গত শনিবার (১২ অক্টোবর) রাতে, মুম্বইয়ে তার ছেলের অফিসের বাইরে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে এনসিপি নেতা বাবা সিদ্দিকিকে। বান্দ্রা এলাকায় রিয়েল এস্টেট ব্যবসার অকচ্ছত্র অধিপতি ছিলেন তিনি। সেই সঙ্গে পরিচিত ছিলেন জমকালো ইফতার পার্টি আয়োজনের জন্য। তাঁকে হত্যার দায় স্বীকার করেছে লরেন্স বিষ্ণোই গ্যাং। আর এই হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে মুম্বই শহরে ফিরে এসেছে অন্ধকার জগত এবং বিভিন্ন গ্যাংয়ের মধ্যে লড়াই নিয়ে আতঙ্ক। গত শতাব্দীর সাতের দশকের শেষ থেকে টানা প্রায় তিন দশক ধরে মুম্বই শহর ছিল দাউদ ইব্রাহিম, ছোট রাজন, আবু সালেমদের দখলে। বিষ্ণোই গ্যাংয়ের হাতে বাবা সিদ্দিকির হত্যা, সেই আতঙ্ককে আবার ফিরিয়ে এনেছে। অথচ, বর্তমানে গুজরাটের সবরমতি কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি আছে লরেন্স বিষ্ণোই। গত ১২ সেপ্টেম্বর, দক্ষিণ দিল্লিতে এক জিম-মালিককে হত্যা করার দায়ে, তার বিরুদ্ধে বেআইনি কার্যকলাপ প্রতিরোধ আইন বা ইউএপিএ-তে অভিযোগ আনা হয়েছিল। সেই মামলাতেই আপাতত জেলে আছে সে। সেখান থেকে কীভাবে সে তার গ্যাং-এর কাজকর্ম চালাচ্ছে? কীভাবে সে কুখ্যাত গ্যাংস্টার হয়ে উঠল? আর কোন কোন হাই-প্রোফাইল মামলায় সঙ্গে জড়িয়েছে এই গ্যাংয়ের নাম? সর্বোপরি, তার গ্যাংয়ের পরিধি যেভাবে দ্রুত বাড়ছে, তাতে খুব শিগগিরই কি দাউদ ইব্রাহিমের ডি কোম্পানির সঙ্গে বিষ্ণোই গ্যাংয়ের, ‘গ্যাং ওয়ার’ শুরু হতে পারে?
কে লরেন্স বিষ্ণোই, তার বিরুদ্ধে কী কী অভিযোগ আছে?
৩১ বছরের এই গ্যাংস্টার পঞ্জাবের ফেরজোপুর জেলার ধাতারানওয়ালি গ্রামের এক ধনী কৃষক পরিবারের সন্তান। দ্বাদশ শ্রেণির পড়াশোনা শেষ করে, ২০১০-এ চণ্ডীগঢ়ে ডিএভি কলেজে ভর্তি হয়েছিল সে। জড়িয়ে পড়েছিল ছাত্র রাজনীতিতে। পঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের সভাপতিও নির্বাচিত হয়েছিল সে। কলেজে থাকাকালীনই, ২০১০ সালের এপ্রিলে তার বিরুদ্ধে খুনের চেষ্টার মামলা দায়ের হয়েছিল। সেটাই ছিল তার বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া প্রথম ফৌজদারি অভিযোগ। একই সময়ে একটি বাড়িতে জোর করে ঢোকার অভিযোগে আরেকটি এফআইআর দায়ের করা হয়েছিল তার বিরদ্ধে। এর পরের বছরে তার বিরুদ্ধে মারধর করা এবং মোবাইল ফোন ছিনতাইয়ের অভিযোগও ওঠে। তিনটি মামলাই ছিল ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে জড়িত।
২০১২ সালে ভাতিন্ডায় প্রথম কারাবাস করে লরেন্স বিষ্ণোই। মহারাষ্ট্র কন্ট্রোল অব অর্গানাইজড ক্রাইম অ্যাক্টে অভিযুক্ত হওয়ার পর, তাকে তিহার জেলে পাঠানো হয়। ২০১৩ সালে, মুক্তসরের সরকারি কলেজ নির্বাচনে বিজয়ী এক প্রার্থী এবং লুধিয়ানা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীকে গুলি করে হত্যা করেছিল সে। এইভাবে, বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতাদের হত্যা করা এবং তোলাবাজি করা-সহ প্রায় ২০-২৪টি ফৌজদারি মামলা রয়েছে লরেন্স বিষ্ণোইয়ের বিরুদ্ধে। এখানেই শেষ নয়, ক্রমে তার দলবল মদ এবং অস্ত্রের আন্তঃসীমান্ত চোরাচালান শুরু করে।
বিষ্ণোই-এর গ্যাং এবং মূল সহযোগীরা?
