Premium on Chicken’s Neck: চিনের পর কুনজর বাংলাদেশেরও, মুরগির গলা মটকানো কি এতই সোজা?
Siliguri Corridor: গত সপ্তাহেই অসম পুলিশের এসটিএফ অসম, কেরল ও পশ্চিমবঙ্গে অভিযান চালিয়ে ৮ জন এবিটি-র সদস্যকে গ্রেফতার করে। মুর্শিদাবাদ থেকে গ্রেফতার হয় মণিরুল শেখ, মহম্মদ আব্বাস আলি। জেরায় জানা যায়, আল কায়দার এই শাখা সংগঠনের নিশানা ছিল চিকেনস নেক-ই। গোপনে এরা রাজ্য়ে স্লিপার সেল সক্রিয় করছিল।
দোকানে কখনও মুরগি কাটতে দেখেছেন? একটা মোচড় দিলেই মটকে যায় মুরগির গলা। কেউ বা বঁটির এক কোপে মাথা আর ধড় আলাদা করে দেয় মুরগির। এবার সেই মুরগির গলার দিকেই কুনজর দিয়েছে বাংলাদেশ। চাইছে গলা মটকে দিতে। কিন্তু ওতই কি সোজা? চিন তো সেই কবে থেকে প্যাঁয়ত্যাড়া করছে, তারা পারল না তো বাংলাদেশ কোন ছাড়! তবে ওপার বাংলার এই ‘শূন্য বুলি’কে কিন্তু হালকাভাবে নিচ্ছে না সরকার। চিন্তা বাড়িয়েছে চলতি সপ্তাহেই রাজ্য থেকে গ্রেফতার হওয়া নিষিদ্ধ সংগঠন আনসার-আল-ইসলাম বাংলাদেশের বা আনসারুল্লা বাংলা টিমের ৮ জঙ্গি সদস্য। তার কারণ, এদের জেরা করে জানা গিয়েছে, তলে তলে স্লিপার সেল তৈরি করা হচ্ছিল। এদের লক্ষ্য ছিল এই ‘চিকেনস নেক’কে টার্গেট করা, সেখানে অস্থিরতা ছড়ানো। এই যে চিকেনস নেক নিয়ে এত আলোচনা, কী এই চিকেনস নেক? সত্যিই মুরগির গলা নাকি?
চিকেনস নেক কী?
আসল নয়, মানচিত্রে থাকা মুরগির গলা বা চিকেনস নেকের দিকেই যত কুদৃষ্টি প্রতিবেশী দেশগুলির। কেন এই কুদৃষ্টি, তার জন্য চিকেনস নেকের ভৌগলিক অবস্থান জানা জরুরি। পশ্চিমবঙ্গের শিলিগুড়ি করিডরের আরেক নাম চিকেনস নেক। একদিকে চিন, আরেকদিকে বাংলাদেশ। নেপাল ও ভুটান সীমান্তের মাঝে ১০০ কিলোমিটার জায়গাকে ঘিরেই যত হইচই। মানচিত্রে দেখলে বোঝা যায়, এর অবস্থান এমন, মনে হয় যেন মুরগির গলার আকৃতি।সেখান থেকেই নাম চিকেনস নেকের। মানচিত্রের সরু এই জায়গার ভৌগলিক গুরুত্ব কিন্তু অপরিসীম। উত্তর-পূর্ব ভারতের সঙ্গে দেশের বাকি অংশের যোগাযোগের সূত্র এই চিকেনস নেক। চিকেনস নেকের অন্তর্গত রয়েছে শিলিগুড়ি, মাটিগাড়া, নকশালবাড়ি, ফাঁসিদেওয়া, চোপড়া ও ইসলামপুরের কিছুটা অংশ।
দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ উত্তর-পূর্ব ভারত। তার সঙ্গে দেশের বাকি অংশের সড়ক ও রেলপথে যোগাযোগের জন্য একমাত্র ভরসা এই শিলিগুড়ি করিডর বা চিকেনস নেক।আর শুধু যে উত্তর-পূর্ব ভারতকে জুড়েছে, তা নয়। শিলিগুড়ি করিডরের আন্তর্জাতিক গুরুত্বও রয়েছে যথেষ্ট। এই করিডর ধরেই নেপাল, ভুটানের মতো প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে বাণিজ্য করে ভারত। নেপাল-ভুটানও ভারত সহ অন্যান্য দেশের সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি করতে এই চিকেনস নেকের উপর ভরসা করে।
কেন চিকেনস নেক নিয়ে এত হইচই কেন?
