নয়া দিল্লি: ১৯৩১ সালে ভারতে শেষবার জাতিভিত্তিক আদমশুমারি হয়েছিল। তারপর থেকে গত নয় দশকে অনেক কিছু বদলে গিয়েছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে, ডেমোগ্রাফি বদলে গিয়েছে। তবে, জাতিভিত্তিক আদমশুমারি আর না হওয়াতে দেশে বর্তমান জাতিগত উন্নয়নের ছবিটা স্পষ্ট নয়। বর্তমানে বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল জাতীয় স্তরে জাতিভিত্তিক জনগণনার দাবি তুলছে। বেশ কয়েকটি রাজ্য সরকার, রাজ্য স্তরে এই ধরনের জনগণনা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আবার রাজনৈতিক মহল ও সমাজের একাংশ থেকে এই জনগণনার বিরোধিতাও করা হচ্ছে। এই অবস্থায় জাতিভিত্তিক জনগণনা সম্পর্কে মুখ খুললেন ভারতের অন্যতম প্রধান দলিত কণ্ঠস্বর সুরজ ইয়েংদে। সম্প্রতি তাঁর লেখা বই ‘কাস্ট ম্যাটার্স’ গোটা দেশে সাড়া ফেলেছে। নিউজ৯ প্লাসকে এক একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছেন, তথাকথিত অগ্রসর জাতি-সহ কোনও জাতিরই জাতিভিত্তিক জনগণনা নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ নেই। আসুন জেনে নেওয়া যাক, কী বলছেন তিনি।
সুরজ ইয়েংদের মতে, বর্তমান সময় আমাদের দেশের অবস্থার বিশ্লেষণের জন্য সেরা সময়। উৎসবের সময় সকলে সকলে ঘর পরিষ্কার করে, নতুন করে ঘর গোছায়। ১৯৩১ সালের পর থেকে ভারতে তা করা হয়নি। তাঁর মতে, জাতি ভিত্তিক জনগণনা কতোনও সরকারের নীতি নির্ধারণের পক্ষে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ভূমিকা নেবে। ভারতীয় সমাজে জাতিপ্রথা আছে বলে বিভিন্ন জাতি এবং তাদের অগ্রগতির সঠিক খবরাখবর নিবন্ধিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। একবার সেই সব তথ্য পেলে, তা ব্যবহার করে নির্দিষ্ট নীতি নির্ধারণ করা যায়। আমাদের দেশে ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে, ন্যাশনাল স্যাম্পল সার্ভে, সোশিও ইকোনমিক কাস্ট সেন্সাস, এবং ইকোনমিক সার্ভের মতো বিভিন্ন সমীক্ষা চালু থাকলেও শুধুমাত্র জাতির বিষয়ে একটি আদমশুমারি করা উচিত বলে জানিয়েছেন তিনি। সেইক্ষেত্রে দেশের কোও নির্দিষ্ট স্থানে একটি নির্দিষ্ট জাতির অবস্থা সহজেই জানা যাবে।
জাতিভিত্তিক জনগণনা যদি দেশের স্বার্থে নীতি নির্ধারণে সহায়ক হয়, তাহলে এই নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে কেন? সুরজ ইয়েংদের মতে, বিরোধিতা করছে মূলত উচ্চবর্ণের মানুষ। কারণ এই সম্প্রদায়গুলি প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষাধিকার পেয়েছে। এই ধরনের জনগণনা হলে তারা সেই সুবিধা হারাবেন বলে উদ্বিগ্ন। প্রধানমন্ত্রী মোদীর জনসংখ্যাগত পরিচয় হল তিনি ওবিসি। তা না হলে তিনি আজ যেখানে আছেন সেখানে পৌঁছতে পারতেন না। কিন্তু তাঁর উপদেষ্টারা, এই গুরুত্বপূর্ণ ত্রুটিগুলি চিহ্নিত করতে চাইছেন না। এছাড়া ভারতের জাতি বৈচিত্রের অসম প্রতিনিধিত্ব ধরা পড়লে, আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের জন্য বিভিন্ন নীতি পরিবর্তনের প্রয়োজন হবে। তার জন্য সরকারকে টাকা খরচ করতে হবে। স্বীকৃত নয় এমন অনেক জাতির অবস্থাও প্রকাশ পাবে।
তবে, সুরজ ইয়েংদের মতে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল গোষ্ঠীর অধিকার ইতিমধ্যেই সুরক্ষিত। তাই কোনও শ্রেণিরই জাতিভিত্তিক জনগণনা নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত নয়। কারণ এই ধরনের জনগণনা হলে দেশের কোথায় সমস্যা রয়েছে তার একটি সঠিক বিবরণ পাওয়া যাবে। যা এই মুহূর্তে কারোর জানা নেই। পাশাপাশি, এই জনগণনা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উন্নতি ঘটাবে, দেশকে শক্তিশালী করবে। তবে বিভিন্ন জাতির উদ্বেগ দূর করতে এখনও সরকার যথেষ্ট কাজ করে উঠতে পারেনি বলেই দাবি করেছেন এই দলিত নেতা। তাঁর মতে সরকার খাতায় কলমে অনের ভাল উদ্যোগ নিলেও, প্রয়োগের ক্ষেত্রে অনেক ফাঁক থেকে যায়। এই ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। এছাড়া সরকার তাদের জন্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা করলেও, অন্যান্য সংরক্ষিত বিভাগের তুলনায় তাদের আয়ের সুযোগ কম বলে অভিযোগ রয়েছে।
এই অবস্থায় বেসরকারি ক্ষেত্রেও চাকরিতে সংরক্ষণের দাবি তুলেছেন সুরজ ইয়েংদে। আমাদের দেশে সবাই যদি সমান জায়গা থেকে যাত্রা শুরু করত, তাহলে মেধাই একমাত্র বিচার্য বিষয হতে পারত। কিন্তু, জাতির ভিত্তিতে আমাদের দেশে প্রজন্মের পর প্রজন্ম কোনও কোনও জাতি বাড়তি সুবিধা পেয়েছে, কোনও কোনও জাতি বঞ্চিত হয়েছে। এই অবস্থায় বেসরকারি ক্ষেত্রে সংরক্ষণ বেশ ভাল ধারণা বলে মনে করছেন সুরজ। সরকারি ক্ষেত্রে ভারতের ৭ শতাংশেরও কম কর্মসংস্থান হয়। বাকি সবটাই হয় বেসরকারি খাতে। এই সমস্যার সমাধানে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি বিলুপ্ত করার প্রস্তাব দিয়েছেন এই দলিত নেতা। কারণ, কোনও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কোনও নির্দিষ্ট সম্প্রদায় যে বঞ্চনার শিকার হবে না, তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। তাঁর মতে, প্রধানমন্ত্রীর সন্তান থেকে শুরু করে ফেরিওয়ালা – প্রতিটি শিশুর স্কুলে একই শিক্ষার এবং একই জীবনধারার সুযোগ থাকা উচিত।