ন্যাশানাল ক্রাইম ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী আত্মহত্যার কারণে মৃত্যুর হার পুরুষদের মধ্যে বেশি। কিন্তু ১৪ শতাংশের বেশি আত্মহত্যার ঘটনায় শিকার গৃহবধূ। তাছাড়া আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি বাড়িয়ে তোলে আত্মহত্যার প্রবণতা। তথ্য বলছে পশ্চিমবঙ্গ আত্মহত্যার ঘটনার তালিকায় চতুর্থ স্থানে রয়েছে। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, পরিস্থিতি খুব একটা ইতিবাচক ইঙ্গিত দিচ্ছে না। গতকাল বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবসে TV9 বাংলার তরফে যোগাযোগ করা হয় ইনস্টিটিউট অফ সাইকায়াট্রি (আইপিও)-র শিক্ষক-চিকিৎসক তথা ইন্ডিয়ান সাইকিয়াট্রিক সোসাইটি-র সুইসাইড প্রিভেনশন সেল-এর কো-অর্ডিনেটর মনোচিকিৎসক সুজিত সরখেলের সঙ্গে। তিনি জানান, কম বয়সীদের মধ্যে কেন বাড়ছে আত্মহত্যার প্রবণতা। আজকের আলোচনায় রয়েছে আত্মহত্যাপ্রবণতার লক্ষণ-সহ নানা বিষয়। আজ দ্বিতীয় পর্ব।।
প্রশ্ন: ১৪ শতাংশের বেশি আত্মহত্যার ঘটনায় শিকার গৃহবধূ। প্যান্ডেমিক কি গৃহবধূদের উপর অত্যাচার বা হিংসার ঘটনা বাড়িয়ে দিল?
ন্যাশানাল ক্রাইম ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, বছরের পর বছর ধরে মহিলাদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। আর এখানে গৃহবধূদের সংখ্যাটা বেশি। আগে বলা হত, অবিবাহিত মহিলাদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। কিন্তু ভারতীয় মহিলাদের বিয়ে মানসিক চাপটা বাড়িয়ে তুলছে। এটা আত্মহত্যার পথ বেছে নেওয়ার অন্যতম কারণ। অন্য পরিবারে গিয়ে অ্যাডজাস্টমেন্ট করা, পণপ্রথা, গার্হস্থ্য হিংসা—এগুলো আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়িয়ে তোলে। তবে, আইনের সাহায্য নিয়ে এবং নারীর ক্ষমতায়নের কারণে মহিলাদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা আগের চেয়ে কমেছে। প্যান্ডেমিকের কারণে সামগ্রিক আত্মহত্যার হার বেড়েছে কিন্তু প্যান্ডেমিকের কারণে গৃহবধূদের উপর অত্যাচার বেড়েছে কি না এই বিষয়ে কোনও তথ্য নেই। লকডাউনে বাড়ির সদস্যরা অনেকটা সময় একসঙ্গে কাটিয়েছে, যেখানে আগে তারা এতটা সময় একসঙ্গে থাকত না। এই ধরনের অ্যাডজাস্টমেন্ট আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়িয়েছে। এছাড়াও লকডাউনের কারণে অনেক মানুষ চাকরি হারিয়েছে—এই ধরনের মানসিক চাপ আত্মহত্যার পথ বেছে নেওয়ার অন্যতম কারণ।
প্রশ্ন: Well Being যে এখন দৈনন্দিন জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ, সেটা বুঝতে পারছেন সকলেই। Urban Sphere-এ অর্থাৎ নাগরিক সভ্যতায় অভ্য়স্ত মানুষদের কাছে এই Well Being-এর ধারণা কি আসলে সোনার পাথরবাটি কারণ নগরজীবন ভীষণভাবে ASPIRATION-এ বিশ্বাসী এক আর্থ-সামাজিক অবস্থা?
Aspiration কমে গেলে মানুষের overall বৃদ্ধি কমে যায়। Aspiration কখনওই Well Being-কে আটকায় না। কিন্তু আমাদের যদি নিয়ন্ত্রিত আকাঙ্ক্ষা থাকে তাহলে এটা আমাদের ভাল থাকা, ভাল লাগা এই বিষয়গুলোকে বাড়িয়ে তোলে। কিন্তু জীবনে সব কিছুরই একটা পরিমাপ থাকা দরকার। তা না হলে সেগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে Aspiration তো আমাদের হাতে থাকে না। যেমন অফিসের কাজ। অফিসের কাজ অনেক ক্ষেত্রে মানসিক চাপ বাড়িয়ে তোলে। এখানে আপনাকে বেছে নিতে আপনি কোনটি বিষয়টিকে প্রাধান্য দেবেন। ধরুন যখন আপনি অফিসের কাজ করছেন তখন ওটার উপরই মনোনিবেশ করবেন। আবার যখন পরিবারের সঙ্গে ছুটি কাটাতে যাবেন তখন অফিসের নিয়ে ভাববেন না। তবেই মানসিক চাপ কমানো যাবে এবং বাকি দিনের কাজগুলো অনেক মসৃণভাবে করতে পারবেন। সবসময় কাজ নিয়ে ভাবলে চলবে না। পরিবার, বন্ধু সবকিছুকেই সমানভাবে গুরুত্ব দিতে হবে। আর একটি বিষয় হল, সবসময় সবকিছুকে ‘হ্যাঁ’ বললে চলবে না। কখনও কখনও ‘না’ বলতেও শিখতে হবে। যদি বিষয় নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় তাহলে কাউকে আপনি ভাল রাখতে পারবেন না। তাই মাঝে মাঝে কেউ অখুশি হলেও আপনাকে ‘না’ বলতে হবে।
প্রশ্ন: আত্মহত্যার ঘটনার তালিকায় চতুর্থ স্থানে রয়েছে আমাদের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ—এর পিছনে কী-কী কারণ রয়েছে বলে আপনার মত?
