নয়া দিল্লি: হিটলারের জার্মানিতে অত্যন্তক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন পল জোসেফ গোয়েবেল্স। নাৎসি পার্টির প্রোপাগান্ডা শাখার প্রধান, একই সঙ্গে ১৯৩৩ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত জার্মান সরকারের প্রোপাগান্ডা মন্ত্রীর দায়িত্বেও ছিলেন তিনি। তাঁর একটি উক্তি, চিরন্তন হয়ে আছে – ‘একটি মিথ্য়া বারবার বল, তা ক্রমে সত্যিতে পরিণত হবে’। বিশেষ করে আজকের সোশ্যাল মিডিয়ায় যুগে, এই উক্তি আরও বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। সোশ্যাল মিডিয়া যে আজ আমাদের যাপনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, তা কেউই অস্বীকার করতে পারবেন না। আর এই সামাজিক মাধ্যম হল ভুয়ো খবর, মিথ্যা খবর, সাজানো-বানানো খবরের, প্রতারণামূলক খবরের আঁতুড় ঘর। সোশ্যাল মিডিয়ায় ভুয়ো খবরে, সাধু হয়ে যেতে পারে চোর, আর চোর হয়ে যেতে পারে সাধু। এই ভুয়ো প্রচারের শিকার কিন্তু, যে কেউ হতে পারেন। এমনকি, প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারও সোশ্যাল মিডিয়া ট্রোলারদের নিশানা থেকে মুক্ত নয়।
চলতি বছরের ২৮ জানুয়ারি, রাজস্থানের ভিলওয়ারা জেলার আসিন্দে বিখ্যাত দেবনারায়ণ মন্দিরে গিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ভগবানের কাছে তিনি প্রার্থনা করেছিলেন, সম্ভবত তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় ফেরার জন্য ভগবানের আশীর্বাদ চেয়েছিলেন। প্রথা মেনে, দানপাত্রে কিছু অর্থ দানও করেন। ওই ঘটনা সেখানেই শেষ হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আট মাস বাদে, হঠাৎ করেই সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড় তুলেছে প্রধানমন্ত্রীর সেই মন্দির দর্শনের খবর। মন্দিরের পুরোহিতকে উদ্ধৃত করে দাবি করা হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রীর দান করা খামে মাত্র ২১ টাকা ছিল। অর্থাৎ, ওই মন্দিরে তিনি মাত্র ২১ টাকা দান করেছিলেন। এই ঘটনার ভিডিয়ো বলে দাবি করে, একটি ভিডিয়ো ফুটেজও প্রকাশ করা হয়েছে। আর তারপরই, সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অস্বস্তিকর মন্তব্যের বন্যা বইয়ে দিয়েছে ট্রোলাররা।
আসল কাহিনি অবশ্য আলাদা। ২১ টাকা দানের ভিডিয়ো ভাইরাল হওয়ার পরদিনই, ওই একই অনুষ্ঠানের আরও একটি ভিডিয়ো প্রকাশিত হয়েছে। সেই ভিডিয়োতে দেখা যাচ্ছে, খাম ছাড়াই ওই মন্দিরে দান করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। আর তাও মোটে ২১ টাকা নয়, তাঁকে একটি পাঁচশ’ টাকার এবং একটি দুশ’ টাকার নোট সরাসরি দানপাত্রে গুঁজে দিতে দেখা যায়। অর্থাৎ, ২১ টাকা দানের খবরটি ভুয়ো। হয় ভ্রান্ত ধারণার কারণে এই ভুয়ো খবর তৈরি হয়েছে। অথবা, ইচ্ছাকৃতভাবে এই ভুয়ো খবর ছড়ানো হয়েছে। এমনকী, ওই মন্দিরের যে পুরোহিতকে উদ্ধৃত করা হয়েছে, তিনি আদৌ সত্যিকারের পুরোহিত কিনা, তা নিয়েও সংশয় রয়েছে। এটাই ভুয়ো খবরের জগৎ। যার শিকার হতে পারেন, সাধু-সন্ন্যাসী থেকে প্রধানমন্ত্রী-মুখ্যমন্ত্রী – যে কেউ। নিরাপদ কেউই নয়।
