নয়া দিল্লি: জাতীয় পতাকা, জাতীয় প্রতীক এবং জাতীয় সঙ্গীত – এই তিনটি বিষয় যে কোনও দেশেরই প্রধান পরিচয়। ভারতের কথা ভাবলেই যেমন প্রথমেই মাথায় আসে জাতীয় প্রতীক অশোক স্তম্ভ, জাতীয় সঙ্গীত ‘জনগণমন অধিনায়ক জয় হে’ এবং অবশ্যই তেরঙ্গা জাতীয় পতাকার কথা মাথায় আসে। কিন্তু, জানা আছে কি এই তেরঙ্গা জাতীয় পতাকার নকশা করেছিলেন কে? নেপথ্যের মানুষটি হলেন পিঙ্গালি বেঙ্কাইয়া। মঙ্গলবার (২ অগস্ট) তাঁর ১৪৬তম জন্মবার্ষিকী। কেন্দ্রীয় সংস্কৃতি মন্ত্রকের পক্ষ থেকে এই উপলক্ষে ‘তিরঙ্গা উত্সব’ নামে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের উপস্থিতিতে এই স্বাধীনতা সংগ্রামীর সম্মানে একটি স্মারক ডাকটিকিটও প্রকাশ করা হয়েছে।
টুইট করে পিঙ্গালি বেঙ্কাইয়াকে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও। তিনি লিখেছেন, “তাঁর জন্মবার্ষিকীতে আমি মহান পিঙ্গালি বেঙ্কাইয়াকে শ্রদ্ধা জানাই। আমাদের গর্বের তেরঙ্গা জাতীয় পতাকা দেওয়ার প্রচেষ্টার জন্য আমাদের দেশ তাঁর কাছে চিরকাল ঋণী থাকবে। কামনা করি যেন তেরঙ্গা থেকে শক্তি এবং অনুপ্রেরণা গ্রহণ করে আমরা জাতীয় উন্নতির জন্য কাজ করতে থাকি।”
১৮৭৬ সালে ব্রিটিশ ভারতের মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির ভাটলাপেনুমারুতে (আজকের অন্ধ্র প্রদেশের মছিলিপত্তনম) একটি তেলেগু ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন পিঙ্গালি বেঙ্কাইয়া। উচ্চশিক্ষার জন্য কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলেন তিনি। পরে ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকায় চলে গিয়েছিলেন। শোনা যায়, সৈনিক হিসেবে ব্রিটিশদের জাতীয় পতাকাকে স্যালুট করতে গিয়েই তাঁর মনে প্রথম স্বাধীন ভারতের একটি জাতীয় পতাকা নকশা করা ভাবনা এসেছিল। আর সৈনিক হিসেবে দক্ষিণ আফ্রিকাতে গিয়েই তাঁর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাত হয়েছিল মহাত্মা গান্ধীর। অল্প সময়ের মধ্যেই বেড়ে উঠেছিল ঘনিষ্ঠতা। ভারতে ফিরে তিনি দেশের জাতীয় পতাকা তৈরিতে নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন। বিভিন্ন দেশের জাতীয় পতাকা নিয়ে রীতিমতো গবেষণা শুরু করেন।
১৯১৯ থেকে ১৯২১ সাল পর্যন্ত, কংগ্রেস অধিবেশন চলাকালীন ভারতের জাতীয় পতাকা গ্রহণের জন্য চাপ দিয়েছিলেন বেঙ্কাইয়া। শেষ পর্যন্ত বেঙ্কাইয়ার নকশাটি ১৯২১ সালের বিজয়ওয়াড়া কংগ্রেসে অনুমোদন দিয়েছিলেন মহাত্মা গান্ধী। ভারতের প্রাথমিক পতাকাটি পরিচিত ছিল ‘স্বরাজ পতাকা’ নামে। লাল এবং সবুজ দুটি পট্টি দিয়ে নকশা করা হয়েছিল পতাকাটি। লাল ও সবুজ রঙ ছিল দেশের দুটি প্রধান ধর্মীয় সম্প্রদায় – হিন্দু এবং মুসলিমের প্রতিনিধিত্বকারী। তার উপরে ছিল একটি চরকার ছবি, যা ছিল স্বরাজের ধারণার প্রতিনিধিত্বকারী। পরে মহাত্মা গান্ধীর পরামর্শে বেঙ্কাইয়া পতাকাটির উপরের অংশে একটি সাদা পট্টি যুক্ত করেছিলেন। যা ছিল শান্তির প্রতিনিধিত্বকারী। পতাকাটি সর্বভারতীয় কংগ্রেস কমিটিতে আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত না হলেও, এটি কংগ্রেসের সমস্ত অনুষ্ঠানে তোলা শুরু হয়েছিল।
তবে, ১৯৩১ সালে পতাকায় ধর্মীয় রং ব্যবহার নিয়ে অনেকেই উদ্বেগ প্রকাশ শুরু করেছিলেন। সেই উদ্বেগকে সম্মান করে একটি পতাকা কমিটি গঠন করা হয়েছিল। তারা একটি নতুন পতাকার ধারণা এনেছিল, যার নাম ‘পূর্ণ স্বরাজ’। লালের বদলে ব্যবহার করা হয় গেরুয়া রঙ। বদল করা হয়েছিল রঙের ক্রমও। গেরুয়া রঙ উপরে দিয়ে সাদাকে আনা হয়েছিলয় মাঝে, তারপরে সবুজ। মাঝে থাকা সাদা রঙের পট্টির উপর ছিল চরকার ছবি। প্রতিটি রঙ সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করার বদলে বিভিন্ন গুণাবলীর প্রতিনিধিত্বকারী হয়েছিল। সাহস ও ত্যাগের প্রতীক গেরুয়া, সত্য ও শান্তির প্রতীর সাদা এবং বিশ্বাস ও শক্তির প্রতীক সবুজ। চরকা ছিল জনকল্যাণের চিহ্ন। স্বাধীনতার পর ফের একবার বদল হয় ভারতের জাতীয় পতাকার। রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদের অধীনে একটি জাতীয় পতাকা কমিটি চরকার বদলে সাদা রঙের উপর অশোক চক্র ব্যবহার করার সুপারিশ করেছিল।
শেষ জীবনে অবশ্য চরম দারিদ্রের মধ্যে কাটাতে হয়েছিল জাতীয় পতাকার নকশাকারকে। ১৯৬৩ সালের ৪ জুলাই চূড়ান্ত অবহেলার মধ্যে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন এই স্বাধীনতা সংগ্রামী। ২০০৯ সালে তাঁর নামে একটি ডাকটিকিট প্রকাশ করা হয়েছিল। ২০১৫ সালে বিজয়ওয়ারার অল ইন্ডিয়া রেডিয়ো ভবনটির নাম বেঙ্কাইয়ার নামে রেখেছিল মোদী সরকার। রেডিয়ো ভবনের চত্বরে তাঁর একটি মূর্তিও স্থাপন করা হয়েছিল।