লরেন্স বিষ্ণোইয়ের গ্যাং-এর কাজকর্ম, শ্রীগঙ্গানগর, ভরতপুরের মতো শহরে ছড়িয়ে দিতে মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিল জসবিন্দর সিং ওরফে রকি। পাঞ্জাবের ফাজিলকরের বাসিন্দা রকি ছিল একাধারে গ্যাংস্টার এবং রাজনীতিবিদ। ছাত্র রাজনীতির আড়ালে সে অপরাধমূলক কার্যক্রম চালাত। ২০২০-র মে মাসে হিমাচল প্রদেশে, জয়পাল ভুলার নামে প্রতিদ্বন্দ্বী গ্যাং-এর এক সদস্য তাকে হত্যা করেছিল। জগ্গু ভগবানপুরিয়া, সম্পত নেহরা, কালা জাথেদির মতো হরিয়ানার কুখ্যাত গ্যাংস্টারদের সঙ্গে এই গ্যাংয়ের ভাল সম্পর্ক রয়েছে। এছাড়া, লরেন্স বিষ্ণোইয়ের ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের মধ্যে রয়েছে গোল্ডি ব্রার। গায়ক সিধু মুসেওয়ালাকে হত্যায় যার নাম জড়িয়েছিল। গ্যাংয়ের যাবতীয় কার্যক্রম সে-ই পরিচালনা করে। শ্যুটারদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে। এছাড়া রয়েছে লরেন্সের ভাই আনমোল বিষ্ণোই।
এনআইএ-র খবর অনুসারে, বর্তমানে দেশের পাঁচটি রাজ্যে বিষ্ণোই গ্যাংয়ের ৭০০রও বেশি শুটার রয়েছে। পঞ্জাবেই রয়েছে কমপক্ষে ৩০০ জন শ্যুটার। লরেন্স বিষ্ণোইয়ের গ্যাং, সাধারণত তরুণদের নিয়োগ করে। এর জন্য তারা আশ্রয় নেয় সোশ্যাল মিডিয়ার। কানাডা-সহ বিভিন্ন পশ্চিমী দেশে পাঠানোর লোভ দেখিয়ে অল্পবয়সীদের নিজেদের গ্যাংয়ে সামিল করে তারা। এই গ্যাংয়ের আন্তর্জাতিক যোগাযোগও নেহাত কম নয়। হরবিন্দর সিং রিন্দার মতো খালিস্তানি সন্ত্রাসবাদী-সহ বিদেশি বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে স্বার্থের সম্পর্ক রয়েছে এই গ্যাংয়ের। এই সংগঠনগুলি বিষ্ণোই গ্যাংকে সহায়তা করার বিনিময়ে, পঞ্জাবে ও ভারতে তাদের বিভিন্ন নিশানাকে হত্যার জন্য বিষ্ণোইয়ের শুটারদের কাজে লাগায়।
কীভাবে জেল থেকে গ্যাং চালাচ্ছে বিষ্ণোই?
