শান্তিনিকেতন: বিশ্বভারতী, শান্তিনিকেতনে অবস্থিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯২১ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর শিক্ষা ভাবনাকে সাকার করতে দৃঢ় সংকল্প, আবেগ এবং অটল বিশ্বাসে এগিয়েছিলেন তিনি। বয়স এবং অসুস্থতা উপেক্ষা করে নৃত্যনাট্যের দল নিয়ে গোটা দেশ ঘুরে তহবিল সংগ্রহ করেছিলেন। স্ত্রী মৃণালিনী দেবীর ভূমিকাও কম ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের তহবিল জোগার করতে নিজের অলঙ্কার বিক্রি করে দিয়েছিলেন। প্রথম ব্যাচের ছাত্রছাত্রীদের তিনি নিজে দেখাশোনা করতেন। বিশ্বভারতীর এই আর্থিক সমস্যা মিটে গিয়েছিল ১৯৫১ সালে। কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়েছিল এই বিশ্ববিদ্যালয়। আর এর পিছনে বড় ভূমিকা নিয়েছিলেন দুটি মানুষ গান্ধীজি এবং জওহরলাল নেহরু। কারণ, রবীন্দ্রনাথের ভাবনাকে তাঁরা এগিয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নেহরু হয়েছিলেন বিশ্বভারতীর প্রথম চ্যান্সেলর বা আচার্য। নেহরু-গান্ধী পরিবারের আরও দুই সদস্য – ইন্দিরা গান্ধী এবং রাজীব গান্ধীও বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য হয়েছিলেন। প্রত্যেকেই বিশ্বভারতীকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজে মন দিয়েছিলেন। পরবর্তীকালেও, পিভি নরসীমা রাও থেকে শুরু করে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী পর্যন্ত সকলেই এই ক্ষেত্রে অবদান রেখেছেন।
শান্তিনিকেতনে জওহরলাল নেহরুর প্রথম পা পড়েছিল ১৯২০ সালে। তিনি মহাত্মা গান্ধীর দলের এক সামান্য সদস্য। কিন্তু, সেই প্রথম দর্শনই তাঁর মনে গভীর প্রভাব ফেলেছিল। ১৯৩৪ সালে আবার ফিরে এসেছিলেন বিশ্বভারতীতে। সঙ্গী ছিলেন স্ত্রী কমলা নেহরু এবং কন্যা ইন্দিরা গান্ধী। ইন্দিরাকে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করেছিলেন তিনি। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পরও, বিশ্বভারতীর সঙ্গে যোগাযোগ ছিন্ন করেননি নেহরু। বরং, রবীন্দ্র আদর্শ ও দর্শনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে, শান্তিনিকেতন এবং বিশ্বভারতীর উন্নয়নে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। তাঁরই উদ্যোগে ‘জনগণমন অধিনায়ক’কে দেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছিল। পাশাপাশি, ১৯৫১ সালে বিশ্বভারতী বিল পাশ করার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন জওহরলাল নেহেরু। কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা পাওয়ায়, কিছুটা হলেও বিশ্বভারতীর আর্থিক সঙ্কটের সমাধান হয়েছিল।
১৯৪৯ সাল থেকে ১৯৬৪ সালে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত বিশ্বভারতীর আচার্য পদে ছিলেন জওহরলাল নেহরু। প্রত্যেকটি বার্ষিক সমাবর্তনে অংশ নিয়েছিলেন তিনি। উপাচার্যদের নির্বাচন, ঠাকুর জাদুঘর প্রতিষ্ঠা, বিশ্বভারতীর জন্য একটি মাস্টার প্ল্যান নকশা করা থেকে শুরু করে ছোটখাট বিরোধে নিষ্পত্তি, আমলাতান্ত্রিক প্রতিবন্ধকতা দূর করা – প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব সামলানোর পাশাপাশি বিশ্বভারতীর প্রতিটি বিষয়েই নজর ছিল জওহরলালের।
১৯৩৪ থেকে ১৯৩৫ – মাত্র এক বছরই শান্তিনিকেতনে পড়াশোনা করেছিলেন ইন্দিরা। আশ্রমের পরিবেশ তাঁর কাছে ছিল একেবারে নতুন। ভোর ৪টেয় ঘুম থেকে ওঠা থেকে, আলো-পাখার বিলাস ছাড়া জীবনযাপন, নিজে হাতে কাপড় কাচা, ঘর পরিষ্কার করা, খাদির শাড়ি পরা, গাছের নীচে ক্লাস করা, শান্তিনিকেতনের বিভিন্ন উৎসবে অংশ নেওয়া, পৌষ মেলায় নাগরদোলা চড়ার জীবনের সঙ্গে তিনি কীভাবে খাপ খাইয়ে নিয়েছিলেন, তার পরিচয় পাওয়া যায় বাবা জওহরলাল নেহেরুকে লেখা চিঠিতে। অনেক পরে, ১৯৬৬ থেকে ১৯৭৮ এবং ১৯৮২ থেকে ১৯৮২ – দুই মেয়াদে আচার্যের দায়িত্ব পালন করেছিলেন তিনি। তাঁর জীবনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং শান্তিনিকেতনের প্রভাবের বিষয়ে তিনি বলেছিলেন, “বাইরে যাই ঘটুক না কেন, নিজের মনের মধ্যে কীভাবে শান্ত থাকতে হয়, তা আমি শান্তিনিকেতনেই শিখেছিলাম।”
