নয়া দিল্লি: ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাস। দেশের কৃষিক্ষেত্রে আমুল সংস্কার আনার জন্য কেন্দ্রের তরফে তিনটি বিল (Farm Laws) পাশ করানো হল। আর এরপরই পঞ্জাব, হরিয়ানা সহ একাধিক রাজ্যে শুরু হল নতুন তিন আইনের বিরোধিতা। ধীরে ধীরে তা রাজ্যের সীমা পেরিয়ে জাতীয় স্তরে পৌঁছল। ২৬ নভেম্বর থেকে দিল্লির তিন সীমান্তে কৃষি আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলন (Farmers Protest) শুরু হল। প্রায় ১০ মাস কেটে যাওয়ার পরও এখনও জারি রয়েছে আন্দোলন, আইন প্রত্য়াহারের দাবিতেই অনড় কৃষকরা। সত্যিই কি কৃষক বিরোধী এই আইন? নাকি কৃষকদের কাঁধে বন্দুক রেখে গুলি চালাচ্ছে অন্য কেউ?
কৃষি আইনকে কেন্দ্র করে যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল ১০ মাস আগে, তা সমাধানে বারংবার উদ্যোগ নিয়েছে কেন্দ্র, দেওয়া হয়েছে কৃষকদের আলোচনার প্রস্তাব। তবে আন্দোলনকারী কৃষকদের সঙ্গে ১১ দফা বৈঠক করেও লাভ হয়নি খুব একটা। ফসলের ন্যূনতম সহায়হক মূল্যের গ্যারান্টি থেকে শুরু করে দেড় বছরের জন্য আইন স্থগিত রাখার প্রস্তাব কেন্দ্রের তরফে দেওয়া হলেও কৃষক আইন প্রত্যাহারের দাবিতেই অনড় থাকে।
কৃষি আইন কার্যকর হওয়ার পর থেকেই পঞ্জাব, হরিয়ানা সহ একাধিক রাজ্যের কৃষকরা এই আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে। কৃষকদের শঙ্কা তিনটি, প্রথম, এই আইন জারি হলে মান্ডিগুলি বন্ধ হয়ে যাবে। দ্বিতীয়, এই আইনের অপব্যবহার করে ছোট কৃষকদের জমি কেড়ে নেওয়া হবে এবং তৃতীয়, ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য কমে যাবে।
তবে বাস্তবে কেন্দ্রের তরফে বারংবার কৃষকদের আশ্বস্ত করা হয়েছে যে তাদের জমিও যেমন কেড়ে নেওয়া হবে না, তেমনই মান্ডিগুলিও বন্ধ করে দেওয়া হবে না। এ বার আসা যাক, এমএসপি বা ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের প্রসঙ্গে। আন্দোলনকারী কৃষক সহ বিরোধী দলগুলির দাবি, এই আইন আসার পর ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য কমে গিয়েছে। তবে তথ্য ও পরিসংখ্যান বলছে ঠিক উল্টো কথাটাই।
একনজরে যদি গতবছরের সঙ্গে চলতি বছরে উৎপাদিত ফসলের ন্য়ূনতম সহায়ক মূল্যগুলির তুলনা করা হয়, তবেই হিসাবটা স্পষ্ট হয়ে যাবে।
মান্ডি প্রসঙ্গে কথা বলতে গেলে, সকলেরই জানা যে মধ্যস্থতাকারীদের জন্যই উৎপাদিত ফসলের নায্য দাম পান না কৃষকরা। নতুন কৃষি আইনে কৃষকদের মঙ্গলকামনাতেই কেন্দ্রের তরফে মধ্যস্থতাকারীদের সরিয়ে সরাসরি ফসল বিক্রির সুযোগ দেওয়া হচ্ছিল কৃষকদের। তবুও কৃষকদের বিরোধিতার মুখে পড়ে কেন্দ্রের তরফে জানানো হয়েছে, মান্ডি ব্যবস্থাও চালু থাকবে। একইসঙ্গে ছোট কৃষকদের জমি যাতে সুরক্ষিত থাকে, সেই দিকটিও নিশ্চিত করা হবে। তবে এত বিরোধিতা কেন?
