মেঘা মণ্ডল
গত দু’বছরে ‘জ্বর’ যে স্বাভাবিক নয়, তা বুঝিয়ে দিয়েছে করোনা। করোনা পরিস্থিতিতে জ্বর হলে প্যারাসিটামলই ছিল মানুষের প্রাথমিক ভরসা। কিন্তু জ্বর হলে প্যারাসিটামলই কি একমাত্র ভরসা? এখন করোনা পরিস্থিতি আশঙ্কার বাইরে। কিন্তু সমাজ থেকে ‘জ্বর’ বিদায় নেয়নি। পুজোর মরশুমে রোজ শ’য়ে-শ’য়ে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন ডেঙ্গিতে। কলকাতা এবং পার্শ্ববর্তী জেলার সঙ্গে সঙ্গে এখন নতুন করে দুশ্চিন্তা বাড়িয়েছে উত্তর ও দক্ষিণ বঙ্গের ১০টি জেলা। দুই বঙ্গের ওই ১০ জেলায় এক সপ্তাহে কোথাও আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েছে দেড়-দু’ গুণ। আবার কোথাও আক্রান্ত বেড়েছে ৮ গুণ পর্যন্ত। অর্থাৎ রাজ্যে ডেঙ্গি ভয়াবহ রূপ ধারণ করছে। জ্বরের সঙ্গে গলা ব্যথা, গা-হাত-পায়ে যন্ত্রণা দেখা দিচ্ছে। অবস্থার অবনতি ঘটলে প্লেটলেটের সঙ্গে শরীরে অক্সিজেনের মাত্রাও কমে যাচ্ছে। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ প্রথম দু’দিন জ্বর হয়েছে বলে প্যারাসিটামল খেয়েই কাজ চালিয়ে দেন। সাত দিন পরেও যখন জ্বর কমছে না, তখন নড়েচড়ে বসেন। এনএস-১ পরীক্ষা করালে ধরা পড়ে জ্বরে কাহিল ব্যক্তি ডেঙ্গিতে আক্রান্ত হয়েছেন কি না। এই মরশুমে যখন দ্রুত হারে বেড়ে চলেছে ডেঙ্গি আক্রান্তের সংখ্যা, তখন জ্বর নিয়ে ছেলেখেলা করার কি আদৌ উচিত? TV9 বাংলার সঙ্গে রোগের ভয়াবহতা তুলে ধরছেন সংক্রামক রোগের চিকিৎসক অমিতাভ নন্দী। আজ, শনিবার তৃতীয় পর্ব।
তিনি যা বললেন…
চিকিৎসকেরা বার বার বলছেন, ‘জ্বর হয়েছে, সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তার দেখান’। দেরি করা মানেই বিপদ ডেকে আনা। দেরি করার অর্থ জীবাণুটাকে দীর্ঘদিন শরীরের মধ্যে পুষে রাখা। এই ঋতুতে যেহেতু ডেঙ্গি বাড়ছে, আর আপনি যেহেতু মশারি ব্যবহার করছেন না, তাই-ই মশা দ্বারা আপনার পাশাপাশি এই রোগ আরও পাঁচটা মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে যাচ্ছে। প্রথমদিনই যদি আপনি জেনে যান যে ডেঙ্গি বা ম্যালেরিয়া হয়েছে, তাহলে দ্রুত চিকিৎসা সম্ভব। এতে ওষুধের মাধ্যমে রোগের জীবাণু দ্রুত দমন করা সম্ভব হবে। আর যদি আপনি দেরি করেন, এক সপ্তাহ পরে চিকিৎসকের কাছে যান তাহলে রোগ নির্ণয়েও দেরি হবে। আর এই সময়কালের মধ্যে আপনি রোগটা আরও পাঁচ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেবেন। শুধু তা-ই নয়, যত দেরিতে চিকিৎসা শুরু হবে জটিলতা তত বাড়বে। ঠিক সময় চিকিৎসা শুরু করা না হলে ডেঙ্গিতে পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি এবং তার জেরে মানুষের মৃত্যু অবধি হতে পারে। পাশাপাশি দেখা দিতে পারে নানা শারীরিক সমস্যা। শরীরে তৈরি হতে পারে রক্তাল্পতার সমস্যা। এমনকী লিভার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে। কিন্তু মুমূর্ষু অবস্থায় রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে ডাক্তারদেরও তখন কিছু করার থাকে না।