রাজীব গান্ধী আচার্য ছিলেন ১৯৮৫ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত। বিশ্বভারতীর আচার্য এবং দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি শান্তিনিকেতনের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেস চালু করেছিলেন। তাঁর উদ্যোগেই বিশ্বভারতীতে তৈরি হয়েছিল কম্পিউটার সেন্টার। রামকিঙ্কর বেইজের ভাস্কর্যগুলির পুনরুদ্ধার প্রকল্পও শুরু হয়েছিল তাঁর সময়েই। ইস্টার্ন জোনাল কালচারাল সেন্টার নামে এক নয়া আর্ট গ্যালারি স্থাপন করেছিলেন তিনি। শান্তিনিকেতনের উন্নয়নের জন্য তিনি একটি ২০ বছরের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাও করেছিলেন। ১৯৮৯ সালে তিনি শেষবার শআন্তিনিকেতনে এসেছিলেন। সেইবার তিনি সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে দেরির জন্য অসন্তুষ্টিও প্রকাশ করেছিলেন।
প্রধানমন্ত্রীর পদে থাকাকালীন ১৯৯২ সালে শান্তিনিকেতনে বার্ষিক সমাবর্তন অনুষ্ঠানে ভাষণ দিয়েছিলেন পিভি নরসীমা রাও। তিনি বলেছিলেন, বিশ্বভারতীতে আসা মানে এক সর্বজনীন বাড়িতে আসা। এটি এক তীর্থযাত্রা। এই বিশাল ও সুন্দর বিস্তৃতির অভ্যন্তরীণ নিস্তব্ধতায় আমরা নীরবতার শব্দ শুনছি। মনে হচ্ছে আমরা উপনিষদের যুগে ফিরে গিয়েছি। এমন পরিবেশেই প্রাচীন ঋষিরা তাঁদের শিষ্যদের কাছে জ্ঞান সঞ্চার করেছিলেন।” তিনি বক্তৃতা শেষ করেছিলেন, “সত্যম বদ, ধর্মম চর, স্বাধ্যায়ম মা প্রমদাহ। অর্থাৎ, “সত্য কথা বল, কর্তব্য পালন করে চল, পড়াশোনায় অবহেলা কোরো না।” তাঁর এই বক্তৃতায় মুগ্ধ হয়েছিল শান্তিনিকেতনের সেই সময়ের ছাত্রছাত্রীরা।
আবার, ২০০১ সালে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শান্তিনিকেতনে, বিশ্বভারতীর সমাবর্তনে এসে ছাত্রছাত্রীদের বিক্ষোভের মুখে পড়ত হয়েছিল তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ীকে। হাঁটুর ব্যথার কারণে, সমাবর্তনের শোভাযাত্রায় হাঁটবেন না, ছাত্রছাত্রীদের শংসাপত্র ও সপ্তপর্ণী (ছাতিম গাছের পাতা) দিতে পারবেন না বলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। এই দুই বিষয়ই বিশ্বভারতীর দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য। ফলে, অটলবিহারী বাজপেয়ীর সামনেই বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেছিলেন ছাত্রছাত্রীরা। তৎকালীন উপাচার্য সুজিত বসুর কাছ থেকে পুরো বিষয়টি জানেন প্রধানমন্ত্রী। তারপর মাইক হাতে নিয়ে ছাত্রছাত্রীদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ‘কী করব বল! তোমাদের আচার্য বেশিক্ষণ দাঁড়াতে পারেন না। ঐতিহ্য মানতে গেলে তো আর বসে বসে সপ্তপর্ণী আর শংসাপত্র দেওয়া যায় না।’ থেমে গিয়েছিল বিক্ষোভ। তারপর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘গ্রাম ছাড়া ওই রাঙামাটির পথ’ দিয়ে ভাষণ শুরু করেছিলেন বাজপেয়ী।
মনমোহন সিং-এর মেয়াদ শেষের পর, ২০১৫ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে বিশ্বভারতীর আচার্য ঘোষণা করা হয়েছিল। তাঁর আমলে ২০১৮ সালে বিশ্বভারতীর বাংলাদেশ ভবনের উদ্বোধন করা হয়। এই উদ্বোধন অনুষ্ঠান উপলক্ষে বিশ্বভারতীতে এসেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং বাংলাদেশি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, “রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর সময়ে বিশ্ব নাগরিক ছিলেন, এখনও তিনি বিশ্ব নাগরিক। আমি যে যে দেশে গিয়েছি, সব জায়গার মানুষকে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের মূল্যবোধ বহন করতে দেখেছি। আফগানিস্তানে, সবাই তাঁর কাবুলিওয়ালার গল্প জানে।” কোভিড মহামারির মধ্যে, ২০২০-তে বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ পূর্তি উপলক্ষে ভিডিয়ো কনফারেন্সিং-এর মাধ্যমে বক্তৃতা দিয়েছিলেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী মোদী বলেছিলেন, গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই বিশ্ববিদ্যালয়কে শুধুমাত্র একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবেই কল্পনা করেননি। তিনি চেয়েছিলেন এমন এক প্রতিষ্ঠান স্থাপন করতে, যা ভারতীয় সংস্কৃতির পূর্ণ ক্ষমতাকে উপলব্ধি করতে পারবে।