AQI
Sign In

By signing in or creating an account, you agree with Associated Broadcasting Company's Terms & Conditions and Privacy Policy.

Explained: এনার্জি ড্রিঙ্ক কতটা ‘বিষ’? বিকল হচ্ছে কিডনি থেকে নার্ভ

মনঃসংযোগে ঘাটতি, মুড সুইংস, ফ্যাটিগ, কাজ করার ইচ্ছা কমে আসা, এমনকী বাইরে বেরোনো, অন্যদের সঙ্গে কথা বলতে চাওয়ার প্রবণতাও কমতে শুরু করে। এক আধ দিনে না হলেও মাত্র কয়েক মাসেই একজন সুস্থ যুবক বা যুবতী, কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে এইসব প্রবণতা দেখতে পাওয়া যায় বলে দাবি চিকিৎসকদের।

Explained: এনার্জি ড্রিঙ্ক কতটা 'বিষ'? বিকল হচ্ছে কিডনি থেকে নার্ভ
| Edited By: | Updated on: Aug 25, 2025 | 9:31 PM
Share

এনার্জি ড্রিঙ্ক এখন আর অচেনা পানীয় নয়। কোল্ড ড্রিঙ্ক/ঠান্ডা পানীয়র মতোই হাতে হাতে ঘোরে। বিশেষত কিশোর-কিশোরী বা যুব সম্প্রদায়ের কাছে এনার্জি ড্রিঙ্ক এখন যেন খানিকটা স্টাইল স্টেটমেন্টের মতো। বিশেষত, শহুরে, অবস্থাপন্ন ঘরের যুবক-যুবতীদের কাছে। আজ ঠান্ডা পানীয়-র বাজারের বেশ খানিকটা এখন নামী দামি ব্র্যান্ডের এনার্জি ড্রিঙ্কের দখলে। নামকরা চিত্রাভিনেতা, খেলোয়াড়, সুপারস্টাররা বিজ্ঞাপন করছেন। আর তাই দেখেই একাংশের যুবক-যুবতীরা এইসব এনার্জি ড্রিঙ্কে আকৃষ্ট ও পরে আসক্ত হয়ে পড়ছেন। অনেকেই প্রায় প্রতিদিন-ই বিভিন্ন ব্র্যান্ডের এই জাতীয় পানীয় সেবন করেন। ২০২৫-এ ভারতের প্রায় ১ বিলিয়ন ডলারের এনার্জি ড্রিঙ্ক বিক্রির সম্ভাবনা রয়েছে। আগামী বছর তা বেড়ে দ্বিগুণ হওয়ার সম্ভাবনা।

কিন্তু কতটা বিপজ্জনক এই ড্রিঙ্ক জানেন কি? আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম ডেইলি মেইলে প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হচ্ছে, ক্যানের পর ক্যান এনার্জি ড্রিঙ্ক সেবনে শরীরে টক্সিক ওভারডোজ হতে পারে। চিকিৎসকদের আশঙ্কা, বিপদ কিন্তু এই ড্রিঙ্কের মধ্যে থাকা অতিরিক্ত চিনি বা ক্যাফিনের মধ্যে লুকিয়ে নেই। বরং ঘাপটি মেরে আছে এক অন্য জায়গায়।

বিপদের নাম ভিটামিন বি-৬। এনার্জি ও মনঃসংযোগ বাড়ানোর লোভ দেখানো এই সব এনার্জি ড্রিঙ্কে থাকে ভিটামিন বি-৬। যা মাছ, পোলট্রির ডিম ও মাংস, আলুর মধ্যে স্বাভাবিক মাত্রায় থাকে। এই ভিটামিন মস্তিষ্ক ও স্নায়ুর স্বাস্থ্য ভাল রাখে, কিন্তু অবশ্যই অল্প মাত্রায় শরীরে গেলে। কিন্তু স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি মাত্রায় এই ভিটামিন শরীরে প্রবেশ করলে ‘পেরিফেরাল নিউরোপ্যাথি’ বা স্নায়ুর দুর্বলতা তৈরি করতে পারে। কী হয় সেক্ষেত্রে? প্রাথমিকভাবে হাত-পা দুর্বল লাগা, জ্বালা ভাব, ফোলাভাব তৈরি হয়। শুধু তাই নয়, পরবর্তীতে হার্টে রক্ত সঞ্চালনকেও প্রভাবিত করতে পারে। ভারতে প্রতিবছর ৫৭০ মিলিয়ন লিটারেরও বেশি এই জাতীয় পানীয় সেবন করা হয়।