চিকেনস নেকের অবস্থান বুঝলেই, তার গুরুত্বও স্পষ্ট হয়ে যায়। ভৌগলিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই করিডরে কবজা করার চেষ্টা দীর্ঘদিন ধরেই করছে চিন। তালিকায় নতুন সংযোজন বাংলাদেশ। কয়েক বছর আগে ডোকলাম সীমান্তে যখন ভারত ও চিন সেনা মুখোমুখি এসেছিল, তখন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের ঘুম উড়েছিল এই চিকেনস নেক নিয়ে। রাতারাতি শিলিগুড়ি করিডরকে নিরাপত্তার চাদরে মুড়ে ফেলা হয়েছিল। চিনের লাল ফৌজ এই চিকেনস নেকের দিকে নজরদারি করে চুম্বি উপত্য়কা থেকে। চুম্বি থেকে শিলিগুড়ি করিডরে আসতে গেলে নাথু লা, জেলেপ লা, দংচু লা, বাতাং লা ও ডোকা লা- এই গিরিপথ ধরেই আসতে হয়। এর মধ্যে ডোকা লা করিডরের সবথেকে কাছে। যদি চিনের ফৌজ একবার এই পথ ধরে ঢুকে পড়ে, তবে আধ বেলাতেই দার্জিলিংয়ে পৌছে যাবে। অন্যদিকে, ভুটানের হা দিয়েও ডুয়ার্স হয়ে পশ্চিমবঙ্গে ঢুকে পড়া সম্ভব।
পড়শি ভুটানের সীমান্তে ঢুকে পড়ে চিনা ফৌজের আগ্রাসনের খবর প্রায়সই মেলে। চিকেনস নেক নিয়েও আগে একাধিকবার ভারতের চিন্তা বাড়িয়েছে চিন। তবে হাত গুটিয়ে নেই ভারতীয় সেনাও। আগে থেকেই প্রস্তুতি সেরে রেখেছে তারা। এদিক থেকে ওদিক হলেই পাল্টা জবাব দিতে সময় লাগবে না। শিলিগুড়ির কাছেই হাসিমারায় বায়ুসেনার ঘাঁটিও রয়েছে। সেখান থেকে রাফাল আনতেও কোনও সমস্যা হবে না। তাই চিন কিছুটা সমঝেই চলে ভারতকে।
নতুন করে চিন্তা বাড়াচ্ছে নতুন বাংলাদেশ-
একদিকে যেখানে চিন নিয়ে মাথাব্যথা আছেই, সেখানে নতুন চিন্তার কারণ হয়েছে বাংলাদেশ। গত জুলাই-অগস্টে শুরু হওয়া বাংলাদেশে অস্থিরতার মাঝে অনুপ্রবেশের আশঙ্কা আগেই বেড়েছিল। হাসিনা সরকারের পতন ও মহম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর চিত্রটা যেন এক নিমেষে বদলে গিয়েছে। বাংলাদেশের জেল থেকে মুক্তি পাচ্ছে একের পর এক সন্ত্রাসী, বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতারা। অন্যদিকে, কট্টরপন্থী নেতারা আবার ভারতের উপকার ভুলে কখনও কলকাতা দখল, কখনও আবার বাংলা-বিহার-ওড়িশা কিংবা সেভেন সিস্টার্স দখলের হুমকি দিচ্ছে।
সম্প্রতিই বাংলাদেশের গণ অধিকার পরিষদের যুগ্ন সদস্য সচিব তারেক রহমান বলেছিলেন, “ফেণী, চট্টগ্রামে ইকোনমিক জোন দিয়েছেন শেখ হাসিনা। আমি প্রশ্ন করছি, আপনি কি বাংলাদেশের সন্তান ? এরকম সাঙ্ঘাতিক কাজ করলেন কী করে। আমরা কি পারব ভারতে চিকেন নেকে ইকোনমিক জোন তৈরি করতে? এখান নেপাল-ভুটান যাওয়ার রাস্তাটুকু আমরা পাইনি। এভাবে হবে না। আমাদের ওই অর্থনৈতিক অঞ্চলে যেতে হবে। একটা একটা করে ভারতীয়কে লাথ মেরে ভারত সীমান্তে ঢুকিয়ে দিয়ে আসতে হবে”। অর্থাৎ সরাসরি চিকেনস নেক দখলের হুঁশিয়ারি।
আবার আনসার আল ইসলাম প্রধান জসিমউদ্দিন রহমানিও হুমকি দিয়ে বলেছেন, “ভারতকে সাবধান করছি। বাংলাদেশের দিকে খবরদার কুনজর দেবে না। বাংলাদেশ, নেপাল কিংবা ভুটান নয়! এদিকে চোখ তুলে তাকালে সেই চোখ উপড়ে ফেলা হবে। যদি বাংলাদেশের দিকে এক পা বাড়়াও, আমরা চিনকে বলে দেব, সেভেন সিস্টার, চিকেন’স নেক বন্ধ করে দেব“। এ তো গেল হুমকি। আসল বিপদ তো লুকিয়ে অন্য জায়গায়।
চিকেনস নেক দখল করার ফন্দি আঁটছে বাংলাদেশ?
বাংলাদেশে অস্থিরতার মধ্যেই ভারতে ঢুকে পড়েছে আনসারুল্লা বাংলার জঙ্গিরা। গত সপ্তাহেই অসম পুলিশের এসটিএফ অসম, কেরল ও পশ্চিমবঙ্গে অভিযান চালিয়ে ৮ জন এবিটি-র সদস্যকে গ্রেফতার করে। মুর্শিদাবাদ থেকে গ্রেফতার হয় মণিরুল শেখ, মহম্মদ আব্বাস আলি। জেরায় জানা যায়, আল কায়দার এই শাখা সংগঠনের নিশানা ছিল চিকেনস নেক-ই। গোপনে এরা রাজ্য়ে স্লিপার সেল সক্রিয় করছিল। লক্ষ্য ছিল, স্লিপার সেলের মাধ্যমে অস্ত্র সংগ্রহ করে তা দিয়ে শিলিগুড়ি করিডরে অস্থিরতার সৃষ্টি করা। দেশ বিরোধী কার্যকলাপে যুক্ত হতে যুবকদের প্রলোভনও দেখাচ্ছিল এরা। মূল টার্গেট ছিল মুর্শিদাবাদ ও আলিপুরদুয়ার। এই দুই জায়গাতেই স্থানীয় যুবকদের জঙ্গি সংগঠনের কাজে লাগানো হচ্ছিল বলে সূত্রের।
তদন্তে আরও জানা যায়, আনসারুল্লা বাংলার প্রধান, জসিমউদ্দিন রহমানির ঘনিষ্ঠ ইসরাতের নির্দেশেই গত নভেম্বরে ভারতে অনুপ্রবেশ করে জঙ্গিরা। অসম ও বাংলায় স্লিপার সেল তৈরির ছক কষছিল তারা। বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের একাধিক জঙ্গির সঙ্গেও যোগাযোগ ছিল তাদের।
গোয়েন্দা সূত্রে আরও খবর, নেপাল থেকে চিকেনস নেক দিয়ে অস্ত্র পাচারের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। বাংলাদেশ, অসম ও বাংলায় অস্ত্র পৌঁছনোর পরিকল্পনা ছিল। পাক হ্যান্ডেলারের মাধ্যমে অস্ত্র আসার কথা ছিল মডিউলের কাছে। এমনকী ফালাকাটায় এই নিয়ে পরপর বৈঠক করে জঙ্গি সন্দেহে গ্রেফতার হওয়া ধৃত মুজিবর ও মণিরুল ইসলাম।
কী করছে ভারত?
হাত গুটিয়ে নেই ভারতও। বাংলাদেশের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সীমান্তগুলিতে নজরদারি, পাহারা আগেই বাড়ানো হয়েছে। এবার চিকেনস নেকে নজরদারি চলবে ড্রোনের মাধ্যমেও। সূত্রের খবর, হাসিমারা সহ উত্তরবঙ্গের বায়ু সেনা ঘাঁটিগুলি থেকে পাঠানো হচ্ছে হেরন এবং নয়া প্রযুক্তির ইউএভি (UAV)। দিন কয়েক আগে বাংলাদেশের সীমান্তে ড্রোন মোতায়েনের আভাস পেয়েছিল ভারতীয় সেনা। তারপরই পাল্টা পদক্ষেপ। সীমান্ত নজরদারিতে এবার ব্যবহার করা হবে অত্যাধুনিক এই ড্রোনগুলিও।