ভারত কৃষিনির্ভর দেশ। তবে বিগত কয়েক দশক ধরেই জমির উর্বরতা হারিয়ে যাওয়ায় চরম বিপদের মুখে পড়েছেন কৃৃষকরা। জমির এই উর্বরতা হারানোর পিছনে কংগ্রেসের ভূমিকা ভুললে চলবে না। ৫৫ বছর আগে তৎকালীন কংগ্রেস সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে গমের বীজ আমদানি করেছিল। সেই সঙ্গেই ভারতে এসেছিল বুনো ঘাসের বীজও। এই ঘাস একটি বীজ থেকেই ৫০ হাজার চারাগাছ উৎপাদন করতে পারে। এরফলে কৃষকদের অজান্তেই মাইলের পর মাইল জুড়ে দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে থাকে এই বুনো ঘাস, যা জমির উর্বরতা নষ্ট করে এবং অতিরিক্ত খেয়ে ফেললে গবাদি পশুর মৃত্যু পর্যন্ত হয়।
অর্থাৎ ৫৫ বছর আগে কংগ্রেসের একটি ভুলের মাশুল হিসাবে আজও কৃষিকাজ ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। বর্তমান সরকার কৃষিক্ষেত্র নিয়ে অত্যন্ত তৎপর ও উদ্যোগী। কৃষিক্ষেত্রে উন্নত মানের বীজের ব্যবহার থেকে শুরু করে ফসল কেনা-বেচা, সমস্ত ক্ষেত্রেই কৃষকরা যাতে লাভবান হন, সেই প্রচেষ্টাই চালাচ্ছে সরকার। কৃষকদের সুবিধায় একাধিক নতুন প্রকল্পের সূচনা করা হয়েছে, এছাড়াও প্রধানমন্ত্রী কিসান যোজনার অধীনেও ত্রৈমাসিক ভাতার সুবিধাও পাচ্ছেন কৃষকরা।
এত কিছুর পরও কৃষকদের আন্দোলন স্থগিত না হওয়ায় প্রধানমন্ত্রী নিজেও কৃষকদের সঙ্গে কথা বলতে উদ্যোগী হন। ভিডিয়ো কনফারেন্সের মাধ্যমে একাধিক রাজ্যের কৃষকদের সঙ্গে কথা বলেন। দিল্লিতে কৃষক আন্দোলন ঘিরে যে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল, তারপরও কেন্দ্র সহনশীল নীতিই অনুসরণ করেছে। প্রধানমন্ত্রী বীরংবার অতি সাধারণ কৃষকদের সচর্ক করে বলেছেন যে, তাদের হাতিয়ার বানিয়ে এক অদৃশ্য শক্তি দেশের সার্বভৌমত্বে আঘাত হানতে চাইছে।
কৃষক আন্দোলন প্রসঙ্গেই যদি ৩২ বছর আগেও হওয়া এক আন্দোলনের সঙ্গে এই আন্দোলনের তুলনামূলক বিচার করা হয়, তবেই সরকারের অবস্থান স্পষ্ট হয়ে যাবে। ৩২ আগে মহেন্দ্র সিং তিকাইতের নেতৃত্বে ৫ লক্ষ কৃষক মিলিত হয়ে একটি আন্দোলন শুরু করেছিল। আজ তাঁরই ছেলে রাকেশ তিকাইতের নেতৃত্বে কৃষক আন্দোলন পরিচালিত হচ্ছে।
৩২ বছর আগে মহেন্দ্র সিং তিকাইতের সেই আন্দোলনকে দমন করতে তৎকালীন রাজীব গান্ধীর সরকার খাবার ও পানীয় জল সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। আন্দোলনস্থল থেকে কৃষকদের সরাতে উচ্চস্বরে গান বাজানো হয়েছিল। এমনকি পুলিশ লাঠিচার্জও করে।