একাধিক নামের আড়ালে বেশ কিছু ওষুধ, মাল্টি-ভিটামিন সাপ্লিমেন্ট ও ওজন কমানোর ওষুধে ভিটামিন বি-৬ থাকে। কখনও তার নাম পাইরিডক্সিন, পাইরিডক্সল বা পাইরিডক্সিমাইন। এতদিন সে সব নিয়ে কেউ মাথা ঘামায়নি। কিন্তু গত মাসে অস্ট্রেলিয়ায় ওষুধ নিয়ামক সংস্থা ‘দ্য থেরোপিউটিক গুডস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন‘ বা ‘টিজিএ’ আচমকাই দেশজুড়ে ভিটামিন বি-৬-এর অতিরিক্ত সেবনে একাধিক বিষক্রিয়ার ঘটনার হদিশ পায়। প্রায় ২০০-র কাছাকাছি এরকম ঘটনা ধরা পড়ে। নিয়ামক সংস্থার আশঙ্কা, ধরা পড়েনি এমন ঘটনার সংখ্যা আরও অনেক বেশি। ব্রিটেনের জনস্বাস্থ্য নিয়ামক সংস্থা ‘ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস’ বা ‘NHS’-এর বেঁধে দেওয়া মাত্রা অনুযায়ী, ভিটামিন বি-৬ প্রতিদিন ১.৪ মিলিগ্রামের বেশি একজন পুরুষের দেহে ও ১.২ মিলিগ্রামের বেশি একজন মহিলাদের দেহের জন্য ভাল নয়। ১০ মিলিগ্রামের বেশি শরীরে ঢুকে গেলে অবিলম্বে চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার পরামর্শ দেয় NHS। ব্রিটেনের সরকারি সংস্থার দাবি, বহুল বিক্রিত একটি এনার্জি ড্রিঙ্কের ২৫০ মিলিলিটারের ক্যানে ৪.৫ মিলিগ্রামের বেশি ভিটামিন বি-৬ থাকে যা মানবদেহের স্বাভাবিক সহনমাত্রার চেয়ে অনেকটাই বেশি। আর কেউ যদি একদিনে ৩টি এনার্জি ড্রিঙ্কের ক্যান সেবন করে, তাহলে বুঝতেই পারছেন, কতটা বিপজ্জনক পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।

অস্ট্রেলিয়ার টিজিএ-র নিয়ম বলছে, ৫০ মিলিগ্রামের চেয়ে অনেক কম মাত্রায় ভিটামিন বি-৬ শরীরে ঢুকলেই নার্ভ ড্যামেজের সম্ভাবনা তৈরি হয়। একধাপ এগিয়ে ইউরোপীয় ফুড সেফটি অথরিটি তার মাত্রা বেঁধে দিয়েছে ১২ মিলিগ্রামে। লন্ডনের ইম্পিরিয়াল কলেজের টক্সিলজি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক অ্যালান বুবিস তাঁর সাম্প্রতিক গবেষণা রিপোর্টে লিখেছেন, এনার্জি ড্রিঙ্কের অতিরিক্ত সেবনে অজান্তেই বিপদ ডেকে আনছে অনেকে। বিশেষ করে যুব সম্প্রদায়। একটানা এই অনিয়ম চলতে থাকলে নার্ভ ড্যামেজ থেকে শুরু করে ধীরে ধীরে একজন মানুষ পেরিফেরাল নিউরোপ্যাথি-র দিকে এগিয়ে যায়। কারণ, প্রতিদিনের খাবার থেকে মানুষের শরীর স্বাভাবিক মাত্রার ভিটামিন জোগাড় করে নেয়। এনার্জি ড্রিঙ্কের মাধ্যমে অতিরিক্ত ভিটামিন শরীরে প্রবেশ করলে বিপদ ঘনিয়ে আসতে পারে। তিনি সতর্ক করে বলেছেন, উৎসবের মরশুমে এক আধ ক্যান খাওয়া পর্যন্ত ঠিক আছে। কিন্তু নিয়ম করে প্রতিদিন একাদিক ক্যান সেবন বিপদ ডেকে আনতে সময় নেবে না। বিশ্বে তো বটেই, ভারতেও এই জাতীয় পানীয়-র টার্গেট অডিয়েন্সের বয়স ৩৫ বছরের নিচে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এক্ষেত্রে গোদের উপর বিষফোঁড়া হয়ে এই ধরনের এনার্জি ড্রিঙ্ক ডেকে আনে ডায়াবেটিসের আশঙ্কাও। একেই ভিটামিন বি-৬-এর অতিরিক্ত প্রবেশে স্নায়ু দুর্বল হতে শুরু করে, তার উপর এইসব পানীয়ে থাকা চিনি মধুমেহও বয়ে আনে। ভারতে প্রায় ৮ কোটি মানুষ ইতিমধ্যেই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। এনার্জি ড্রিঙ্কে থাকা বাড়তি চিনি, ক্যাফিন ও টরিনের মতো উপাদান আচমকাই রক্তচাপ বাড়িয়ে দেয়, এমনকী ডিপ্রেশনও ডেকে আনে। বাড়তি বিপদ ডেকে আনে বিভিন্ন বার-এ মদের সঙ্গে এই জাতীয় এনার্জি ড্রিঙ্ক মিশিয়ে পান করার প্রবণতা। বিশেষত চালকদের ক্ষেত্রে এটি খুব বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে। মহারাষ্ট্র, পঞ্জাবের মতো রাজ্যে শিশুদের এনার্জি ড্রিঙ্ক বিক্রি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু সে সব খাতায় কলমে। নিয়মের ফাঁক গলে দেশজুড়ে এই ট্রেন্ড চলছেই। FSSAI প্রতি লিটারে ৩০০ মিলিগ্রামের বেশি ক্যাফিন নিষিদ্ধ করলেও কারও হুঁশ নেই। অনেক পানীয়-ই ৩২০-৩৫০ মিলিগ্রামেরও বেশি ক্যাফিন এনার্জি ড্রিঙ্কে মিশিয়ে দেদার বিক্রি করছেন বলে অভিযোগ। দেশের নানা প্রান্তে বহুবার এই অভিযোগ উঠলেও প্রতিবারই উপযুক্ত নজরদারির ফাঁক গলে ছাত্রছাত্রী, ড্রাইভার, এমনকী হার্টের রোগীদেরও এই জাতীয় পানীয় অবাধে বিক্রি করা হয়।

