দেশে বামপন্থী রাজনীতির পরিসরটা যে ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে, তার আরেকটি জলজ্যান্ত উদাহরণ দেখা গেল মঙ্গলবার বিকেলে। সিপিআই ছেড়ে কংগ্রেসকে আপন করে নিলেন গত ৬-৭ বছর ধরে জাতীয় রাজনীতিতে বামপন্থার ‘পোস্টার বয়’ কানহাইয়া কুমার (Kanhaiya Kumar)। যাঁকে দেখে, বা যাঁর ভাষণ ইউটিউবে শুনে নতুন প্রজন্মের হাজার হাজার যুবক-যুবতীদের বাম রাজনীতিতে আকৃষ্ট হওয়া, সেই মানুষটিই আর বামপন্থায় আস্থা রাখতে পারলেন না। কেন? কী কারণে তাঁর মঞ্চ বদল? এসব প্রশ্ন উঠতে সবে শুরু করেছে, ভবিষ্যতেও উঠবে। আপাতত সে সব প্রশ্ন দূরে সরিয়ে রেখে ব্যক্তি কানহাইয়ার এই উত্থান নিয়ে কথা বলা যাক।
বিহারের এক অজপাড়া গাঁয়ের দরিদ্র পরিবারের সন্তান, ২০১১ সালে দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পান পিএইচডি করার। ছোটবেলা থেকেই মেধাবী কানহাইয়ার ছাত্র রাজনীতিতে হাতেখড়ি অবশ্য এর আগেই হয়ে যায়। পটনার কমার্স কলেজে স্নাতক পড়ার সময় থেকেই বামপন্থী রাজনীতিতে ঝোঁক ছিল। তাই যোগ দেন অল ইন্ডিয়া স্টুডেন্ট ফেডারেশন (এআইএসএফ)-এ। সেখান থেকেই ছাত্র রাজনীতি শুরু করেন। তবে জেএনইউ তাঁকে জাতীয় রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক করে তোলে। ২০১৯ সালে জেএনইউ থেকে পিইএচডি শেষ করেন কানহাইয়া কিন্তু ততদিনে গোটা দেশ চিনে ফেলেছে বিহারের এই তরুণকে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেওয়া বছর চারেকের মধ্যেই শিরোনামে উঠে আসেন কানহাইয়া। এআইএসএফ-এর প্রতিনিধিত্ব করেই জেএনইউ ছাত্র সংসদের সভাপতি নির্বাচিত হন তিনি। সেই সঙ্গে তাঁর পিছু নেয় একের পর এক বিতর্ক। ২০১৬ সালে এক সাক্ষাৎকারে কানহাইয়া জানান, স্বাধীনতা সংগ্রামী ভগৎ সিংকে দেখেই তিনি রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। এ বাদেও বিআর আম্বেদকর, মহাত্মা গান্ধী ও কার্ল মার্ক্সের মতো ব্যক্তিত্ব তাঁকে রাজনীতির প্রতি আগ্রহী করে তুলেছিল।
সালটা ২০১৬। সংসদের জঙ্গি হামলার মূলচক্রী আফজল গুরুকে ফাঁসি দেওয়ার দ্বিতীয় মৃত্যু বার্ষিকী ছিল সেদিন। এই বিক্ষোভ আন্দোলন চলাকালীন দেশবিরোধী শ্লোগান তোলার অভিযোগে জেএনইউ-র তৎকালীন ছাত্র সংসদের সভাপতিকে গ্রেফতার করে দিল্লি পুলিশ। বেশ কয়েকদিন পুলিশি হেফাজতে কাটাতে হয় তাঁকে। কানহাইয়া অবশ্য আজও সেই ধরনের কোনও শ্লোগান তোলার কথা অস্বীকার করেন। বলাই বাহুল্য, এখনও কানহাইয়ার বিরুদ্ধে দেশবিরোধী শ্লোগান তোলার অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি পুলিশ। আদালতও জানায়, কানহাইয়ার বিরুদ্ধে দেশবিরোধী শ্লোগান দেওয়ার কোনও প্রমাণ মেলেনি।
দেশজুড়ে ক্রমশ নিজেকে কেন্দ্রীয় সরকার, তথা নরেন্দ্র মোদীর বিরোধিতার অন্যতম যুবা মুখ করে তোলেন কানহাইয়া। তাঁর একের পর এক বক্তব্যের ভিডিয়ো সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া শুরু হয়। সেই সঙ্গে বিতর্কও সঙ্গ নিতে থাকে তাঁর। দেশবিরোধী শ্লোগান তোলার মামলায় জামিন পাওয়ার দিনকয়েক পরেই একটি অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে তিনি কাশ্মীরি মহিলাদের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ তোলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে। ফের অভিযোগ দায়ের হয় তাঁর বিরুদ্ধে। এ বাদেও ২০১৫ সালে এক মহিলা ছাত্রীর বিরুদ্ধে দুর্ব্যবহার করার অভিযোগ ওঠে কানহাইয়ার বিরুদ্ধে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে গোটা দেশ জুড়ে ক্রমশ জনপ্রিয়তাও বাড়তে থাকে এই ছাত্রনেতার।
২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনে প্রথমবার নিজের ভাগ্য পরীক্ষায় নেমেছিলেন কানহাইয়া। নিজের চেনা জায়গা বিহারের বেগুসরাই কেন্দ্র থেকেই নির্বাচনে লড়েন তিনি। কিন্তু হেরে যান বিজেপির প্রার্থী তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী গিরিরাজ সিংয়ের কাছে। তার পর থেকেই ক্রমশ নিজেকে নিজেকে গুটিয়ে নিতে শুরু করেন কানহাইয়া। ২০১৯ সালের আগেও মোদী সরকারের বিরুদ্ধে তাঁকে যে ধারালো আক্রমণ করতে শোনা যেত সেই, ধার কিছুটা হলেও কমে যায়। সোশ্যাল মিডিয়াতেও তাঁর ভিডিয়োর সংখ্যা কমে যেতে থাকল। তারপর চলে এল অতিমারি। কোথায় যেন হারিয়েই গেলেন কানহাইয়া।
আরও পড়ুন: Dipsita Dhar on Kanhaiya Kumar: ‘কানহাইয়া পারলেন না’, একদা সতীর্থ ‘হাত’ ধরায় খেদ দীপ্সিতার
রাজনীতিতে যখন থেকে তাঁর ধ্যান-জ্ঞান, তখন থেকেই লাল ঝান্ডা, লাল টি-শার্ট, সব ক্ষেত্রেই লাল রং প্রিয় থেকেছে কানহাইয়ার। রাজনীতির নতুন ইনিংস শুরু করার সময়ও সেই লাল কুর্তা গায়েই দেখা গেল তাঁর গায়ে। রাহুল গান্ধীর থেকে পার্টির সদস্যতা নিলেন। সাংবাদিক বৈঠক করে একের পর এক প্রশ্নের উত্তরও দিলেন। কিন্তু লক্ষ্যণীয়ভাবে, এ দিনও কানহাইয়ার গায়ে দেখা মিলল সেই লাল রঙের কুর্তা। যা দেখে অনেক সাংবাদিকই মজাচ্ছলে বলে উঠলেন, কানহাইয়া লাল ছাড়লেও, লাল বোধহয় কানহাইয়াকে ছাড়তে পারল না।
আরও পড়ুন: Kanhaiya Kumar Joins Congress: রাহুলের ‘হাত’ ধরে কংগ্রেসে যোগ দিলেন কানহাইয়া-জিগনেশ