নয়া দিল্লি: অযোধ্যায় রাম মন্দিরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর হাত ধরে ভগবান রামের প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয়েছে। দেশবাসীর বহু প্রতীক্ষিত এক স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। অকাল দীপাবলি পালিত হয়েছে গোটা দেশে। অযোধ্যায় ভগবান রামের প্রাণ প্রতিষ্ঠার অনুষ্ঠানের দিকে শুধু ভারতেরই নয়, গোটা বিশ্বের সংবাদমাধ্যমের নজর ছিল। এদিকে ঠিক এই সময়টাকেই কাজে লাগাতে প্রস্তুতি নিচ্ছিল দেশ-বিদেশের সাইবার অপরাধীরাও। তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিভাগের অন্তর্গত ইন্ডিয়ান সাইবার ক্রাইম কো-অর্ডিনেশন সেন্টার (আইসিসিসিসি) এবং অন্যান্য বিভাগের সাইবার ক্রাইম দমনের সঙ্গে যুক্ত কর্তারা এই বিষয়ের উপর কড়া নজরদারি চালাচ্ছিলেন। তাতেই পর্দাফাঁস হয়েছে চাঞ্চল্যকর তথ্যের।
বিভিন্ন ধরনের প্রতারণার ফাঁদ পাতার চেষ্টা চলছিল। ভুয়ো কিউআর কোড কিংবা ওয়েবসাইট বানিয়ে দান, রাম মন্দিরের প্রসাদ, মডেল ও প্রাণ প্রতিষ্ঠার ভুয়ো টোকেন বিক্রি করার চেষ্টা করা হচ্ছিল। তবে কড়া নজরদারির ফলে অপরাধীদের সময়মতো আটকানো সম্ভব হয়েছে। সাইবার প্রতারণার কারবারে ধরা পড়েছে এক বিদেশি নাগরিকও। ওই বিদেশি নাগরিক ভারতে এসে প্রতারণার ফাঁদ পেতেছিল এবং প্রাণ প্রতিষ্ঠার কয়েকদিন আগেই কয়েক কোটি টাকা প্রতারণা করে হাতিয়ে নিয়েছিল বলে অভিযোগ। ওই ব্যক্তিকে ইতিমধ্যেই গ্রেফতার করা হয়েছে। ফিউচার ক্রাইম সামিট ২০২৪-এ বক্তব্য রাখার সময় এমনই চাঞ্চল্যকর তথ্য তুলে ধরেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিভাগের বিশেষ সচিব এস সুন্দরী নন্দা।
ভারতের ডিজিটাল পরিকাঠামোকে আরও উন্নত করে তুলতে কেন্দ্র যে কোনও খামতি রাখছে না, সে কথাও এদিনের সম্মেলনে তুলে ধরেন নন্দা। সাইবার অপরাধ দমনে কেন্দ্র যে অবিরাম কাজ চালিয়ে যাচ্ছে, পদক্ষেপ করে যাচ্ছে, তাও জানালেন তিনি। সঙ্গে এও জানালেন, যে এই কাজে মাঝে মধ্যে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখিও হতে হচ্ছে। যেমন, জি-২০ সম্মেলনের সময় কিংবা প্রাণ প্রতিষ্ঠা পর্বের সময় ভারতে সবথেকে বেশি সাইবার অপরাধের চেষ্টা হয়েছিল, তবে সেগুলিকে সময় থাকতে থাকতে সামাল দেওয়া গিয়েছে।
বর্তমানে দেশে সাইবার অপরাধ দমন করতে আইসিসিসিসি ছাড়াও ন্যাসকম, ডেটা সিকিউরিটি কাউন্সিল ও অন্যান্য সাইবার বিশেষজ্ঞরা রয়েছেন। যাঁরা ক্রমবর্ধমান এই সাইবার ক্রাইমের প্রবণতার পায়ে শিকল পরাতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন। যেসব সাইবার ক্রাইম হয়, তার বেশিরভাগটাই হল আর্থিক জালিয়াতি। আর এক্ষেত্রে একটি বড় ভূমিকা রয়েছে সিএফসিএফআরএমএস-এর। এটি এমন একটি প্লাটফর্ম, যা আর্থিক জালিয়াতি সংক্রান্ত সাইবার ক্রাইম দমন করে, এখনও পর্যন্ত ১ হাজার কোটি টাকার জালিয়াতি থেকে দেশবাসীকে রক্ষা করেছে। দু’বছর আগেও এই পরিসংখ্যান ছিল মাত্র ২০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ, এখান থেকেই অনুমান করা যায়, সাইবার জালিয়াতির প্রবণতা এখন কতটা বেড়েছে।