অনেকে বলছেন, ওই পুরোহিত ভুল বুঝেছেন। সম্ভবত, তিনি সত্যি সত্যিই বিশ্বাস করেছেন, ওই খামে থাকা ২১ টাকাই প্রধানমন্ত্রীর অনুদান। তবে, অনেকে এর পিছনে ষড়যন্ত্রের তত্ত্বও দিয়েছেন। এই পক্ষের মতে, ইচ্ছাকৃতভাবে কুৎসা রটানোর চেষ্টা করা হয়েছে। সামনেই পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা এবং লোকসভা নির্বাচন। তার আগে, প্রধানমন্ত্রীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এই যুক্তি একেবারেই উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। বস্তুত, নির্বাচন যত এগিয়ে আসছে, সব পক্ষের রাজনীতিবিদদেরই ব্যক্তিগত আক্রমণ ধার আরও বাড়ছে। নির্বাচনের মাস আটেক আগে হঠাৎ করেই, প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষাগত যোগ্যতা, তাঁর বৈবাহিক সম্পর্ক, তাঁর চশমা, তাঁর ঘড়ির ব্র্যান্ডের মতো ব্যক্তিগত বিষয়গুলি জনগণের চর্চার বিষয় করে তোলা হচ্ছে। মানুষের প্রকৃত সমস্যাগুলি হারিয়ে যাচ্ছে আলোচনা থেকে। অতীতেও এটা বারবার ঘটেছে, আগামীদিনেও হবে, তা বলাই বাহুল্য। নির্বাচন এগিয়ে আসলেই, প্রধানমন্ত্রী মোদীকে নিয়ে মিথ্যা প্রচার শুরু হয়।
খুব বেশি দূরে যেতে হবে না। চলতি মাসের শুরুতে নয়া দিল্লিতে জি২০ শীর্ষ সম্মেলনের সময়ই ভুয়ো খবরের শিকার হয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি পোস্ট ভাইরাল হয়েছিল। সেই পোস্টের ছবিতে দেখা গিয়েছিল, জি২০-র একটি হোর্ডিংয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদীকে বিশ্বের সবথেকে জনপ্রিয় নেতা হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। ছবিটির সত্যতা যাচাই না করেই, শশী থারুর, পবন খেরাদের মতো কংগ্রেস নেতারা মেতেছিলেন নিন্দার খেলায়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনেতাদের সামনে, এটা অশোভন বলে মন্তব্য করেন তাঁরা। পরে অবশ্য জানা গিয়েছিল, এমন কোনও হোর্ডিংয়ের অস্তিত্বই ছিল না। পুরো ঘটনাটিই ভুয়ো বলে স্পষ্ট জানিয়েছিল বিজেপি।
শুধু কি প্রধানমন্ত্রীই ভুয়ো খবরের শিকার? না, সনিয়া গান্ধী, রাহুল গান্ধী থেকে শুরু করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পর্যন্ত কংগ্রেস ও অন্যান্য বিরোধী নেতারাও নিয়মিত ভুয়ো খবরের শিকার হন। মাসখানেক আগে যেমন, রাহুল গান্ধী সম্পর্কে সোশ্যাল মিডিয়ায় দাবি করা হয়েছিল, গম কেজি না লিটার, কীসে মাপা হয়, তাই জানেন না কংগ্রেস নেতা। আসল ঘটনা হল, গমের দাম বৃদ্ধি উল্লেখ করার আগে, জ্বালানি ও ভোজ্য তেলের কথা বলছিলেন তিনি। তারপরই গমের দাম বলতে গিয়ে, প্রতি কেজি বলার পরিবর্তে প্রতি লিটার বলে ফেলেছিলেন। পরক্ষণেই তিনি সেই ভুল সংশোধন করে নিলেও, সোশ্যাল মিডিয়ায় তাঁর বক্তব্যের প্রথম অংশটিই প্রচার করা হয়েছিল। আসলে, সোশ্যাল মিডিয়ায় ভুয়ো খবর ছড়ানোর সময় কেউ মাথায় রাখে না, একই জিনিস কিন্তু তার ক্ষেত্রেও বুমেরাংয়ের মতো ফিরে আসতে পারে।
আগেই প্রধানমন্ত্রী মোদী সোশ্যাল মিডিয়ায় ভুয়ো খবর প্রচারের বিপদ নিয়ে দেশবাসীকে সতর্ক করেছিলেন। এর ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারিত যে কোনও খবরই ভুয়ো হতে পারে। তাই সেই খবর ছড়িয়ে দেওয়ার আগে, সকলের অন্তত ১০বার ভাবা উচিত। কোনও তথ্য ফরোয়ার্ড করার আগে তা যাচাই করে নেওয়া উচিত। বিধানসভা এবং লোকসভা নির্বাচনের আগে, ভুয়ো এবং প্রতারণামূলক খবরে ছেয়ে গিয়েছে সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলি। এই অবস্থায়, প্রধানমন্ত্রীর সতর্কতাকে গুরুত্ব দেওয়ার কিন্তু সময় এসে গিয়েছে।