দেড় কোটির গণ্ডি পার করোনার, সংক্রমণের হার থেকে অক্সিজেন এক্সপ্রেস, সার্বিক করোনা চিত্রটা কেমন?

ঈপ্সা চ্যাটার্জী |

Apr 19, 2021 | 12:09 PM

রবিবার কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য সচিব রাজেশ ভূষণ সমস্ত রাজ্যের মুখ্য সচিবদের একটি চিঠি লিখে অক্সিজেন সরবরাহের জন্য শিল্প ব্যবহার নিষিদ্ধ করার এবং হাসপাতালে সম্পূর্ণরূপে অক্সিজেন উপলব্ধ করার বিষয়ে নির্দেশ দিয়েছেন।

দেড় কোটির গণ্ডি পার করোনার, সংক্রমণের হার থেকে অক্সিজেন এক্সপ্রেস, সার্বিক করোনা চিত্রটা কেমন?
ফাইল চিত্র।

Follow Us

জ্যোতির্ময় রায়: করোনাভাইরাসের অনিয়ন্ত্রিত গতিতে গত ১২ দিনে সংক্রমণ দ্বিগুণ হারে বেড়েছে। এপ্রিলের শুরুতে সংক্রমণের হার ছিল ৮ শতাংশ, যা এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬.৬৯ শতাংশে। একইসঙ্গে সাপ্তাহিক সংক্রমণের হারও এক মাসে ৩.০৫ থেকে ১৩.৫৪ শতাংশে বেড়েছে, যা প্রধান চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

স্বাস্থ্যমন্ত্রকের তথ্য অনুযায়ী, বিগত চার দিনে নয় লাখেরও বেশি মানুষ সংক্রামিত হয়েছেন, যা অন্যান্য দেশের তুলনায় সর্বোচ্চ। একদিনেই ২,৬১,৫০০ জন আক্রান্ত হয়েছেন এবং ১,৫০১ জন মারা গিয়েছেন। এই নিয়ে দেশে টানা দ্বিতীয় দিনেও মৃত্যুর রেকর্ড হার দেখা গিয়েছে। করোনার প্রথম ঢেউয়ে এক দিনে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ১১৯০, যা গত বছরের ১৬ সেপ্টেম্বর রেকর্ড করা হয়েছিল।
স্বাস্থ্যমন্ত্রকের মতে, গত দুই মাসে সক্রিয় আক্রান্তের সংখ্যা ১২ গুণ বেড়েছে। সংক্রামিত ব্যক্তিদের মোট সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১,৪৭,৮৮,১০৯। মহামারীতে মোট মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১,৭৭,১৫০ এ। এর মধ্যে সক্রিয় রোগীদের সংখ্যা ১৮,০১,৩১৬, যা মোট সংক্রমণের প্রায় ১২.১৪ শতাংশ।

সংক্রমণের হার সবচেয়ে বেশি ছত্তীসগঢ়ে –

স্বাস্থ্যমন্ত্রকের তথ্য অনুযায়ী, ছত্তীসগঢ়ে সংক্রমণের হার ৩০.৩৮ শতাংশ, যা গোটা দেশের মধ্যে সর্বাধিক। দিল্লিতে এই হার ১৩.৯১ শতাংশ, চণ্ডীগঢ়ে ১৪.৪৭ শতাংশ, পুদুচেরিতে ১৫.৩০ শতাংশ, দাদরা-নগর হাভেলিতে ১৫.৮৬, হরিয়ানাতে ১৫.৯৭ শতাংশ, লাদাখে ১৭.৮০ শতাংশ, মধ্য প্রদেশে ১৮.৯৯ শতাংশ, মহারাষ্ট্রে ২৩.৩৩ শতাংশ, মহারাষ্ট্রে ২৪.১৭ শতাংশ এবং গোয়ায় ২৪.২৪ শতাংশ আক্রান্তের হার রয়েছে।

কমেছে মৃত্যুর হার-

বর্তমানে করোনায় সুস্থতার হার কমে দাঁড়িয়েছে ৮৯.৬ শতাংশে। করোনা আক্রান্ত হয়েও সুস্থ হয়ে ওঠা মানুষের সংখ্যা বর্তমানে ১,২৮,০৯,৬৪৩। তবে মৃত্যুর হার কমেছে ১.২০ শতাংশে। দুই সপ্তাহ আগে পর্যন্ত এটি ছিল ১.৩০। দেশে নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। এখনও পর্যন্ত দেশে ২.৬৫ কোটিরও বেশি করোনার নমুনা পরীক্ষা হয়েছে। গত শনিবার, দেশে প্রথমবারের মতো একদিনে ১৫.৬৬ লক্ষেরও বেশি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছিল, যার মধ্যে ১৬ শতাংশ সংক্রামিতের খোঁজ পাওয়া গিয়েছিল।

