প্রয়াগরাজ: কেন বারবার সবাই কুম্ভমেলায় ছুটে যায়? এর উত্তর একটাই, কুম্ভমেলার আকর্ষণ। এত বড় ধর্মীয় সমাগম আর কোথাও দেখা যায় না। এই কুম্ভ মেলায় যেমন দেশ-বিদেশের মানুষের সমাগম হয়, তেমনই দেখা মেলে নাগা সন্ন্যাসী, অঘোরীদের। যাঁরা একসময় দিল্লি শাসন করেছে, ঔরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে, নিজস্ব ব্যাঙ্ক, কো-অপারেটিভ, ফুড ডেলিভারি সিস্টেম গড়ে তুলেছে, সেনাবাহিনী তৈরি করেছে – তাদের সম্পর্কে অনেক জেনেও, অজানা রয়ে গিয়েছে অনেক কিছুই। কয়েকশো বছর ধরে আলাদা একটা দুনিয়া তৈরি করেছেন এই নাগা সন্ন্যাসীরা।
নাগা সন্ন্যাসী বলতে আমরা যাদের দেখি, সেটাই সব নয়। অনেকেরই ধারণা, সারাক্ষণ নগ্ন থাকেন নাগা সাধুরা। এটা কিন্তু ঠিক নয়, সাধনার সময়টুকু ছাড়া বাকি সময়ে তাঁরা গেরুয়া বসন পরেই থাকেন। যুদ্ধ- বিদ্রোহ, ইংরেজ খেদানো, মুঘলদের প্রতিরোধ, সোশাল ওয়েলফেয়ার – নাগাদের ইতিহাসে অনেক, অনেক চমক রয়েছে।
নাগা সন্ন্যাসীদের প্রধান গুরু আদি শঙ্করাচার্য। যদুনাথ সরকার লিখেছেন, সপ্তম ও অষ্টম শতাব্দীতে শঙ্করাচার্যই মূলত হিন্দু সন্ন্যাসীদের সংঘবদ্ধ করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। শঙ্করাচার্যের দেখানো পথেই তাঁদের বাড়বাড়ন্ত। এদের মধ্যে মূলত দুটো ভাগ- শাস্ত্রধারী ও অস্ত্রধারী। ভারতে সুলতানি যুগ শুরুর পর নানা ভাবে নাগা সন্ন্যাসীদের হামলার মুখে পড়তে হচ্ছিল। সেখান থেকেই দুটো আলাদা গোষ্ঠীর ভাবনা। একটা গোষ্ঠী শাস্ত্রচর্চা ও সাধনা করবে। অন্য গোষ্ঠী সাধনার পাশাপাশি সশস্ত্র প্রশিক্ষণও নেবে – এটাই ছিল পরিকল্পনা।
ঔরঙ্গজেব যখন দ্বিতীয়বার বারাণসী আক্রমণ করলেন, তখন নাগা সন্ন্যাসীরা মরণপন লড়াই করেছিলেন মুঘল সেনার বিরুদ্ধে। মুঘল ঐতিহাসিকদের বইতেও সেই যুদ্ধের কথা রয়েছে। যুদ্ধে সন্ন্যাসীদের হারে হারতে হয়েছিল মুঘল সেনাকে। সাম্প্রতিক কালে তার প্রমাণও মিলেছে। ঐতিহাসিকরা বলছেন, মুঘল আমলের শুরু থেকেই নাগা সন্ন্যাসীরা নিজেদের মতো করে সমান্তরাল একটা সিস্টেম তৈরি করতে শুরু করেন। সৈন্যদল, সেনাঘাঁটি তৈরি করা – প্রশিক্ষিত সাধুদের অস্ত্র কিনতে টাকা দেওয়া শুরু হয়।
পুরনো বইপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, শাহজাহানের সময় নাগা সন্ন্যাসীরা নিজেদের হেড-কোয়ার্টার তৈরি করে ফেলেছিল। সেখান থেকে দেশে ছড়িয়ে থাকা কয়েক হাজার শাখা, আশ্রম পরিচালনা করা হয়েছিল। ব্রিটিশ ঐতিহাসিক জেমস আর লচেটফিল্ড লিখেছেন, নাগা সন্ন্যাসীদের একটি অংশ পায়ে হেঁটে ঘুরে বেড়ায়। আর একটা অংশ আশ্রমে থাকে। যে যাই করুক, সবাইকে একটা নির্দিষ্ট টাকা আখড়ায় জমা করতে হয়। এভাবেই ফুলেফেঁপে উঠেছিল নাগা সন্ন্যাসীদের তহবিল।
যদুনাথ সরকার বলেছেন, শাজাহানের সময় থেকেই কুম্ভমেলার নিয়ন্ত্রণ নাগা সন্ন্যাসীদের হাতে চলে যায়। ওই মেলা থেকেও বিপুল আয় করতেন তাঁরা। সেই টাকার ভাগ নিয়ে নিজেদের মধ্যে ঝগড়া- মারামারি ছোটখাটো যুদ্ধও হয়েছে। ব্রিটিশ ভারতে এলাহাবাদের রাজস্ব বিভাগের প্রধান ছিলেন মরিস উইলকিনসন। তিনি নিজের বইয়ে লিখেছেন, “কুম্ভমেলার টাকা-পয়সা নিয়ে নাগা-সন্ন্যাসীরা জোর লড়াই লেগেছে। তরোয়াল হাতে মারামারি- কাটাকাটি। রক্তারক্তি কান্ড। বাধ্য হয়ে রায়ট পুলিশ নামানোর নির্দেশ দিয়েছি”।
টাকা-পয়সার ঝামেলা মেটাতে স্পেশাল অফিসার নিয়োগ করতে হয় ব্রিটিশ সরকারকে। ঠিক হয়, স্বশাসিত আর্থিক প্রতিষ্ঠানে কুম্ভমেলা থেকে প্রাপ্ত টাকাপয়সা জমা পড়বে। এবং তা সবকটি আখাড়ার মধ্যে ভাগ-বণ্টন হবে। ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর নাগা সন্ন্যাসীদের সুবর্ণযুগ শুরু বলা যেতে পারে। কেন? কেননা তখন মুঘল সাম্রাজ্যের বেহাল অবস্থা। ছোট – বড় জমিদার – ধনী ব্যবসায়ীরা বুঝলেন, দিল্লির ভরসায় থাকা যাবে না। প্রাইভেট আর্মির প্রয়োজন। কাদের নিয়ে প্রাইভেট আর্মি তৈরি হবে? কেন? নাগা সাধুদের নিয়ে। সিপাহি বিদ্রোহীদের পর গোটা দেশে কয়েক হাজার প্রাইভেট আর্মি তৈরি হয়েছিল। সংখ্যার দিক থেকে এসব প্রাইভেট আর্মিতে প্রথম স্থানে ছিলেন মারাঠারা, দ্বিতীয় স্থানে নাগারা। ১৮৮০ সালে লখনউ প্রভিন্সে যে বিদ্রোহ ও সংঘর্ষ হয়েছিল, সেটা ছিল ব্রিটিশ বনাম নাগাদের লড়াই। এরপর থেকে নাগা সন্ন্যাসীদের আর ঘাঁটানোর সাহস পায়নি সাহেবসুবোরা। নাগা সন্ন্যাসীরা কয়েকশো বছর ধরে আমাদের আশেপাশে রয়েছেন। খালি কুম্ভের মেলায় তাঁদের উপস্থিতি আলাদা করে চোখে পড়ে – এই যা।