ঘটনা হচ্ছে, ১৫ থেকে ২০ শতাংশ মানুষ ডেঙ্গি, ম্যালেরিয়ায় মারা যায়। বাকি ৮০ শতাংশ মানুষ চিকিৎসার সাহায্যে সুস্থ হয়ে ওঠে। তার কারণ আমাদের শরীরের ইমিউনিটি সিস্টেম। যখনই আমাদের শরীরে কোনও জীবাণু প্রবেশ করে, তখন আমাদের শরীরের অ্যান্টিবডিগুলো প্রতিক্রিয়া দেখায়। এক পর্যায় পর্যন্ত, যতক্ষণ শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী থাকে, ততক্ষণ ওই জীবাণুগুলো শরীরের কোনও ক্ষতি করতে পারে না। এরপর প্রয়োজন পড়ে চিকিৎসার। এবার কিছু কিছু মানুষের মধ্যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এতটাই বেশি থাকে যে, ন্যূনতম চিকিৎসার পরই তারা সুস্থ হয়ে ওঠে। এক্ষেত্রে বেশিরভাগ মানুষ সাহায্য নেন প্যারাসিটামলের মতো জ্বরের ওষুধের। কিন্তু এমন ঘটনায় ২০ থেকে ২৫ শতাংশ মানুষ সাময়িকভাবে সুস্থ হয়ে উঠলেও তাদের শরীর জটিলতার দিকে এগিয়ে যায়। এই সম্পর্কে মানুষ সচেতন নয় কারণ এগুলো প্রচারের আলোয় আসছে না। প্রচারের আলোয় আসতে দেওয়া হচ্ছে না। রাজ্যে মানুষ ডেঙ্গি আক্রান্ত—এটা তো সরকারের ব্যর্থতা।
একটা সময় রাতের বেলা শহর পরিষ্কার করা হত। এর বৈজ্ঞানিক ভিত্তি ছিল। এতে কারও সমস্যা হত না। রাস্তায় যানজট তৈরি হত না। আবর্জনায় তৈরি হওয়া জীবাণু মানুষের মধ্যে ছড়াত না। কিন্তু এখন দিনের বেলা পরিষ্কার করা হয়। আর সেই পরিষ্কারও যে সঠিকভাবে হয়, তা কিন্তু নয়। ডেঙ্গি জাতীয় রোগের পিছনে কোনও একটা কারণ দায়ী নয়। অবক্ষয় হতে-হতে এখন তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। আগে ডেঙ্গির মতো অসুখ ঋতুকালীন ছিল। আর এখন সারা বছর মানুষ ডেঙ্গি আক্রান্ত হন।
সারা বছর ধরে যে কর্মকাণ্ডগুলো করার কথা, সেগুলো না করলে কোনওভাবেই এ ধরনের রোগকে দমন করা যাবে না। আর এই সমাজ পরিষ্কার রাখার বিষয়টা মানুষের অভ্যাসে আনতে হবে। এটাকে বলা হয় Knowledge Attitude Practice (KAP)। এটা সব ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। এখানে সরকারের বিশাল বড় ভূমিকা রয়েছে। যে সরকারই আসুক না কেন, এই সমাজ গড়ে তোলা সরকারেরই দায়িত্ব। সরকারকে নজরদারি রাখতে হবে আর এটা সারা বছর ধরে করতে হবে। ঠিক যেমন হেলমেট ছাড়া বাইক চালানো অপরাধ, তেমনই যত্রতত্র মল-মূত্র ত্যাগ করাও অপরাধ। কিন্তু এখন মানুষ কারও তোয়াক্কা করে না। এই ধরনের রোগগুলো মানুষের জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। সুতরাং, পরিবেশকে বাদ দিয়ে কিছু হবে না।
অলঙ্করণ: অভীক দেবনাথ