ভারতের মতো ইউরোপ জুড়েও নাবালকদের মধ্যে স্নায়ুর রোগ, মধুমেহ বাড়ার পিছনে নামীদামি সংস্থার বিজ্ঞাপনে আকৃষ্ট হয়ে এইসব পানীয়-র সেবনকেই দায়ী করছেন চিকিৎসকরা। সবচেয়ে বড় কথা, অজান্তেই যুবক-যুবতীদের মনঃসংযোগে ঘাটতি, মুড সুইংস, ফ্যাটিগ, কাজ করার ইচ্ছা কমে আসা, এমনকী বাইরে বেরোনো, অন্যদের সঙ্গে কথা বলতে চাওয়ার প্রবণতাও কমতে শুরু করে। এক আধ দিনে না হলেও মাত্র কয়েক মাসেই একজন সুস্থ যুবক বা যুবতী, কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে এইসব প্রবণতা দেখতে পাওয়া যায় বলে দাবি চিকিৎসকদের। ফার্মাসিস্টরাও বলছেন, অন্যান্য স্বাভাবিক উৎসের পাশাপাশি শরীরে ভিটামিন বি-৬ অতিরিক্ত মাত্রায় প্রবেশ করলে বড় বিপদ ওঁৎ পেতে অপেক্ষা করছে।

সম্প্রতি ২৩ বছরের এক অস্ট্রেলীয় মহিলা সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হন নার্ভের সমস্যা নিয়ে। চিকিৎসকদের জানান, তাঁর মাসল ক্র্যাম্প হচ্ছে, মাথা ঘুরছে। তাঁর সম্প্রতি একটি সার্জারি হয়েছিল। তিনি মনে করছিলেন এই সব সমস্যার প্রাথমিক কারণ তাঁর সার্জারি হতে পারে। চিকিৎসকরা তাঁকে পরীক্ষা করে বুঝতে পারেন, আসলে তাঁর শরীরে ভিটামিন বি-৬-এর অধিক্যই নার্ভ সংক্রান্ত সমস্যার আসল কারণ। এমনকী তাঁর মাথায় কম বয়সেই টাক পড়তে শুরু করে দেয়। রক্ত পরীক্ষায় ধরা পড়ে, তাঁর শরীরে ভিটামিন বি-৬-এর অতিরিক্ত মাত্রার জন্য তাঁর কিডনিও প্রায় নষ্টের মুখে। এক্ষেত্রে মূল কালপ্রিট এনার্জি ড্রিঙ্ক। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরও তিনি ঠিকভাবে হাঁটতে পারছেন না, গাড়ি চালাতে জানলেও চালাতে পারছেন না।