নয়াদিল্লি: ব্রিটিশের অত্যাচার থেকে দেশবাসীকে মুক্তি দিতে প্রাণ বিসর্জন দিতেও পিছুপা হননি স্বাধীনতা সংগ্রামীরা। তবে এই কাজে শুধু পুরুষরা নন, সময়ে সময়ে এগিয়ে এসেছিলেন সে যুগের অনেক নারীও। কেউ সরাসরি বিপ্লবে অংশ নিয়েছিলেন। অনেকে আবার আড়ালে থেকেই সাহায্য করতেন বিপ্লবীদের। পুরুষদের পাশাপাশি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এই সব নারীদের লড়াইয়ের গুরুত্বও অপরিসীম। ২০২৩ সালের স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে টিভি৯ বাংলার প্রতিবেদনে স্মরণ করা হল এ রমকই কয়েক জন মহীয়সী নারীকে। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে যাঁদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে।
রানি ভেলু নাচিয়ার
ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামা প্রথম ভারতীয় রানি ইনি। তাঁর স্বামী ও পুত্র ব্রিটিশের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে প্রাণ দেওয়ার পর নিজের মেয়েকে নিয়ে আত্মগোপন করেছিলেন তিনি। সৈন্যদল গঠন করে ১৭৮০ সালে ব্রিটিশদের উপর আক্রমণ করেন। ব্রিটিশের সঙ্গে লড়াই করতে হায়দার আলি ও গোপাল নায়াকারের সঙ্গে জোটও গড়েন তিনি। সে সময় ব্রিটিশদের গোলাবাদরুদ রাখার জায়গায় আত্মঘাতী হামলা চালিয়েছিল রানির ঘনিষ্ঠ অনুগামী কুইলি। এতে ব্রিটিশদের অস্ত্রাগারের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল।
ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাই
ঝাঁসির মহারাজার মৃত্যুর পর ঝাঁসি সিংহাসন দখল করার উদ্যোগ নেয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। সেই লক্ষ্যে ১৮৫৮ সালের ২৩ মার্চ ঝাঁসি আক্রমণ করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। তখন ঝাঁসির সেনাকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন লক্ষ্মীবাই। সেই যুদ্ধেই শহিদ হয়েছিলেন তিনি।
প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার
প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার প্রথম ভারতীয় মহিলা বিপ্লবী যিনি শহিদ হয়েছিলেন। চট্টগ্রামের ধলঘাট গ্রামে জন্ম তার। মাস্টারদা সূর্য সেনের সংস্পর্শে এসে বিপ্লবী কার্যকলাপের সঙ্গে জড়িত হন। ১৯৩২ সালের ২৩শে সেপ্টেম্বর মাস্টারদার নেতৃত্বে “ ইউরোপীয় ক্লাব” আক্রমনে অংশ নেন তিনি। কিন্তু ব্রিটিশ বাহিনীর সঙ্গে গুলির লড়াইয়ে আহত হন। ব্রিটিশের হাতে ধরা পড়া আটকাতে বিষ খেয়ে মৃত্যুবরণ করেন।
কল্পনা দত্ত
চট্টগ্রামে জন্ম কল্পনাও সে সময় বিপ্লবী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে জড়িয়ে পড়েন। প্রথমে তিনি বেথুন কলেজে ছাত্রী সংঘে যোগ দিয়েছিলেন। পরে মাস্টারদা সূর্য সেনের দলে যোগ দেন। একাধিক বার ব্রিটিশের হাতে ধরা পড়েছিলেন তিনি। চট্টগ্রাম অস্ত্র লুণ্ঠনে মাস্টারদার ফাঁসি হয়েছিল। কল্পনা দত্তের যাবজ্জীবন জেল হয়।
কনকলতা বড়ুয়া
কনকলতা অসমের প্রথম নারী, যিনি পুলিশের গুলিতে মৃত্যুবরণ করে শহিদ হন। অসমের বিভিন্ন থানা থেকে ব্রিটিশদের পতাকা নামিয়ে ভারতের পতাকা উত্তোলনের কর্মসূচি নিয়েছিলেন। ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় নেওয়া এই কর্মসূচতি পালনের সময় পুলিশের গুলিতে মৃত্যু হয় তাঁর।
মাতঙ্গিনী হাজরা
তমলুকের কাছে আলিনান গ্রামে জন্মেছিলেন মাতঙ্গিনী। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামে জড়িয়ে পড়েন তিনি। অসহযোগ আন্দোলনেও যোগ দিয়েছিলেন। লবন আইন অমান্য করে গ্রেফতারও হয়েছিলেন। ছাড়া পেয়ে কংগ্রেসের সদস্যপদ নেন। মেদিনীপুর জেলায় বিভিন্ন কর্মসূচিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতেন তিনি। ১৯৪২ সালে ১৪৪ ধারা অমান্য করে এ রকমই একটি মিছিলে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন তিনি। সে সময় পুলিশের গুলিতে শহিদ হন বাংলার এই অগ্নিকন্যা।
বীণা দাস
কৃষ্ণনগরে ১৯১১ সালে জন্মান বীণা দাস। ১৯২৮ সালে সাইমন কমিশন বয়কটের জন্য বেথুন কলেজের ছাত্রীদের নিয়ে আন্দোলন করেছিলেন। ১৯৩২ সালে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে বাংলার ব্রিটিশ গভর্নর স্ট্যানলি জ্যাকসনকে গুলি করে হত্যার চেষ্টা করেন। কিন্তু জ্যাকসন রক্ষা পেয়ে যান। গ্রেফতারও হয়ে জেলবন্দি থাকতে হয়েছিল তাঁকে।
ডঃ লক্ষ্মী সেহগল
বিশিষ্ট স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ছিলেন তিনি। কিন্তু লোভনীয় কর্মজীবন ছেড়ে যোগ দিয়েছিলেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর গঠন করা আজাদ হিন্দ ফৌজের রানি ঝাঁসি রেজিমেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ইম্ফলে প্রবেশ করতে গিয়ে ব্রিটিশের হাতে গ্রেফতারও হয়েছিলেন তিনি।
এরা ছাড়াও একাধিক মহিলা সে সময় সমাজের প্রতিকূল পরিস্থিতির মোকাবিলা করে ব্রিটিশদের দেশ থেকে তাড়াতে সংকল্পবদ্ধ হয়েছিলেন। এর মধ্যে অনেকের কথা হয়তো ইতিহাসের পাতায় লিখিত হয়নি। কিন্তু যা লিখিত হয়েছে সেই তালিকাও কম কিছু নয়। উপরে উল্লেখিত মহীয়সী নারীরা ছাড়াও সরোজিনী নাইডু, অ্যানি বেসান্ত, ভিকাজি রুস্তম কামা, তারারানি শ্রীবাস্তব, গুলাব কৌর, ভোগেশ্বরী ফুকানানি, অরুণা আসফ আলি, আবাদি বানো বেগম, সুচেতা কৃপালানি, দুর্গাবাই দেশমুখ, মনোরমা বসু, কল্যাণী দাস, লীলা নাগের মতো মহিলারাও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন।