কেবল ভাল ভাল অস্ত্রশস্ত্র থাকলেই যুদ্ধ জেতা যায় না। যুদ্ধ জিততে প্রয়োজন উপস্থিত বুদ্ধি, মানসিক দৃঢ়তা, অসীম সাহস। সে প্রমাণ আমরা পেয়েছি মহাভারতে। ধারে ভারে শত গুণ এগিয়ে থাকা কৌরবদের হার মানতে হয়েছিল শ্রীকৃষ্ণের কাছে। সে তো হাজার হাজার বছর আগের কথা। কিন্তু একই ভাবে মাত্র ৫৩ বছর আগে শত্রু পক্ষের ঘাঁটিতে ঢুকে বাজিমাত করে এসেছিল ভারতীয় নৌসেনার জওয়ানরা। কী হয়েছিল সেই দিন?
সেটাও ছিল ডিসেম্বর মাসের এক গভীর রাত। সেই রাতে আরব সাগর দিয়ে উত্তর দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল এক ঝাঁক জাহাজ। ভারতীয় নৌসেনার তিনটি মিসাইল ক্লাস বোট – আইএনএস বীর, আইএনএস নির্ঘাত ও আইএনএস নিপাত। সঙ্গে দুটি অ্যান্টি সাবমেরিন করভেট – কাটচাল ও কিলতান, এবং একটি ফ্লিট ট্যাঙ্কার। ইউনিটের পোশাকি নাম করাচি স্ট্রাইক গ্রুপ। গন্তব্য করাচি বন্দর।
করাচি সেই সময় পাক নৌ- সেনার বৃহত্তম ও সবচেয়ে সুরক্ষিত ঘাঁটি। ভারতীয় নৌসেনার জাহাজে যাঁরা ছিলেন, রেডিও-র মাধ্যমে রুশ ভাষায় কথাবার্তা চালাচ্ছিলেন, যাতে শত্রু পক্ষ বুঝতে না পারে। সেই সময় পুরোদমে ভারত-পাক যুদ্ধ চলছে। করাচি বন্দরকে সুরক্ষিত রাখতে মোতায়েন হয়েছে পিএনএস খাইবার। পাক নৌসেনার অন্যতম সেরা যুদ্ধজাহাজ। এই পিএনএস খাইবার দিয়েই ৬৫-র যুদ্ধে গুজরাত উপকূলে হামলা চালিয়েছিল পাকিস্তান। ১৯৬৭ থেকে তিন বছর ধরে চিনের সাহায্যে পিএনএস খাইবারকে আরও শক্তিশালী করেছে পাক সেনা। পিএনএস খাইবারকে এড়িয়ে করাচি বন্দরের কাছাকাছি যাওয়া বা বন্দরের মুখ বন্ধ করা প্রায় অসম্ভব।
ভারতীয় নৌসেনার কাছে খবর ছিল, করাচি বন্দরের খুব কাছেই পাহারা দিচ্ছে আইএনএস খাইবার। কিন্তু সেই গোয়েন্দা তথ্য ঠিকঠাক ছিল না। করাচি থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে পিএনএস খাইবারকে স্পট করে আইএনএস নির্ঘাত। তারপর কী হয়েছিল?
সেদিন আরব সাগরে যা হয়েছিল, তার কাছে বিগ ব্যাং স্পাই থ্রিলারকেও ম্যাড়ম্যাড়ে লাগবে। আইএনএস নির্ঘাত কী করেছিল? ঘটনার ৫৩ বছর পরও সেই রাতের প্রতিটা মুহূর্ত মনে রেখেছেন অবসরপ্রাপ্ত ভাইস অ্যাডমিরাল জি এম হিরানন্দানি। ওনার কথা শুনলে বোঝ যায়, স্রেফ সাহস আর উপস্থিত বুদ্ধি দিয়ে ধারে-ভারে এগিয়ে থাকা পাক সেনাকে নাস্তানাবুদ করেছিল নৌসেনা। স্মৃতির ঝাঁপি উপুড় করেছেন সনাতন সাহু। নৌসেনার অবসরপ্রাপ্ত সদস্য তিনিও ছিলেন অপারেশন ট্রাইডেন্টের অংশ, অ্যান্টি সাবমেরিন করভেট কিলতানের ফার্স্ট অফিসার। অপারেশন ট্রাইডেন্টের ৫৩ বছর পূর্তিতে উনি কী বলছেন, এক্সক্লুসিভ টিভি৯ বাংলায়।
