গত ১৫ নভেম্বর বিশ্বের জনসংখ্যা পৌঁছেছে ৮০০ কোটিতে। সম্প্রতি রাষ্ট্রসঙ্ঘের তরফে জানানো হয়েছে এই তথ্য। কিন্তু রাষ্ট্রসঙ্ঘের এই তথ্য প্রকাশ্যে আসার পর বিজ্ঞানী থেকে শুরু করে চিকিৎসক, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করতে শুরু করেছেন সম্পূর্ণ একটি অন্য বিষয় নিয়ে। না, জনসংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ে নয়। বরং তাঁদের চিন্তা ভবিষ্যত পৃথিবীতে ঘটতে-চলা প্রজননজনিত সমস্যা। এবং এর জন্য বিশেষজ্ঞরা মহিলাদের পিসিওডি ও অন্যান্য প্রজননজনিত জটিলতা অথবা সমস্যাকে দায়ী করছেন না। বিশ্বজুড়ে পুরুষদের মধ্যে শুক্রাণুর সংখ্যা ও তার ঘনত্ব হ্রাস পাচ্ছে—এটাই উদ্বেগ তৈরি করেছে বিজ্ঞানীদের মধ্যে। একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, বিশ্বজুড়ে পুরুষদের মধ্যে শুক্রাণুর সংখ্যা দ্রুত গতিতে হ্রাস পাচ্ছে, যা ভবিষ্যত পৃথিবীর প্রজনন স্বাস্থ্যের উপর ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলবে।
২০১৭ সালের একটি গবেষণা বলছে, গত চার দশকে শুক্রাণুর সংখ্যা অর্ধেকেরও বেশি কমে গিয়েছে। যদিও ওই গবেষণার ফলাফল ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডের পুরুষদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। ‘হিউম্যান রিপ্রোডাকশন আপডেট’ জার্নালে প্রকাশিত ওই গবেষণায় ৫৩টি দেশের ২২৩টি ঘটনা বিশ্লেষণ করা হয়েছে, যেখানে ৫৭,০০০ জন পুরুষের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য পরীক্ষা করা হয়েছিল। এটি এখনও পর্যন্ত হওয়া বিশ্বের সর্ববৃহৎ সমীক্ষা যেখানে শুক্রাণুর সংখ্যা ও ঘনত্ব পরীক্ষা করা হয়েছে।
ওই গবেষণা থেকে যে তথ্য উঠে এসেছিল, তা সত্যিই উদ্বেগজনক। উদ্বেগের অন্যতম কারণ ১৯৭৩ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে পুরুষদের মধ্যে প্রতি মিলিমিটার সিমেন অর্থাৎ বীর্যে শুক্রাণুর ঘনত্ব কমেছে ৫০ শতাংশেরও বেশি। ১৯৭৩ সালে প্রজননে সক্ষম পুরুষ বা infertile পুরুষের মধ্য়ে শুক্রাণুর ঘনত্ব (প্রতি মিলিমিটার সিমেন অর্থাৎ বীর্যে) যেখানে ছিল ১০ কোটি ১২ লক্ষ, সেখানে পরবর্তী ৪৫ বছরে সেই ঘনত্বের পরিমাণ কমে ২০১৮-য় দাঁড়িয়েছে ৪ কোটি ৯০ লক্ষ শুক্রাণুতে (প্রতি মিলিমিটার সিমেন অর্থাৎ বীর্যে)। অর্থাৎ হিসেব অনুযায়ী, প্রতি মিলিমিটার সিমেন অর্থাৎ বীর্যে শুক্রাণুর ঘনত্ব ৫১ শতাংশেরও বেশি কমেছে ওই ৪৫ বছরে। প্রতি মিলিমিটার বীর্যে যেখানে শুক্রাণুর ঘনত্ব কমেছে ৫১ শতাংশ, সেখানে ওই একই সময়ে অর্থাৎ ১৯৭৩ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে মোট শুক্রাণুর সংখ্যা কমেছে ৬২.৩%। প্রতি বছর ১.১৬% করে কমছে শুক্রাণুর ঘনত্ব। ২০০০ সালের পর যে তথ্য পরীক্ষা করা হয়েছিল, তাতে শুক্রাণুর সংখ্যা হ্রাসের হার প্রতি বছর দ্বিগুণ হয়ে যাচ্ছে। সেখানে ২.৬৪% করে কমছে শুক্রাণুর ঘনত্ব। পাশাপাশি প্রতি বছর স্পার্ম কাউন্ট প্রায় ১.১% হারে কমছে। এখান থেকে স্পষ্ট যে, পুরুষদের মধ্যে এই শুক্রাণুর সংখ্যা ও ঘনত্ব—দুই-ই কমছে। আর এর প্রভাব সরাসরি পড়ছে প্রজনন স্বাস্থ্যে।
ওই গবেষণার প্রধান লেখক অধ্যাপক হাগাই লেভিন জানিয়েছেন, মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকা ও এশিয়ার পুরুষদের মধ্যে এই সমস্যা সবচেয়ে বেশি। এই তালিকায় নাম রয়েছে ভারতীয় পুরুষদেরও। গবেষকরা জানিয়েছেন, পুরুষের এই শুক্রাণুর সংখ্যা ও ঘনত্ব হ্রাস হওয়া মহিলাদের গর্ভধারণের সম্ভাবনাকেও কমিয়ে দেয়।
এখানেই শেষ নয়। পুরুষদের মধ্যে শুক্রাণুর সংখ্যা ও ঘনত্ব হ্রাস পাওয়ার পাশাপাশি এটি পুরুষদের স্বাস্থ্যের উপরও ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলছে। প্রজনন স্বাস্থ্যের পাশাপাশি পুরুষদের মধ্যে টেস্টিকুলার ক্যানসার, হরমোনের তারতম্য, যৌনাঙ্গের সমস্যা দেখা দেয়। আইকান স্কুল অফ মেডিসিনের অধ্যাপক শান্না সোয়ান জানিয়েছেন, এই কম শুক্রাণুর সংখ্যা টেস্টিকুলার ডিসজেনেসিস সিন্ড্রোমের সঙ্গেও যুক্ত হতে পারে। এমনকী পুরুষদের মধ্যে শুক্রাণুর সংখ্যা মহিলাদের প্রজনন স্বাস্থ্যেরও অবনতি ঘটায়।
উল্লেখযোগ্যভাবে শুক্রাণু সংখ্যা ও ঘনত্ব হ্রাস পাওয়ার পিছনে ঠিক কী-কী কারণগুলো দায়ী, তা এখনও স্পষ্ট নয়। তবে বিশেষজ্ঞদের একাংশের দাবি, দূষণ, প্লাস্টিকের ব্যবহার, ধূমপান, মদ্যপান, স্থূলতা, জীবনযাপন অর্থাৎ লাইফস্টাইল, বিভিন্ন ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও শুক্রাণুর সংখ্যা ও ঘনত্ব হ্রাস পাওয়ার জন্য দায়ী হতে পারে।