বহু বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গ আত্মহত্যার ঘটনার তালিকায় তৃতীয় স্থানে ছিল। বিগত দু’বছরে আত্মহত্যার ঘটনার তালিকায় পশ্চিমবঙ্গ চতুর্থ স্থানে এসেছে। যদি আত্মহত্যার হার দিয়ে বিবেচনা করা হয়, সেখানে পশ্চিমবঙ্গ অনেকটা পিছনে রয়েছে। এর পিছনে কী-কী কারণ দায়ী তার আলাদা কোনও তথ্য আপাতত উপলব্ধ নেই। তবে এখানে কয়েকটা বিষয় উল্লেখ করা যায়। এক, যে সব জায়গায় জনসংখ্যা বেশি, সেখানে survival strategy, স্ট্রেস—এই ফ্যাক্টরগুলো কাজ করে। অর্থাৎ যেখানে জনসংখ্যা বেশি সেখানে হয়তো কর্মসংস্থানের সুযোগ কম—এই ধরনের বিষয় কাজ করে। দ্বিতীয়, প্যান্ডেমিকে সব জায়গায় আত্মহত্যার সংখ্যা বেড়েছে, সেখানে পশ্চিমবঙ্গ ব্যতিক্রম নয়। এছাড়া যদি আর্থ-সামাজিক কারণে আত্মহত্যার ঘটনা বৃদ্ধি পেয়ে থাকে তাহলে সেরকম কোনও তথ্য আপাতত নেই। তবে সংখ্যার নিরিখে পশ্চিমবঙ্গ বেশ উপরের দিকে রয়েছে তাই নীতিকরণের মাধ্যমে এই বিষয়টির উপর জোর দেওয়া জরুরি।
প্রশ্ন: আত্মহত্যাপ্রবণতার চিহ্ন বলে কি কিছু হয়? হলে তা কী-কী?
আত্মহত্যাপ্রবণতার চিহ্ন বা warning sign—এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। একজন মানুষ কতটা ঝুঁকিতে রয়েছে এটা মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বেশি ভাল করে বুঝতে পারবে। কিন্তু পরিবারের ক্ষেত্রে এই বিষয়টা বোঝা একটু কঠিন। সেক্ষেত্রে কিছু কিছু ‘warning sign’ রয়েছে। যেমন একটা হল মানসিক অবসাদের লক্ষণগুলো যদি তীব্র হয়। অর্থাৎ কারও সঙ্গে কথা বলা একদম বন্ধ করে দেওয়া, সারাদিন মনমরা হয়ে থাকা, খাওয়া-দাওয়া না করা, বন্ধু-বান্ধব সবার থেকে নিজেকে আলাদা করে নিয়েছে, কেউ কথা বলতে চাইলে বিরক্ত প্রকাশ করছে। দ্বিতীয়ত, ধরুন খুব কাছের জিনিস কাউকে দান করে, কিংবা কারও নামে লিখে দিচ্ছে—এই ধরনের বিষয়গুলো আত্মহত্যার ইঙ্গিত দেয়। এছাড়াও খুব বেশি নেশা করা অর্থাৎ যে নেশা করত না বা অল্প নেশা করত, হঠাৎ করে সে প্রচণ্ড বেশি নেশা শুরু করেছে। ৮০% ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে যার মাথায় আত্মহত্যার বিষয় ঘুরপাক খায়, সে সেটা সম্পর্কে কথা বলতে থাকে। এটা একটা বড় লক্ষণ যা একেবারেই অবহেলা করা উচিত নয়। এছাড়াও অনেকে ডায়েরি কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ায় আত্মহত্যার কথা বলা। আর একটা বড় লক্ষণ হল মানসিক অবসাদ থেকে সেরে ওঠা। ডিপ্রেশন কাটিয়ে ওঠার পর এনার্জি লেভেলটাও অনেকটা বেড়ে যায়। ওই এনার্জি লেভেলে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে কিংবা এক-দু’দিনের মধ্যেই কেউ কেউ আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। তাই এই ডিপ্রেশন কাটিয়ে ওঠার এই যে পর্যায়ে এই সময় ব্যক্তির বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে।