ওয়াশিংটন: গুটিগুটি পায়ে মহাবিশ্বে পা বাড়াচ্ছে ভারত। আর এক মাসের অপেক্ষা। সবকিছু ঠিকঠাক চললে আগামী ১৩ জুলাই চাঁদে পাড়ি দিতে চলেছে ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরো(ISRO)-র মহাকাশযান। তবে মহাকাশ অভিযানের নিয়ম মেনে আরও দুটি বিকল্প দিনও হাতে রাখা হয়েছে। এবারের অভিযানে কোনও ‘অরবিটার’ থাকছে না। অর্থাৎ আগের চন্দ্র অভিযান যেখানে সেই ছয়-সাতের দশকের ‘অ্যাপোলো’ অভিযানের ধাঁচে করা হয়েছিল, এবারে গোটা প্রক্রিয়াটিই তার থেকে ভিন্ন। এর জন্য় নতুনভাবে সমস্ত কিছু ঢেলে সাজাচ্ছে ইসরো।
রাশিয়া, আমেরিকা ও চিনের পর চতুর্থ দেশ হিসাবে মহাকাশে মানুষ পাঠানোর পরীক্ষা করছে ভারত। এই মিশনের নাম দেওয়া হয়েছে গগনায়ন। সেই পরীক্ষার চূড়ান্ত প্রস্তুতিও শুরু করে দিয়েছে ইসরো। জুলাই বা অগস্টেই মহাকাশে পাড়ি দিতে পারে ইসরোর মানবহীন মহাকাশযান। ইতিমধ্যেই তার মহড়াও করছে ইসরো।
জানা গিয়েছে, ইসরোর তরফে তিনধাপে গগনযান প্রকল্প শেষ করার চিন্তা-ভাবনা করা হয়েছে। সেই মতোই খুঁটিনাটি চূড়ান্ত করছে ইসরো। প্রথম ধাপে আগামী জুলাই মাসেই মহাকাশে ইসরোর মানবহীন যান পাঠানো হতে পারে। সেই অভিযানে সাফল্য় মিললে, দ্বিতীয় ধাপে অক্টোবর – নভেম্বর মাস মানবহীন যানে মহাকাশে রোবট পাঠানো হবে। মহাকাশে যাবে ভারতের তৈরি ‘ব্যোম মিত্র’।
ইসরো সূত্রের খবর, ‘ব্যোম মিত্র’ মহাকাশযানে ছোটখাটো পরীক্ষা করবে এবং পৃথিবীতে ইসরোর কমান্ড সেন্টারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার কাজ করবে। এই যন্ত্রমানবী অবশ্য অনড়। চেয়ারে বসে সামনে বা পাশে ঝুঁকে যাবতীয় কাজ করবে সে। কৃত্রিম মেধার ব্য়বহার করেই যাবতীয় কাজ করা হবে। সঙ্গীদের চিনতে পারা থেকে শুরু করে কথোপকথন, যাবতীয় কাজই করতে পারবে এই রোবট।
উল্লেখ্য়, নাসার রোবট-নভশ্চর বা রোবোনট ২০১৫ সালে প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য উদ্ভাবন হিসেবে পুরস্কৃত হয়েছে। গত বছর রাশিয়াও যন্ত্র-নভশ্চরকে মহাকাশে পাঠিয়েছে। এদের কাজ, মূলত নভশ্চরদের সাহায্য করা এবং বিভিন্ন প্রযুক্তিগত মেরামতি। এর বাইরে কখনও মাকড়সা, কখনও গাড়ির আকারে একাধিক রোবট পাঠিয়েছে নাসা। ২০১৩ সালে কিউরিয়োসিটি নামে মঙ্গলগ্রহে পাঠানো গাড়িটিও রোবট ছিল। চন্দ্রযান-২ অভিযানে ভারতের বিক্রম-ও ছিল রোবট। কারণ, বছরের পর বছর কোনও মানুষ তো মহাকাশে থাকতে পারে না! সে ক্ষেত্রে রোবট অনেক বেশি কার্যকর। ভারতের যন্ত্রমানবী অবশ্য সঙ্গী নভশ্চরদের সঙ্গেই ফিরবে পৃথিবীতে।