চারটি রাজ্যে মৃত্যুর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি-

দেশের চারটি রাজ্যে করোনায় সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। হাসপাতালে চিকিৎসা পদ্ধতি সঠিকভাবে অনুসরণ করা হচ্ছে না বলেই দ্বিতীয় ঢেউয়ে মৃতের সংখ্যা বাড়ছে বলে অভিযোগ। এর আরও একটি কারণ হল রোগের জটিলতা বাড়ার পর রোগীরা হাসপাতালে যাচ্ছেন। একদিনেই মহারাষ্ট্রে ৪১৯, দিল্লিতে ১৬৭, ছত্তিসগড়ে ১৫৮ ও উত্তরপ্রদেশে ১২০ জন মারা গিয়েছেন, যা সর্বোচ্চ সংখ্যক মৃত্যুর রেকর্ড।

রেমিডেসিভির ইনজেকশনের উৎপাদন আগামী ১৫ দিনে দ্বিগুণ-

কেন্দ্রীয় সরকার জানিয়েছে, করোনা চিকিৎসায় ব্যবহৃত রেমিডেসিভির ইঞ্জেকশনের উৎপাদন আগামী ১৫ দিনে দ্বিগুণ করা হবে। প্রতিদিন প্রায় তিন লক্ষ শিশি প্রস্তুত করা হবে। দেশের চাহিদা পূরণের জন্য বর্তমানে ২০ টি উৎপাদন কেন্দ্রের পাশাপাশি আরও ২০টি প্ল্যান্ট অনুমোদিত করা হয়েছে। সরকার ইতিমধ্যে ফার্মাসিউটিক্যাল সংস্থাগুলির সঙ্গে কথা বলে রেমিডেসিভির ইঞ্জেকশনের দামও কমিয়েছে।

রেমিডেসিভারের কালোবাজারি রুখতে সরকারের নজরদারী-

গুজরাটের ভালসাদ জেলায় অবস্থিত দামান নামক ব্রুক ফার্মার টেকনিক্যাল ডিরেক্টর মনীশ সিং এবং তাঁর পরিচিত তথা দমনের একটি ফার্নিচারের দোকানের মালিক বরুণ কুন্দ্রাকে রেমেডেসিভির ওষুধের কালোবাজারির অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাঁদের কাছ থেকে রেমেডেসিভির ইনজেকশন পাওয়া গেছে বলে অভিযোগ। পুলিশ জানায়, কুন্দ্রা ও মনীশ ১২ হাজার টাকায় সাধারণ মানুষের কাছে এক একটি ইঞ্জেকশন বিক্রি করতেন। এর আগে শনিবার মুম্বই পুলিশ সংস্থাটির পরিচালক রাজেশ ডোকানিয়াকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল।

অক্সিজেনের চাহিদা পূরণ-

করোনা চিকিৎসায় অক্সিজেনের আচমকা চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় রবিবার কেন্দ্রীয় সরকার ১৬২টি নতুন অক্সিজেন উৎপাদনকারী ইউনিটের অনুমোদন দিয়েছে। শুধু তাই নয়, কেন্দ্রীয় সরকার শিল্পের জন্য ব্যবহৃত অক্সিজেনকেও হাসপাতালে স্থানান্তরিত করার নির্দেশ দিয়েছে। সারাদেশে অক্সিজেনের অভাবের কথা মাথায় রেখে, রবিবার টাটা স্টিল করোনার রোগীদের জন্য প্রতিদিন ৩০০ টন মেডিকেল অক্সিজেন সরবরাহ করার ঘোষণা করেছে। এ ছাড়া সেলও ৩৩.৩০ টন তরল মেডিক্যাল অক্সিজেন সরবরাহের কথা ঘোষণা করে।
জেএসপিএলের অঙ্গুল ও রায়গড়ের কারখানা থেকে প্রতিদিন ৫০ থেকে ১০০ টন অক্সিজেন সরবরাহ করা হচ্ছে। গুজরাটের আরসিলার মিত্তাল নিপ্পান স্টিল ইন্ডিয়াও প্রতিদিন ২০০ টন মেডিকেল অক্সিজেন সরবরাহ করছে।