এনআইএ-এর মতে, খালিস্তানপন্থী জঙ্গি সংগঠনগুলির সঙ্গে তার যে যোগাযোগ রয়েছে, সেই সকল যোগাযোগকে কাজে লাগিয়েই জেল থেকে গ্যাংয়ের কাজকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে লরেন্স বিষ্ণোই। জামিনের আবেদন করে না সে। এনআইএ-র মতে, সেটা তার কৌশল। এইভাবে জেলের নিরাপত্তায় থেকে সে তার গ্যাং চালাচ্ছে। ‘ভিওআইপি’ এবং ‘ডাব্বা কলিং’-এর মতো যোগাযোগ পদ্ধতি ব্যবহার করে যোগাযোগ রাখে সহযোগীদের সঙ্গে। ভিওআইপি বা ভয়েস ওভার ইন্টারনেট প্রোটোকল হল এমন এক প্রযুক্তি, যা ব্যবহার করে ব্যবহারকারীরা প্রথাগত ফোন কলের পরিবর্তে ইন্টারনেট সংযোগের মাধ্যমে ভয়েস এবং ভিডিয়ো কল করতে পারে। অন্যদিকে, ‘ডাব্বা কলিং’ ব্যবহার করে অপরাধীদের অবৈধভাবে যোগাযোগ করে। যে প্রচলিত নজরদারি ব্যবস্থাকে আছে, তাতে এই যোগাযোগ ধরা পড়ে না।
সলমন খানের সঙ্গে বিষ্ণোই গ্যাংয়ের বিরোধ
১৯৯৮ সালে ‘হাম সাথ সাথ হ্যায়’-এর শুটিংয়ের সময়, রাজস্থানে দুটি কৃষ্ণসার হরিণ শিকার এবং হত্যার অভিযোগ উঠেছিল অভিনেতা সলমন খানের বিরুদ্ধে। প্রাথমিকভাবে এই মামলায় সলমনকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হলেও, পরে তিনি জামিনে মুক্তি পান। কৃষ্ণসার হরিণ বিষ্ণোই সম্প্রদায়ের কাছে অত্যন্ত পবিত্র। ২০২৩ সালে তিহার জেল থেকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে, লরেন্স বিষ্ণোই বলেছিল, তার জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য ল সলমন খানকে হত্যা করা। সে বলেছিল, “আমরা টাকা চাই না। আমরা শুধু চাই তিনি আমাদের সম্প্রদায়ের মন্দিরে যান এবং আমাদের কাছে ক্ষমা চান। কৃষ্ণসার হরিণ শিকার করে তিনি আমাদের সমগ্র সম্প্রদায়কে অপমান করেছেন। তার বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছে। কিন্তু, তিনি ক্ষমা চাইতে নারাজ।”
গত বছরের নভেম্বরে, গিপ্পি গ্রেওয়াল নামে এক পাঞ্জাবি গায়ককে সম্বোধন ফেসবুকে একটি বার্তা দিয়েছিল লরেন্স বিষ্ণোই। তাতে লেখা ছিল, “আপনি সলমন খানকে ভাই বলে মনে করেন। এখন সেই ‘ভাই’য়ের আপনাকে বাঁচাতে হবে। এই বার্তাটা সলমন খানের জন্যও। দাউদ আপনাকে বাঁচাবে এমন বিভ্রান্তিতে থাকবেন না। কেউ আপনাকে বাঁচাতে পারবে না। সিধু মুসেওয়ালার মৃত্যুতে আপনার নাটকীয় প্রতিক্রিয়া নজর এড়ায়নি। আমরা সবাই জানি সে কেমন ছিল এবং কোন অপরাধী সংগঠনের সঙ্গে তার যোগ ছিল। আপনি এখন আপনি আমাদের রাডারে। এটি একটা ট্রেলার, শিগগিরই পুরো সিনেমাটা মুক্তি পাবে। আপনি যে দেশে ইচ্ছা পালাতে পারেন, কিন্তু মনে রাখবেন মৃত্যুর ভিসা লাগে না। বিনা আমন্ত্রণেই এটা আসে।”
এরপর ২০২৪-এর এপ্রিলে, বান্দ্রায় সলমন খানের বাড়ির বাইরে গুলি চলেছিল। দুই সন্দেহভাজনকে আটক করা হয়েছিল। জেরায় তারা জানিয়েছিল, তারা বিষ্ণোই গ্যাংয়ের সদস্য। তার আগে, ২০২৩ সালের মার্চে একটা হুমকি ইমেল পেয়েছিলেন সলমন খানের ম্যানেজার। এরপর লরেন্স বিষ্ণোই, গোল্ডি ব্রার এবং মোহিত গর্গ নামে বিষ্ণোই বিরুদ্ধে একটি এফআইআর নথিভুক্ত করা হয়েছিল। গর্গের আইডি থেকেই ইমেলটি পাঠানো হয়েছিল। এতে সলমনের প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হয়েছিল। তার আগে ২০২২-এর জুনে, বান্দ্রা ব্যান্ডস্ট্যান্ডেও একটি হুমকি চিঠি পাওয়া গিয়েছিল। ২০১৮ সালে আদালতে দাঁড়িয়ে লরেন্স বিষ্ণোই বলেছিল, “আমরা যোধপুরে সলমন খানকে হত্যা করব। আমরা ব্যবস্থা নিলেই সবাই জানতে পারবে। আমি এখনও পর্যন্ত কিছুই করিনি।”
ডনদের প্রত্যাবর্তন?