রাজধানী দিল্লিতে দু’দিন ধরে আয়োজিত হল ফিউচার ক্রাইম সামিট ২০২৪। লক্ষ্য হল, সাইবার অপরাধ সম্পর্কে মানুষের মধ্যে সচেতনতা আরও বাড়ানো। একইসঙ্গে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা। ফিউচার ক্রাইম রিসার্চ ফাউন্ডেশন ও আইআইটি কানপুরের AIIDE COE যৌথভাবে এই সামিটের আয়োজন করেছে। সম্মেলনে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের সাইবার বিশেষজ্ঞদের পাশাপাশি আমন্ত্রিত ছিলেন বিভিন্ন সরকারি সংস্থার পদস্থ কর্তারাও। সাইবার সিকিউরিটি সংক্রান্ত প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করা বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানও এই সম্মেলনে অংশ নেয়।
সাইবার ক্রাইম দমনের দিক থেকে দেশের সব রাজ্যের মধ্যে শীর্ষস্থানে রয়েছে তেলঙ্গানা। দেশজুড়ে বাড়তে থাকা সাইবার ক্রাইমের প্রবণতা বন্ধ করার জন্য একটি আইনি ফ্রেমওয়ার্কের উপর জোর দেন আইআইটি কানপুরের AIIDE-এর সিইও নিখিল আগরওয়াল। তাঁর মতে, আজকের দিনে এই সাইবার অপরাধ প্রত্যেকের জন্য চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছে।
ফিউচার ক্রাইম রিসার্চ ফাউন্ডেশনের তরফে শশাঙ্ক শেখর জানান, এই সম্মেলনের মূল উদ্দেশ্যই হল সব স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনা থেকে একটি পথ বের করা। যাতে, ভবিষ্যতের জন্য আরও ভাল করে প্রস্তুতি নেওয়া থাকে। সেক্ষেত্রে এই বাড়তে থাকা সাইবাই ক্রাইম ঠেকাতে আমজনতাকে আরও বেশি সচেতন করা সবথেকে বেশি জরুরি বলেই মনে করছেন তিনি। তাঁর কথায়, এই সম্মেলন থেকে যা কিছু নির্যাস বেরিয়ে আসবে, সেগুলি সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে। যাতে সাধারণ মানুষ আরও বেশি সচেতন হতে পারেন। সরকারও যে এ ক্ষেত্রে অবিরাম ভাল কাজ করে যাচ্ছে, সে কথাও তুলে ধরেন তিনি।
দিল্লিতে আয়োজিত এই ফিউচার ক্রাইম সামিটে আমন্ত্রিত ছিলেন অন্ধ্রপ্রদেশের প্রাক্তন ডিজিপি সন্তোষ মেহরাও। তিনিও বিভিন্ন চাঞ্চল্যকর তথ্য-পরিসংখ্যান তুলে ধরেন। সাইবার ক্রাইমের কারণে কত টাকার ক্ষতি হয়, সে কথা সম্মেলনে জানালেন তিনি। বললেন, ‘গোটা বিশ্বে সাইবার অপরাধের জন্য মানুষ ফি বছর প্রায় আট ট্রিলিয়ন ডলার ক্ষতির সম্মুখীন হন। আর অন্যদিকে সাইবার অপরাধীরা এইভাবে প্রতারণা করে প্রায় ১.৭ ট্রিলিয়ন ডলার অবৈধভাবে আয় করে।’
কয়েক বছর আগেই এক ভয়ঙ্কর করোনা পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিল ভারত। প্রাক্তন ডিজিপি সন্তোষ মেহরা বলেন, করোনাকালে একটি গুজব ছড়িয়েছিল যে দিল্লি সীমানা থেকে নাকি উত্তর প্রদেশ ও বিহারের জন্য বিনামূল্যে বাস চালু হচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় এই গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল। হঠাৎ করে হাজার হাজার মানুষ জড়ো হয়ে গিয়েছিলেন বাস ধরার জন্য। প্রাক্তন ডিজিপির মতে, এটিও এক ধরনের সাইবার ক্রাইম। আরও চাঞ্চল্যকর পরিসংখ্যান তুলে ধরে তিনি বলেন, ভারতে এক বছরে গড়ে প্রায় ১৪ লাখ সাইবার প্রতারণার চেষ্টা হচ্ছে, এবং তার মধ্যে প্রায় ২ লাখ সাইবার প্রতারণার চেষ্টা চলেছে সরকারি দফতরে।
এনসিআরবি-র পরিসংখ্যান তুলে ধরে সন্তোষ মেহরা বলেন, এক বছরে সাইবার অপরাধের কারণে ৬৬ হাজার এফআইআর নথিভুক্ত হয়েছে। গত পাঁচ বছরের পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে, মোট ১ লাখ ১৭ হাজার মামলা নথিভুক্ত হলেও শাস্তি হয়েছে মাত্র ১১০০ অপরাধীর। ফলে, সাইবার অপরাধের মামলায় দোষী সাব্যস্ত হওয়ার হার রয়ে গিয়েছে মাত্র ২ শতাংশে। তিনি আরও জানান, এক বছরে দেশে সাইবার অপরাধের শিকার হয়ে মানুষ ৪ হাজার ৫৩০ কোটি টাকা খুইয়েছেন এবং তার মধ্যে খুব কম ক্ষেত্রেই পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। তাঁর মতে, এর পিছনে অন্যতম কারণ হল উন্নত পরিকাঠামোর অভাব।