শত্রুর যুদ্ধজাহাজ সামনে চলে এসেছে বুঝেই আইএনএস নির্ঘাতকে রুট বদলে খাইবারের উপর হামলার নির্দেশ দেন স্কোয়াডেন লিডার বব্রু যাদব। কিন্তু সেটা সব অর্থেই ছিল একটা দুঃসাহসিক কাজ। শক্রর ডেপথ চার্জে আইএনএস নির্ঘাত ডুবে গেলে বাকিগুলিরও একই পরিণতি হতো। সনাতন বলছেন, রাত ১১টা ১৫ নাগাদ পিএনএস খাইবারের উপর হামলা শুরু হয়। ২৫ মিনিট ধরে একের পর এক ক্ষেপণাস্ত্র ছোঁড়া হচ্ছিল। ২৫ মিনিট পর ক্ষেপণাস্ত্র দাগা বন্ধ করার নির্দেশ দেন স্কোয়াডেন কমান্ড্যার বব্রু ভান যাদব। তারপর প্রায় ৩০ ঘণ্টার রুদ্ধশ্বাস মূহুর্ত। প্রায় ৩০ ঘণ্টা পর স্কোয়াডেন কম্যান্ডার যাদব বুঝে যান, পিএনএস খাইবারের সলিলসমাধি হয়েছে। উনি কি ঠিক বুঝেছিলেন? হ্যাঁ, প্রায় ২০০ সেনাকে নিয়ে ডুবে গিয়েছিল পিএনএস খাইবার। একটি মিসাইল ক্লাস বোট আস্ত একটা যুদ্ধজাহাজকে ডুবিয়ে দিচ্ছে, এমন ঘটনা যুদ্ধের ইতিহাসে বিরল।
তবে বিপদ, চ্যালেঞ্জ তখনও শেষ হয়নি। ওই জলসীমায় মোতায়েন ছিল আরও ৩টি যুদ্ধজাহাজ। সেগুলোও স্পট করে ধ্বংস করতে অপারেশনে নামে আইএনএস বীর ও আইএনএস নিপাত। অস্ত্রভর্তি একটি ট্রান্সপোর্ট জাহাজ তখন করাচি বন্দরের দিকে যাচ্ছিল। তাকেও স্পট করে চ্যালেঞ্জ করে আইএনএস নিপাত। ভারতীয় মিসাইলের আঘাতে সেও টিকে থাকতে পারেনি। করাচি বন্দরে ঢোকার মুখে নজরদার জাহাজ পিএনএস মুতার্জাকে ধ্বংস করে দেয় আইএনএস বীর। করাচিতে পাকিস্তানের নৌ-শক্তি বলতে আর কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। বিনা বাধায় করাচি বন্দরে ঢুকে পড়েন ভারতের নৌসেনা।
অপারেশন ট্রাইডান্টের অন্যতম সদস্য সনাতন বলছেন, আমরা করাচি বন্দরের অনেকটা ভিতরে ঢুকে অপেক্ষা করছিলাম। তবে করাচির ভিতরে হামলার কোনও নির্দেশ আমাদের দেওয়া হয়নি। সেটা হলে করাচির মাথা তুলে দাঁড়াতে বহু বছর লাগত। আমরা শুধু তেলের ভাণ্ডার ও অস্ত্রাগারগুলো ধ্বংস করেই থেমে গিয়েছিলাম। করাচি বন্দর আগুন ধরে গিয়েছিল, সেটা করাচির শহরের বড় অংশেও ছড়িয়ে পড়েছিল। পূর্ব পাকিস্তানে পাক সেনার কাছে অস্ত্র ও রসদ পাঠানোর রাস্তাও বন্ধ করে দিয়েছিলাম।
আচ্ছা, অপারেশন ট্রাইডেন্টই কী সবচেয়ে কম সময়ে হওয়া সবচেয়ে সফল নাভাল অপারেশন? হয়তো তাই। অনেক খুঁজেও তো অপারেশন ট্রাইডেন্টের মতো আরও একটা নাভাল অপারেশনের খোঁজ পাওয়া যায় না। আগামী ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের আরও একটা বর্ষপূর্তি। হঠাৎ করে এই অপারেশনের স্মৃতিচারণের একটাই কারণ, তা হল বাংলাদেশ। বাংলাদেশের মানুষকে মনে করিয়ে দেওয়া ৭১-এর সেই অস্থির সময়ের কথা। কঠিন সময়ে তাঁদের পাশে থাকতে পরোয়া করেনি ভারত। তবে ভারতের বিপক্ষে গিয়ে ভারত দখলের কথা ভাবলেও তাঁর কী পরিণতি হতে পারে সেটাই বুঝিয়ে দেওয়া।