‘অক্সিজেন এক্সপ্রেস’-

সারা দেশে অক্সিজেনের সরবরাহ দ্রুত করার জন্য রেলমন্ত্রকের তরফে নতুন ‘অক্সিজেন এক্সপ্রেস’ শুরু করা করেছে। বিভিন্ন রাজ্যের প্রয়োজন মতো স্পেশাল ট্রেনের সাহায্যে পাঠানো হবে অক্সিজেন। গ্রিন করিডোর তৈরি করে স্পেশাল ট্রেন পাঠানো হবে সংশ্লিষ্ট রাজ্যে, যাতে সময় মতো অক্সিজেন সরবরাহ করা যায়।
এছাড়াও, রেল বোর্ডের চেয়ারম্যান জানিয়েছেন, প্রায় ৫,০০০ ‘কোভিড কোচ’-র ব্যবস্থা করা হয়েছে। রাজ্যের দাবি মেনে প্রয়োজনমতো এই কোচগুলি সরবরাহের ব্যবস্থা করা হবে। ইতিমধ্যেই মহারাষ্ট্র এবং দিল্লিতে এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

শিল্পে অক্সিজেনের ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে কেন্দ্র-

সারাদেশে করোনার রোগীদের ক্রমবর্ধমান অক্সিজেনের চাহিদা বিবেচনা করে কেন্দ্র সরকার একটি বড় সিদ্ধান্ত নিয়েছে। শিল্প উদ্যোগ বা প্রতিষ্ঠানে অক্সিজেনের ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে সরকার। এই স্থগিতাদেশ ২২ এপ্রিল থেকে প্রযোজ্য হবে। এর বদলে সমস্ত অক্সিজেন চিকিৎসাক্ষেত্রে সরবরাহ করা হবে।
এই নির্দেশিকার মধ্যে ইস্পাত শিল্পে ব্যবহৃত অক্সিজেনও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এর বাইরে সাত রাজ্যের সাড়ে তিন হাজারের বেশি অক্সিজেন তৈরির সংস্থাগুলির একটি তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। যে কোন রাজ্য সরকার অক্সিজেন সরবরাহের জন্য এই সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে।

জেইই মেইনস পরীক্ষা স্থগিত-

করোনা সংক্রমণের কারণে এপ্রিলে নির্ধারিত জেইই মেইন পরীক্ষাগুলি স্থগিত করা হয়েছে। এই পরীক্ষাগুলি ২৭, ২৮ এবং ৩০ এপ্রিল অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। পরীক্ষার নতুন তারিখ কমপক্ষে ১৫ দিন আগে ঘোষণা করা হবে বলে জানানো হয়েছে।

রবিবার কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য সচিব রাজেশ ভূষণ সমস্ত রাজ্যের মুখ্য সচিবদের একটি চিঠি লিখে অক্সিজেন সরবরাহের জন্য শিল্প ব্যবহার নিষিদ্ধ করার এবং হাসপাতালে সম্পূর্ণরূপে অক্সিজেন উপলব্ধ করার বিষয়ে নির্দেশ দিয়েছেন। চিঠিতে স্বাস্থ্য সচিব জানিয়েছেন যে, ইনজেকশন শিশি তৈরি, ফার্মাসিউটিক্যালস, পেট্রোলিয়াম শোধনাগার, স্টিল প্ল্যান্ট, পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্জ্র, অক্সিজেন সিলিন্ডার প্রস্তুতকারী, বর্জ্য জল শোধনাগার, খাদ্য ও জল পরিশোধন শিল্পের ক্ষেত্রে অক্সিজেন ব্যবহারে কোনও বাধা নেই।

একই সঙ্গে স্বাস্থ্য মন্ত্রকের যুগ্ম-সচিব নিপুন বিনায়ক, সাতটি রাজ্যের অক্সিজেন উৎপাদনকারী সংস্থার একটি তালিকা জারি করেছেন। এই সংস্থাগুলির সহায়তায়, রাজ্য সরকারগুলি অক্সিজেন জোগাড় করতে পারে।
মহারাষ্ট্রে ১৬৪৬, দিল্লিতে ৩৭৮, ইউপিতে ৭৫১, রাজস্থানে ১৬০, তেলেঙ্গানা ও অন্ধ্র প্রদেশে ৩৬০-৩৬০ এবং উত্তরাখণ্ডে মোট ৮৩টি সংস্থা রয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রক আশা প্রকাশ করেছেন যে, আগামী দুই থেকে তিন দিনের মধ্যেই দেশে অক্সিজেন সরবরাহের ঘাটতি সমস্যা কাটিয়ে ওঠা যাবে।

Next Article