পাকিস্তানকে জল দেওয়া বন্ধ করে দিলে হাতে না হলেও ভাতে মারা যাবে, এ কথা ভারত জানে। জানে বলেই উরি বা বালাকোটের হামলার পর জল বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি একাধিকবার দিতে দেখা গিয়েছে শাসক দলের নেতা-মন্ত্রীকে। এ নিয়ে ক্যাবিনেট স্তরেও দফায় দফায় বৈঠক করে সাউথ ব্লক। তবে পদক্ষেপ কিছুই করা হয়নি। কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ১৯৬০ সালের যে সিন্ধু জল চুক্তি হয়েছিল তা এক লহমায় লঙ্ঘন করা ভারতের পক্ষেও সহজ নয়। একাধিক প্রতিবন্ধকতা রয়েছে বলে মনে করছেন তাঁরা।
সিন্ধু জল চুক্তি (Indus Water Treaty) কী?
বিশ্ব ব্যাঙ্কের মধ্যস্ততায় ১৯৬০ সালে ১৯ সেপ্টেম্বর ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু এবং পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আয়ুব খানের সঙ্গে সিন্ধু নদের জল ব্যবহার নিয়ে চুক্তি হয়। স্বাধীনতার পর থেকেই এই সিন্ধু নদের জল ব্যবহার নিয়ে দুই দেশের মধ্যে রাজনৈতিক এবং কূটনৈতিক টানাপোড়েন থেকেছে। ১৯৫১ সাল থেকে এই বিষয়ে বিশ্বব্যাঙ্ক মাথা গলাতে শুরু করে। টানা ৬ বছর ধরে আলাপ আলোচনার পর ১৯৬০ সালে দুই দেশের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। নেহরু পাকিস্তানে গিয়ে করাচিতে এই চুক্তি স্বাক্ষরিত করেন। সাক্ষী ছিলেন বিশ্বব্যাঙ্কের সহ-সভাপতি ডব্লিউ এ বি ইলিফ।
ওই চুক্তিতে বলা হয়েছে, সিন্ধু নদ-সহ পশ্চিমি আরও দুই নদী বিতস্তা ও চন্দ্রভাগার জল সরাসরি পাবে পাকিস্তান। প্রায় ১৩.৫০ কোটি একর ফুট জল পাকিস্তান পাবে। অন্যদিকে পূর্বের নদী ইরাবতী, শতদ্রু ও বিপাশার সম্পূর্ণ জলের নিয়ন্ত্রণ থাকবে ভারতের। তবে, পশ্চিমি নদ-নদীর জল থেকে বিদ্যুৎ তৈরির করার অধিকার রয়েছে ভারতের। পশ্চিমি নদ-নদীর মাত্র ৩৬ লক্ষ একর ফুট জল ব্যবহার করতে পারবে ভারত, যার মধ্যে সিন্ধু নদ ৪ লক্ষ, বিতস্তা ১৫ লক্ষ এবং চন্দ্রভাগার ১৭ লক্ষ একর ফুট জল রয়েছে।
সিন্ধু নদের প্রভাব কতটা পাকিস্তানের অর্থনীতিতে?
সিন্ধু নদের ৫টি শাখা চন্দ্রভাগা, বিতস্তা, ইরাবতী, শতদ্রু, বিপাশা। যার মধ্যে সিন্ধু নদ-সহ চন্দ্রভাগা এবং বিতস্তার মাত্র ২০ শতাংশ জলের উপর শুধুমাত্র ভারতের অধিকার রয়েছে। বাকি সবটাই পাকিস্তান পেয়ে থাকে। পাকিস্তানের জীবন-জীবিকা নির্ভর করে এই নদ-নদীর জলের উপরই। কৃষি প্রধান পাকিস্তানের মোট জিডিপির ২১ শতাংশ আসে সিন্ধু নদকে কেন্দ্র করে। অর্থাৎ বোঝাই যাচ্ছে তিব্বত থেকে ভারত হয়ে বয়ে আসা সিন্ধু নদ পাকিস্তানের গিলগিট-বাল্টিস্তান, সিন্ধের বিস্তীর্ণ এলাকার অর্থনীতিকে কীভাবে প্রভাবিত করে।
ভারতের আপত্তি কোথায়?