মুম্বইকে বলা হয় ‘সিটি অব ড্রিমস’ বা স্বপ্নের শহর। তবে এই শহর, শুধুমাত্র সাধারণ মানুষের স্বপ্নপূরণের নয়, হাজি মস্তান, করিম লালা, বরদারাজন মুদালিয়ার, অরুণ গাওলির মতো কুখ্যাত ডনদের স্বপ্নপূরণেরও শহর। গত শতাব্দীর নয়ের দশকে মুম্বইয়ের রাস্তায় শুরু হয়েছিল রক্তাক্ত গ্যাং-ওয়ার। দাউদ ইব্রাহিম, ছোটা শাকিল, আবু সালেম, ছোট রাজনদের মতো ডনদের তাণ্ডব চলত। হত্যা, তোলাবাজি, পুলিশ এনকাউন্টারের নিয়মিত সাক্ষী ছিল মুম্বই। ২০০০-এর প্রথম দশকে, আবু সালেম এবং ছোট রাজনদের মতো গ্যাং নেতাদের বিচার ব্যবস্থার আওতায় আনা হয়। মুম্বই ছেড়ে পাকিস্তানে পালাতে বাধ্য হয় দাউদ ইব্রাহিম। ধীরে ধীরে, আন্ডারওয়ার্ল্ডের গর্জন হারিয়ে গিয়েছিল মুম্বই শহর থেকে। বাবা সিদ্দিকির হত্যাকাণ্ড ফের মুম্বইয়ে সেই সব দিন ফিরিয়ে আনতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
শূন্যতা পূরণ
সাংবাদিক কিরণ তারের মতে, বাবা সিদ্দিকির হত্যাকাণ্ড সম্ভাব্য ব্যবসায়িক শত্রুতার ফল। কন্ট্র্যাক্ট কিলিং বা চুক্তি ভিত্তিক হত্যা করা হয়েছে তাকে। তাঁর মতে, মুম্বইয়ে বর্তমানে গ্যাং-নেতাদের যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে, সম্ভবত সেই জায়গা পূরণ করতে চাইছে লরেন্স বিষ্ণোই। যে শহর একসময় ছিল দাউদ ইব্রাহিমের, সেটা দখল করতে চাইছে সে। মুম্বই পুলিশের প্রাক্তন এসিপি, ধনরাজ ভাঞ্জারি জানিয়েছেন, গত কয়েক দশক ধরে মুম্বইয়ের রাজনীতির অনেক গভীরে জড়িয়ে গিয়েছে অপরাধ জগত। আন্ডারওয়ার্ল্ডের সঙ্গে রাজনীতিবিদ এবং সেলিব্রিটিদের সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। অপরাধীদের কাছ থেকে তারা যেমন নিরাপত্তা পায়, তেমনই অর্থও পায়। বাবা সিদ্দিকির হত্যা, এই বিষয়টিকে নতুন করে সামনে এনে দিয়েছে।