নয়া দিল্লি: নতুন রূপে সেজে উঠছে রাজধানী। প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির বাসভবন, নতুন সংসদ ভবন থেকে শুরু করে কর্তব্য পথ- সেন্ট্রাল ভিস্তা প্রকল্পের (Central Vista Project) অধীনে রাজধানীকে ঔপনিবেশিকতার প্রতীক থেকে মুক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছে নরেন্দ্র মোদী সরকার। ৭৫ তম স্বাধীনতা দিবসে দেশজুড়ে অমৃত মহোৎসব উদযাপনের সঙ্গে সঙ্গে ঔপনিবেশিকতার সমস্ত প্রতীক বিলুপ্তির উপর জোর দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী (PM Narendra Modi)। আর সেটার সূচনা হয়েছিল কর্তব্য পথ-এর মাধ্যমে। গত বছরের ৮ সেপ্টেম্বর কর্তব্য পথের উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তার ৮ মাসের মাথায় আরও এক ঔপনিবেশিক প্রতীকের বিলুপ্তি ঘটতে চলেছে। স্বাভাবিকভাবেই নতুন সংসদ ভবন উদ্বোধনের মুহূর্তে বিশেষ প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে কর্তব্য পথ (Kartavya Path)।
কর্তব্য পথের ইতিহাস ঘাঁটলে জানা যায়, রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে ইন্ডিয়া গেট পর্যন্ত রাস্তাটির আগে নাম ছিল কিংস ওয়ে। ১৯১১ সালে ব্রিটিশ সরকার যখন তাদের সাম্রাজ্যের রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লিতে স্থানান্তরিত করার সিদ্ধান্ত নেয়, নতুন শহর নির্মাণের কাজ শুরু করে। এই কাজের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্রিটিশ আর্কিটেক্ট স্যার এডউইন লুটিয়েন্স একটি ‘আনুষ্ঠানিক অক্ষ’কে কেন্দ্র করে একটি আধুনিক শহরের নকশা তৈরি করেন। সেই অক্ষটিরই নাম দেওয়া হয় কিংস ওয়ে। লন্ডনের কিংসওয়ে রাস্তার অনুকরণে এবং ব্রিটিশ রাজা পঞ্চম জর্জকে সম্মান জানিয়ে দিল্লির এই রাস্তার নাম দেওয়া হয়ে কিংস ওয়ে। কেননা সেই সময় পঞ্চম জর্জ দিল্লি সফর করেন এবং তাঁর বাবা, রাজা সপ্তম এডওয়ার্ডের সম্মানে লন্ডনে করা হয়েছিল কিংস ওয়ে। পরবর্তীতে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কিংস ওয়ের হিন্দি তর্জমা করে এই রাস্তার নামকরণ করা হয় রাজপথ।
এই নামকরণ যে কেবল অনুবাদ বলা যাবে না। রাজপথের আক্ষরিক অর্থ ‘রাজার চলার পথ’। আর এই পথ দিয়ে তৎকালীন ভাইসরয়ের প্রাসাদ, বর্তমানে রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে ইন্ডিয়া গেট বাধাহীনভাবে যাওয়া যায়। আর রাজপথের দুইপাশে নর্থ ব্লক এবং সাউথ ব্লক রয়েছে, যা ভারতের কেন্দ্রীয় সচিবালয়। নর্থ ব্লকে অর্থ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কার্যালয় রয়েছে। সাউথ ব্লকে রয়েছে বিদেশ ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রক। রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মতো অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কার্যালয় ও সচিবালয় ভবনও। সবমিলিয়ে, কাজ অনুসারে এই নামকরণ আপাতদৃষ্টিতে যথার্থ ছিল।
২০২২ সালের ৮ সেপ্টেম্বর ঔপনিবেশিকতার প্রতীক হিসাবে রাজপথ নামকরণের বিলুপ্তি ঘটিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী রাইসিনা হিলস থেকে ইন্ডিয়া গেট পর্যন্ত ১৬.৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পথের নাম দেন কর্তব্য পথ। প্রধানমন্ত্রীর কথায়, “পথের নামই যদি রাজপথ হয়, সেখানে থেকে কেউ নিজেকে দেশের সেবক কী করে মনে করবে? কিন্তু, এখন কর্তব্য পথ দিয়ে যাওয়ার সময় দেশের সকলে কর্তব্য পালনে অনুপ্রাণিত হবে। আমরা ঔপনিবেশিকতার আরেকটি প্রতীক ছেড়ে বেরিয়ে এলাম।” কর্তব্য পথের মাধ্যমে দেশে একটি নতুন যুগের সূচনা হল এবং শ্রমকে সম্মান জানানোর এক পুরোনো ঐতিহ্য নতুন করে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
কেবল রাজপথ-এর নাম বদলে কর্তব্য পথ করা নয়, সেন্ট্রাল ভিস্তা প্রকল্পের অধীনে গোটা রাস্তাটি সুন্দর করে সাজানো হয়। কর্তব্য পথে হাঁটার জন্য সুসজ্জিত লন, সবুজ মাঠ, সংস্কার করা খাল, ভেন্ডিং কিয়স্ক, পথচারীদের জন্য আন্ডারপাস, উন্নত পার্কিং এলাকা, নতুন প্রদর্শনী প্যানেল এবং আপগ্রেড নাইট লাইটিং যুক্ত করা হয়েছে। এছাড়া পথচলতি মানুষের সুবিধার জন্য কর্তব্য পথে গণ শৌচাগার, পানীয় জল, বসার জায়গা করা হয়েছে। আবার কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, ঝড়-বৃষ্টির জল ব্যবস্থাপনা, জলের পুনর্ব্যবহার, বৃষ্টির জল সংগ্রহ এবং সংরক্ষণ এবং শক্তি-সাশ্রয়ী আলোর ব্যবস্থার মতো বেশ কয়েকটি টেকসই বৈশিষ্ট্যও যোগ করা হয়েছে। এছাড়া ইন্ডিয়া গেটের কাছে যেখানে রাজা পঞ্চম জর্জের মূর্তি ছিল, সেখানে ২৮ ফুটের নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর একটি মূর্তি বসানো হয়। বলা যায়, সেন্ট্রাল ভিস্তা প্রকল্পের অধীনে ৬০৮ কোটি টাকা বরাদ্দে নামকরণ থেকে গোটা রাস্তাটি যেমন আমূল বদলে গিয়েছে, তেমনই ঔপনিবেশিকতার একটি প্রতীকের বিলুপ্তি ঘটেছে।