সিন্ধু জল চুক্তি হওয়ার পর জল বণ্টনে ভারত বরাবরই নরম মনোভাব দেখিয়ে এসেছে। এই চুক্তিতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ভেবেছিলেন, সিন্ধুর মতোই দুই দেশের মধ্যে শান্তি এবং সুস্থিতি প্রবাহিত হবে। বাস্তবে তা সম্ভব হয়নি। এরপর তিন তিনটে যুদ্ধ হয়েছে দুই দেশের মধ্যে। তবে, সিন্ধু জল চুক্তি সেভাবে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি কখনওই। কিন্তু পাকিস্তান ক্রমাগত সন্ত্রাসকে হাতিয়ার করে ভারতের উপর একের এক জঙ্গিহানা চালিয়েছে। মুম্বই জঙ্গি হামলা থেকে উরি-বালাকোট হামলায় পাকিস্তানের প্রত্যক্ষ ইন্ধনের প্রমাণ মিলেছে। আলোচনার টেবিলে সন্ত্রাস ইস্যুর সমাধান না মেলায় বাধ্য হয়েই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে বলতে শোনা গিয়েছে, জল এবং রক্ত এক সঙ্গে বইতে পারে না।
দীর্ঘদিন ধরে কাশ্মীরে সন্ত্রাস ছড়ানোর পিছনে কাজ করছে সিন্ধু জল চুক্তিও। কাশ্মীরকে কুক্ষিগত করতে পারলে সিন্ধু নদের জল নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনতে সহজ হবে বলে মনে করে পাকিস্তান। চিন ও পাকিস্তান ঘোষিত বন্ধু হওয়ায় সিন্ধু নদের উৎসে কোনও বাধা হওয়ার কথা নয়। ফলে, ভারতের ভূমিকাই ইসলামাবাদের মাথাব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রসঙ্গত ২০১০ সালে জামাত উদ দাওয়ার প্রধান হাফিজ় সইদ প্রকাশ্য জনসভায় বলে, কাশ্মীর দখল না করতে পারলে জলের নিয়ন্ত্রণ আসবে না। জল না পেলে রক্তগঙ্গা বইবে বলেও হুঁশিয়ারি দেয় হাফিজ়।
সিন্ধু জল চুক্তি পুনর্বিবেচনা ভারতের:
২০১৬ সালে উরি হামলার পর প্রথম প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেছিলেন, রক্ত এবং জল একসঙ্গে বইতে পারে না। এরপরই পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত স্থায়ী সিন্ধু কমিশনের বার্ষিকসভায় অংশগ্রহণ বাতিল করে ভারত। যদিও সন্ত্রাস থেমে থাকেনি। ২০১৯ সালে ফেব্রুয়ারিতে বালাকোটে সেনা কনভয়ে জঙ্গিরা হামলা চালায়। ৪০ জওয়ান শহিদ হন। এরপরই সিন্ধু জল চুক্তি নিয়ে কঠোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার হুমকি দেওয়া হয় কেন্দ্রের তরফে। কেন্দ্রীয় জল সম্পদ মন্ত্রী নিতিন গডকড়ী স্পষ্ট জানান, পাক অভিমুখে বয়ে যাওয়া পূর্বে নদ-নদীর জল বন্ধ করে দেওয়ার কথা ভেবেছে কেন্দ্র। সিন্ধু নদের জল নিয়ন্ত্রণেরও ইঙ্গিত দেন তিনি। উল্লেখ্য, চন্দ্রভাগার উপর ভারতের তৈরি কৃষ্ণগঙ্গা জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়ে বেশ জলঘোলা করে পাকিস্তান। আন্তর্জাতিক আদালতে দ্বারস্থ হলেও কোনও সুবিধা করতে পারেনি তারা।
সিন্ধু জল নিয়ন্ত্রণে আনলে কী সুবিধা- অসুবিধা:
** সিন্ধু, বিতস্তা ও চন্দ্রভাগা জলের উপর সিংহভাগ পাক নাগরিকের জীবন-জীবিকা নির্ভর করছে। কূটনৈতিক কারণে ভারত যদি এই পদক্ষেপ করে থাকে, পাকিস্তানের জনসাধারণের উপর বিভীষিকা নেমে আসবে। ৯০ শতাংশ কৃষিকাজের উপর নির্ভরশীল তাঁরা।
**এমন পদক্ষেপ করলে চাপে পড়তে পারে ভারতই। আন্তর্জাতিক মঞ্চে মানবিকতার প্রশ্নে ভারতকে কোণঠাসা করার সুযোগ পেয়ে যাবে পাকিস্তান। এমন পদক্ষেপ সাউথ ব্লকও কখনও করবে না বলে মনে করে ওয়াকিবহাল মহল।
** পাকিস্তানকে জল দেওয়া বন্ধ করলে চিন যে কলকাঠি নাড়বে না, তা হলফ করে বলা যায় না। সিন্ধু নদের পাশাপাশি ব্রহ্মপুত্র নদের জল ব্যবহারে বাধা দিতে পারে বেজিং। এ ক্ষেত্রে প্রবল জলকষ্টের মুখে পড়তে পারে বাংলাদেশও। অর্থাৎ পরোক্ষভাবে ভারতের দ্বারাই ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বাংলাদেশ। সেক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মহলে প্রশ্নচিহ্নের সামনে দাঁড়াবে ভারতের এই সিদ্ধান্ত।
**সিন্ধু নদের জল সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করলে ভারতের অভ্যন্তরেও দেখা দিতে পারে সমস্য়া। বিপুল জলরাশি নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে রাজস্থান ও গুজরাট সংলগ্ন বিস্তীর্ণ অঞ্চল প্লাবিত হতে পারে। বিশেষজ্ঞরা উড়িয়ে দিচ্ছেন না সেই আশঙ্কাও।
আরও পড়ুন- Rafale নাকি F-16, রণভূমিতে এগিয়ে কে? পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