার নায়কদের সঙ্গে অভিনয় করার জন্য।” যদিও বর্তমান পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়েও দুই বাংলার সিনেশিল্পীদের একাংশ একযোগেই কাজ করার স্বপ্ন দেখে চলেছেন। পরিকল্পনা মাফিক দুই বাংলার নায়ক-নায়িকাদের কাছেই পৌঁছে যাচ্ছে কিছু কিছু ছবির প্রস্তাব। টাইম-লাইন মেনে সে সব কাজ যথা সময় শিডিউল করাই রয়েছে। উত্তপ্ত পরিস্থিতির জন্য কোনও ছবির কাজ বাতিল হলেও হতে পারে, তবে ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্কের কথা মাথায় রেখে কোনও প্রজেক্টই স্থগিত করা হয়নি। ফলে সিনেমার যে কোনও সীমানা হয় না, শিল্পের যে কোনও ভাষা নেই, তা যেন আরও একবার প্রমাণিত। তবে টাকার অঙ্কে ক্ষতির পরিমাণ বজায় থাকার অশনি সংকেত বর্তমান।