নয়া দিল্লি: ইন্ডিয়ার বদলে ভারত? বদলানো হবে দেশের নাম? জি২০ শীর্ষ সম্মেলনের নৈশভোজের আমন্ত্রণপত্রকে কেন্দ্র করে, উসকে উঠেছে বিতর্ক। আমন্ত্রণপত্রে, ইংরাজিতে ‘প্রেসিডেন্ট অব ইন্ডিয়া’র বদলে লেখা হয়েছে ‘প্রেসিডেন্ট অব ভারত’। এই নিয়ে বিতর্কের মধ্যে, নাম বদলের প্রসঙ্গটি তুলেছেন একাধিক বিজেপি নেতা। সংবিধানের প্রথম অনুচ্ছেদে দেশের নাম হিসেবে বলা হয়েছে “ইন্ডিয়া, অর্থাৎ, ভারত, হবে একটি যুক্তরাষ্ট্র।” বিজেপি সাংসদ হরনাথ সিং যাদবের দাবি, দুটি নাম রেখে ভুল করেছিলেন সংবিধান প্রণেতারা। বস্তুত, ইন্ডিয়া বনাম ভারত – এই নাম বিতর্ক আজকের নয়। সংবিধান রচনার দিন থেকেই এই বিতর্ক চলছে। সদ্য স্বাধীন হওয়া রাষ্ট্রের নাম কী হবে, এই নিয়ে গণপরিষদেও বড় বিতর্ক হয়েছিল। শেষে কীভাবে স্থির করা হয়েছিল দুটি নামই থাকবে? বিতর্কের সময় কে কী বলেছিলেন?
‘ইন্ডিয়া’ এবং ‘ভারত’ নিয়ে গণপরিষদের বিভিন্ন জন বিভিন্ন যুক্তি দিয়েছিলেন। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১, অর্থাৎ দেশের নাম ‘ইন্ডিয়া, অর্থাৎ, ভারত’ রাখা নিয়ে বিতর্ক শুরু হওয়ার কথা ছিল ১৯৪৮-এর ১৭ নভেম্বর। স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং উত্তর প্রদেশের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী গোবিন্দবল্লভ পন্থের পরামর্শে, একদিন পিছিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছিল ১৮ নভেম্বর। এক বছর পর, ১৯৪৯ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর, সংবিধানের প্রথম অনুচ্ছেদের চূড়ান্ত রূপটি গণ পরিষদে পেশ করেছিলেন। সেই খসড়ায় ‘ইন্ডিয়া’ এবং ‘ভারত’ দুই নামই ছিল। বেশ কয়েকজন সদস্য ‘ইন্ডিয়া’ নাম ব্যবহারের বিরুদ্ধে মত দিয়েছিলেন। এই নামের সঙ্গে ঔপনিবেশিক অতীত জড়িয়ে আছে বলে অভিযোগ করেছিলেন তাঁরা। এই অংশে ছিলেন হরি বিষ্ণু কামাথ, হরগোবিন্দ পন্থ, গোবিন্দবল্লভ পন্থ, কিশোরী মোহন ত্রিপাঠীরা।
বিশেষ করে, ইন্ডিয়া নামটি বাদ দেওয়ার জন্য একটি সংশোধনী এনেছিলেন হরি বিষ্ণু কামাথ। তিনি যুক্তি দেন, ‘ইন্ডিয়া’ শব্দটি ভারত-এর অনুবাদ। সদ্য স্বাধীন হওয়া আয়ারল্যান্ডের সংবিধানের উদাহরণ দেন তিনি। ১৯৩৭ সালে আইরিশ সংবিধান পাস হয়েছিল। সেই সংবিধানের উল্লেখ করে কামাথ জানিয়েছিলেন, আধুনিক বিশ্বের দেশ হিসেবে স্বাধীনতা অর্জনের পর নাম পরিবর্তন করেছে আইরিশ ফ্রি স্টেট। তাদের সংবিধানের চতুর্থ অনুচ্ছেদে তারা দেশের নাম পরিবর্তনের কথা বলেছে। আইরিশ ফ্রি স্টেটের সংবিধানে লেখা আছে: “রাষ্ট্রের নাম আইয়ার, বা, ইংরেজি ভাষায়, আয়ারল্যান্ড।” দেশের বিকল্প নাম হিসেবে তিনি বলেছিলেন, ভারত বা ভারতবর্ষ বা ভারতভূমি। ভারত নামের উৎপত্তিও তিনি গণপরিষদের সামনে ব্যাখ্যা করেছিলেন। দুষ্যন্ত ও শকুন্তলার পুত্র ভরতের থেকেই এই নাম এসেছে বলে অনেকে মনে করেন বলে জানিয়েছিলেন তিনি।
ইন্ডিয়া নাম বাদ দেওয়ার পক্ষে সরব ছিলেন ইউনাইটেড প্রদেশের পার্বত্য জেলাগুলির প্রতিনিধি হরগোবিন্দ পন্থও। তিনি সাফ জানিয়েছিলেন, উত্তর ভারতের জনগণ দেশের নাম হিসেবে ভারতবর্ষ ছাড়া অন্য কিছু গ্রহণ করবে না। কোন যুক্তিতে ইন্ডিয়া নামটি রাখা হচ্ছে, সেই প্রশ্ন তুলেছিলেন পন্থ। ইন্ডিয়া নামের বিরুদ্ধে তিনি পাল্টা যুক্তি দিয়েছিলেন, এই নামটি বিদেশিরা দিয়েছিল। এই দেশের সম্পদের কথা শুনে তারা প্রলুব্ধ হয়েছিল। সেই সম্পদ আহরণের জন্য, তারা ভারতবাসীর স্বাধীনতা হরণ করেছিল। এই অবস্থায়, তাদের দেওয়া নামটি আঁকড়ে ধরে থাকলে, ‘বিদেশি শাসকদের চাপিয়ে দেওয়া অপমানজনক শব্দ’ নিয়ে ভারত লজ্জিত নয়, এই বার্তা যাবে বলে দাবি করেছিলেন তিনি।
অন্যদের মধ্যে, কিশোরী মোহন ত্রিপাঠী জানিয়েছিলেন, ভারত শব্দটি সকলকে ভারতের অতীত গৌরবের কথা মনে করিয়ে দেবে। যদিও, অতীত গৌরবের কথা মনে করার প্রয়োজনীয়তা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছিলেন ড. বিআর আম্বেদকর।
শেঠ গোবিন্দ দাস, ইন্ডিয়া নামের বিরোধিতা না করলেও, ভারতকে তার আগে জায়গা দিতে চেয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন দেশের নাম হিসেবে ‘ইন্ডিয়া, অর্থাৎ, ভারত’ শুনতে ভাল লাগছে না। তিনি বলেছিলেন, “বরং আমাদের বলা উচিত, ভারত,যা বাইরের দেশে ইন্ডিয়া নামে পরিচিত।” বিষ্ণু পুরাণ এবং ব্রহ্মা পুরাণেও ‘ভারত’-এর উল্লেখ আছে বলে জানিয়েছিলেন তিনি। সপ্তম শতাব্দীর চিনা পর্যটক হিউয়েন সাং-ও একই নাম ব্যবহার করেছিলেন। কাজেই এই নামটি দেশের ইতিহাস এবং সংস্কৃতির জন্য উপযুক্ত বলে দাবি করেছিলেন তিনি। একই সঙ্গে বলেছিলেন, দেশের নাম ভারত রাখলে দেশের অগ্রগতিতে কোনও বাধা আসবে না।
এই বিতর্ক চলাকালীন, ড. বিআর আম্বেদকর, গণ পরিষদকে বেশ কয়েকবার মনে করিয়ে দিয়েছিলেন, ভারত নামের কোনও বিরোধিতা কেউ করেননি। তাই, ভারত নামের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ব্যাখ্যা নিষ্প্রয়োজন। আলোচনা হচ্ছে, শুধুমাত্র, ভারত শব্দটি ইন্ডিয়া শব্দের আগে আসা উটিত কিনা, তাই নিয়ে। তিনি আরও জানান, আরও অনেক কাজ বাকি আছে, তাই এই বিতর্ক দ্রুত শেষ করা উচিত। এরপর, গণ পরিষদে কামাথের আনা সংশোধনীটির উপর ভোটাভুটি হয়। ৫১-৩৮ ভোটে সেটি প্রত্যাখ্যান করেছিল গণ পরিষদ। বর্তমান নাম ‘ইন্ডিয়া’-র সঙ্গে ‘ভারত’ নামটিও ব্যবহার করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে পরিষদ। এভাবেই গৃহীত হয়েছিল সংবিধানের প্রথম অনুচ্ছেদ – “ইন্ডিয়া, অর্থাৎ, ভারত, একটি যুক্তরাষ্ট্র”।