প্রাক্তন ডিজিপি সন্তোষ মেহরা বলেন, আজ দেশের মোট সাড়ে ১৬ হাজার থানার মধ্যে মাত্র ২ শতাংশ সাইবার থানা রয়েছে। সাইবার থানার সংখ্যা আরও বাড়ানোর প্রয়োজন মনে করছেন তিনি। অন্তত ১০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো দরকার বলে মত সন্তোষ মেহরার।
প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের প্রিন্সিপাল অ্যাডভাইজর লেফটেন্যান্ট জেনারেল বিনোদ জি খান্ডারেও আমন্ত্রিত ছিলেন এই সম্মেলনে। দেশে সাইবার অপরাধের প্রবণতা বাড়ার ফলে আর্থিক ক্ষতি বাড়ছে বলেও মনে করছেন তিনি। বললেন, “বাইরের দেশ থেকে আসা সাইবার আক্রমণগুলিকে আমরা সাইবার ক্রাইম হিসেবে বিবেচনা করি, কিন্তু প্রতিপক্ষ দেশগুলির কাছে সেটা একপ্রকার ওয়ারফেয়ারের মতো। আমাদের নিজেদের ক্ষমতা ও শক্তি আরও বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে মানুষকেও সচেতন করতে হবে।”
ফিউচার ক্রাইম সামিট ২০২৪-এর মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন দিল্লি পুলিশের প্রাক্তন কমিশনার রাকেশ আস্থানাও। তিনিও বলছেন যে সাইবার অপরাধ দমন করতে দেশে এখনও পুলিশের কাছে প্রযুক্তি ও সক্ষম লোকের কিছুটা অভাব রয়েছে। বললেন, বর্তমানে প্রায় ৬২ শতাংশ মাদকের ব্যবসা হয় ডার্ক ওয়েবের মাধ্যমে। পাশাপাশি ন্যাশনাল সাইবার সিকিউরিটি অ্যাডভাইজ়র লেফটেন্যান্ট জেনারেল এমইউ নায়ারও মনে করছেন, ভারতের ডিজিটাল পরিকাঠামো বিশ্বের সবথেকে দ্রুত গতিতে বেড়ে চলছে, কিন্তু এখানে এখনও অনেক কাজ করা দরকার রয়েছে। তিনি বলেন, “বর্তমানে যাঁরা নীতি নির্ধারক রয়েছেন, তাঁদের কিছু নীতি নিয়ে আসতে হবে এবং সেগুলি বাস্তবায়িত করতে হবে। এমন একটি পরিবেশ তৈরি করতে হবে, যেখানে আরও বেশি করে মানুষকে প্রশিক্ষিত করা যায়। সব পেশার ক্ষেত্রে সাইবার নিরাপত্তা সংক্রান্ত একটি ক্যাপসুল কোর্স চালু করতে হবে। এক্ষেত্রে স্টার্ট আপ সংস্থাগুলিকে আরও এগিয়ে আসতে হবে। একটি সাইবার সিকিউরিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কথাও ভেবে দেখতে পারে সরকার।”
সাইবার বিশেষজ্ঞ নৃপুল রাও এদিন সম্মেলনে একটি প্রেজেন্টেশন তুলে ধরেন। সাইবার সিকিউরিটির জন্য কী কাজ চলছে এবং এর পাশাপাশি কী সমস্যা রয়েছে ও তার সম্ভব্য সমাধানের একটি রূপরেখা তিনি তুলে ধরেন ওই প্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে। প্রসঙ্গত, নৃপুল রাও বর্তমানে ডিজিটাল ফরেন্সিকের ক্ষেত্রে কাজ করছেন। প্রি-ডিসকভার নামে একটি সংস্থার সিইও পদেও রয়েছেন তিনি। সাইবার সিকিউরিটির ক্ষেত্রে তিনি বর্তমানে তেলঙ্গানা পুলিশের সঙ্গেও যুক্ত রয়েছেন। নৃপুল রাও-ও বলেন, “যেখানে অর্থনীতির এত উন্নতি হচ্ছে, সেখানে সাইবার অপরাধের সমস্যাও বাড়ছে। তাই সাইবার নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা খুবই জরুরি। আমরা যদি আজকে দেশে সাইবার অপরাধের মাধ্যমে আর্থিক প্রতারণার কথা বলি, মানুষ মাত্র ১০ শতাংশ ক্ষেত্রে তাদের খোয়ানো অর্থ ফিরে পেয়েছে। এই সার্বিক চিত্রে বদল আনতে, আমরা উন্নত প্রযুক্তিতে সরকারের সঙ্গে ক্রমাগত কাজ করছি।”