এরপরে তৃতীয় ধাপেই ইসরোর আসল পরীক্ষা। শেষ ভাগে তিন বা চারজন নভোশ্চরকে নিয়ে ইসরোর মহাকাশ অভিযান করার পরিকল্পনা রয়েছে। ২০২৪ সালের গোড়ার দিকেই এই অভিযানের সম্ভাবনা রয়েছে। ভারতের ‘গগনযান’ অভিযানের জন্য বিমান বাহিনীর চার জন পাইলটকে প্রাথমিক ভাবে বেছে নেওয়া হয়েছে। রুশ মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ‘রসকসমস’-এ তাঁদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। মহাকাশে যাওয়ার জন্য তাঁদের স্পেস স্যুটও তৈরি করাতে দিয়েছে ইসরো।
ইসরোর একটি সূত্র জানাচ্ছে, মহাকাশযান উৎক্ষেপণের চেয়েও নিরাপদে পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনা অনেক বেশি কঠিন। নাসার অভিযাত্রী কল্পনা চাওলার ‘কলম্বিয়া’ মহাকাশযানটি পৃথিবীতে ফেরার পথে ‘হিট শিল্ড’-এ সমস্যা হওয়ায় বায়ুমণ্ডলের সংস্পর্শে আসতেই জ্বলে গিয়েছিল। এ ক্ষেত্রে তাই সব ধরনের সাবধানতা অবলম্বন করেই এগোনো হবে।
২০১৮ সালের ১৫ অগস্ট স্বাধীনতা দিবস পালন কর্মসূচিতে ‘গগনযান-২০২২’ প্রকল্পের ঘোষণা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। এর পর ইসরোর তৎকালীন চেয়ারম্যান কে সিভন জানিয়েছিলেন, ২০২২ সালে শ্রীহরিকোটার উৎক্ষেপণ কেন্দ্র থেকে ওই মহাকাশযান ছাড়া হবে। তাতে থাকবেন তিন জন ভারতীয় মহাকাশচারী। উৎক্ষেপণের ১৬ মিনিটের মাথায় মহাকাশযানটি ভূপৃষ্ঠ থেকে ৩০০-৪০০ কিলোমিটার দূরত্বে পৌঁছে পৃথিবীকে পাক খাওয়া শুরু করবে। সে জন্য ব্যবহার করা হবে ভারতের নিজস্ব জিএসএলভি এম কে-থ্রি রকেট।
পরে, পরিকল্পনায় কিছুটা বদল আনে ইসরো। ঠিক হয়, পৃথিবীকে ঘিরে মহাকাশযানের যে ‘অরবাইটাল মডিউলটি’ পাক খাবে তাতে দু’টি অংশ থাকবে। একটিতে মহাকাশচারীরা থাকবেন। সেটির নাম ‘ক্রু মডিউল’। যা যুক্ত থাকবে ‘সার্ভিস মডিউল’-এর সঙ্গে। ৫-৭ দিন মহাকাশচারীরা মহাকাশে থাকবেন। এর পর আরব সাগরের উপকূলে কোনও জায়গায় তাঁদের ফেরত আনা হবে।
গত বছর গগনযান-এর রকেটের ক্রায়োজেনিক ইঞ্জিনের সফল পরীক্ষা করে ইসরো। ৭২০ সেকেন্ড বা ১২ মিনিটের জন্য। এত বেশি সময় ধরে গগনযান অভিযানের রকেটের ইঞ্জিনের পরীক্ষা ইসরো এর আগে করেনি। ইসরো পরে একটি বিবৃতিতে জানিয়েছে, গগনযান অভিযানের জন্য যে যে লক্ষ্য নিয়ে ক্রায়োজেনিক ইঞ্জিন বানানো হয়েছে এ বারের পরীক্ষায় সেই সবকটি লক্ষ্যেই নিখুঁত ভাবে পৌঁছনো সম্ভব হয়েছে। ইঞ্জিন খুব ভাল কাজ করেছে। পরে আরও তিনবার ইঞ্জিনের পরীক্ষা হয়েছে। সব মিলিয়ে পরীক্ষা করা হয়েছে মোট ১ হাজার ৮১০ সেকেন্ড বা ৩০ মিনিট ১৬ সেকেন্ড ধরে।