এবার নজর দেওয়া যাক, গত বছরের শেষ ভাগ থেকে শুরু হওয়া কৃষক আন্দোলনের উপরে। করোনা সংক্রমণের কথা মাথায় রেখে কেন্দ্রের তরফে আন্দোলনের আকার কমানোর অনুরোধ যেমন করা হয়েছিল, তেমনই সবরকমের সহায়তার কথাও বলা হয়েছিল। চলতি বছরের ২৬ জানুয়ারি কৃষকরা শান্তিপূর্ণভাবে ট্রাক্টর মিছিল করার কথা বললেও মিছিল শুরুর কিছুক্ষণের মধ্যেই তা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। নির্দিষ্ট রুট ভেঙে কৃষকরা শহরের অন্দরে জোর করে ট্রাক্টর প্রবেশ করায়, একদল আন্দোলনকারী লালকেল্লায় চড়াও হয়ে সেখানে ভাঙচুর করে এবং জাতীয় পতাকা নামিয়ে ধর্মীয় পতাকা উত্তোলন করে। প্রজাতন্ত্র দিবসের সেই বিশৃঙ্খলার ঘটনায় কমপত্রে ৮০ জন পুলিশ কর্মী আহত হন।
এত কিছুর পরও কেন্দ্রের তরফে কৃষকদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের প্রয়াস বন্ধ করা হয়নি। এখনও অবধি কৃষকদের সঙ্গে কেন্দ্রের ১১ দফা আলোচনা হয়েছে। এরমধ্যে ষষ্ঠ দফা বৈঠকেই সরকারের তরফে কৃষকদের দুটি দাবি, বিদ্যুৎ সংশোধনী বিল ২০২০ প্রত্য়াহার এবং খড়কুটো জ্বালানোর জন্য দিল্লি ও সংলগ্ন এলাকায় যে ব্যপক বায়ুদূষণ হয়, তার প্রেক্ষিতে কৃষকদের বিরুদ্ধে আইনী পদক্ষেপ না নেওয়ার প্রস্তাব মেনে নেওয়া হয়।
কেন্দ্রের তরফে ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের গ্যারান্টিও নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। কৃষি আইন নিয়ে আন্দোলনকারীদের সমস্যা থাকায় এক থেকে দেড় বছরের জন্য আইন স্থগিত রাখা ও কৃষি আইনের প্রতিটি সমস্যা নিয়ে গঠনমূলক আলোচনার প্রস্তাব দেওয়া হয়। যদিও সেই প্রস্তাব খারিজ করে দেয় কৃষকরা।
কৃষি আইন ও কৃষক আন্দোলন নিয়ে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে বিরোধীদলগুলি একাধিক অভিযোগ আনলেও, সংসদে যতবারই তাদের সমস্যাগুলি ক্রমানুসারে তুলে ধরতে বলা হয়েছে, তারা নিশ্চুপ থেকেছে বা আলোচ্য বস্তু পরিবর্তন করে দিয়েছে। এই দিকগুলি বিচার করলেই একটা সুস্পষ্ট ধারণা তৈরি হয় যে, কেন্দ্রের তরফে কৃষি আইন নিয়ে আলোচনা ও প্রয়োজনে সংশোধনের প্রস্তাব দেওয়া হলেও, আন্দোলন জারি রাখতেই চায় কৃষকরা। একাধিক ঘটনায় এই প্রশ্নও উঠেছে যে কৃষকদের হাতিয়ার করে অন্য কেউ এই আন্দোলনের মাধ্যমে মুনাফা লুটছে নাতো?
আরও পড়ুন: Rahul Gandhi: পঞ্জাব কংগ্রেসে চলছে চুলোচুলি, রাহুল তবু কেরল সফরে!