জ্যোতির্ময় রায়: গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে করোনা আক্রান্ত হয়েছেন ৪ লক্ষ ১ হাজার ৯৯৩ জন। যা, এখনও অবধি একদিনে সর্বোচ্চ আক্রান্তের সংখ্যা। একদিনেই মৃত্যু হয়েছে ৩৫২৩ জনের। এই প্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক জানিয়ে দিল, এবার ঘরের ভিতরেও মাস্ক পরার সময় এসেছে। এই বিবৃতি একদিকে যেমন তাৎপর্যপূর্ণ তেমনি চিন্তাজনকও বটে।
করোনা সংক্রমণের ক্ষেত্রে পরবর্তী ১২০ ঘন্টা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। চার থেকে পাঁচ দিনের মধ্যে করোনা সংক্রমণের ক্ষেত্রে যদি হালকাভাবে নিয়ন্ত্রণ না হয়, তবে পরিস্থিতি অতি খারাপ হতে পারে। এমনটাই আশঙ্কা। জানা যাচ্ছে, দেশে দীর্ঘমেয়াদী লকডাউনের সিদ্ধান্ত নির্ভর করবে এই ১২০ ঘণ্টার উপর। আর যদি আশঙ্কা সত্যি করে সংক্রমণ বেড়ে যায় তবে স্বাস্থ্য বিভাগের প্রাথমিক কাঠামো আপডেট করার আর কোনও সুযোগ থাকবে না। বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশের স্বাস্থ্য বিভাগের ওপর এত চাপ রয়েছে যে করোনা সংক্রমণে দ্রুত হারের কারণে চিকিৎসা পরিকাঠামো ধ্বসে পড়তে পারে। কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারগুলি এ বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
উদ্বেগের ১২০ ঘণ্টা:
ভারতে করোনার সংক্রমণ সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছেছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন যে, পরবর্তী ১২০ ঘন্টা করোনার সংক্রমণের ভাইরাসের জন্য অতিব গুরুত্বপূর্ণ। সম্ভবত করোনার শিখর ৪-৫ মে এর মধ্যে শিখরে পৌঁছতে পারে। কারণ, এখন একদিনেই চার লক্ষেরও বেশি সংক্রমণ হার সামনে আসতে শুরু করেছে। এই আকস্মিক বৃদ্ধি সরকারের সমস্ত কৌশলবিদকে বিস্মিত করে দিয়েছে। যেহেতু করোনার ভাইরাস এখন বাতাসে ছড়িয়ে আছে, তাই সংক্রামিত মানুষের সঠিক সংখ্যা অনুমান করাও সম্ভব নয়।
সংক্রমণের বিস্ফোরণ যদি এমন লাগামছাড়া হয়, তবে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা আজ যেখানে দাঁড়িয়ে আছে, সেটি ধ্বসে পড়তে পারে তাসের ঘরের মতো। আশঙ্কা এমনই। এই কারণে সরকার বিদেশ থেকে এখন অক্সিজেন, রেমিডিসিভির ইঞ্জেকশন এবং অন্যান্য ওষুধ সরবরাহ করছে। সরকারের তৈরি বৈজ্ঞানিক গোষ্ঠীর প্রধান এম বিদ্যাসাগর সংমাধ্যমকে জানিয়েছেন, আগামী সপ্তাহের মধ্যেই দেশজুড়ে করোনার সংক্রমণের নতুন সংখ্যা রেকর্ড ভেঙে দিতে পারে।
এইমসের প্রধান ডঃ রণদীপ গুলেরিয়া বলেছেন, করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে সংক্রমণের মামলা খুব দ্রুত বেড়ে চলেছে। এই কারণে স্বাস্থ্যসেবার উপর চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। যদি সংক্রমণ সংখ্যা দুই থেকে তিন সপ্তাহের ব্যবধানে বৃদ্ধি হত, তবে ঠেকানোর সময় থাকত। দেশে করোনার প্রথম তরঙ্গে সেটাই ঘটেছিল। করোনা সংক্রমণ ধীরে ধীরে অগ্রসর হওয়ায় স্বাস্থ্য ব্যবস্থা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হলেও খুব একটা অসুবিধা হয়নি। কিন্তু করোনার গতি যদি এভাবে বাড়তে থাকে তবে দুই সপ্তাহের মধ্যে চিকিৎসার জন্য শয্যার অভাব দেখা দিতে পারে!
আসলে করোনার প্রথম ঢেউয়ের পর মাঝখানে একটি বিরতি ছিল। তখন সাধারণ মানুষ এবং স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে যুক্ত সংস্থাগুলিও ভেবেছিল যে এখন করোনা চলে গিয়েছে। হাসপাতালে সাধারণ ওপিডি আবার স্বাভাবিক হতে শুরু করে। যেসব কোভিড কেয়ার সেন্টারগুলি তৈরি করা হয়েছিল, সেগুলি সাধারণ ব্যবস্থার অংশে পরিণত হয়। ফলস্বরূপ, এখন দ্বিতীয় তরঙ্গে এই সংস্থানগুলির বিশাল অভাব দেখা দিয়েছে। চিকিৎসা সরঞ্জাম থেকে ওষুধ সবকিছুরই ঘাটতি রয়েছে।
ডাঃ গুলেরিয়া বলেন, লকডাউন করে পরিস্থিতি পুনরুদ্ধার করা সম্ভব, তবে এই কৌশল সব সময় ব্যবহার করা যায় না। কোটি কোটি মানুষের জীবিকা দেখতে হবে। সংশ্লিষ্ট অঞ্চলকে একটি কনটেইনমেন্ট জোন হিসাবে ঘোষণা করার চেষ্টা করতে হবে। যেখানে কোভিড পজিটিভের হার ১০ শতাংশের বেশি এবং যেখানে ৬০ শতাংশ বিছানা পূর্ণ হয়েছে, তাৎক্ষণিকভাবে সেখানে অক্সিজেন বিছানার সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে। এই সব এলাকায় সংক্রমণের উত্তরণের শৃঙ্খল ভেঙে (Break the Chain) দিতে হবে। লকডাউন মানে একটি কঠোর বাধা, কঠোর বিধিনিষেধ। মানুষ বুদ্ধিমানের মতো কাজ করলে এই বিপদ এড়ানো যেতে পারে।
যেখানে সংক্রমণ কম, সেখানেও মানুষকে নিজেদের মধ্যে দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। সামাজিক মেলামেশা বন্ধ করতে হবে। আর লকডাউন সেখানেই করতে হবে যেখানে সংক্রমণ বেশি। প্রাথমিকভাবে, দুই সপ্তাহের লকডাউন ঠিক বলে মনে করছেন গুলেরিয়া। স্বাস্থ্যসেবা সেই সময়ের মধ্যে আপডেট করা যেতে পারে বলে মনে করছেন তাঁরা। তাছাড়া নাইট কারফিউ বা উইকএন্ড লকডাউন কোনও কাজের হবে না মনে করছেন। কেন? তাঁদের ব্যাখ্যা, এক দিনে যে শৃঙ্খল ভাঙার কাজ অর্জিত হয়, কারফিউ খোলার সঙ্গে সঙ্গে সব নষ্ট হয়ে যায়। এখন আমাদের ইতিবাচক হার হ্রাস করতে হবে। যাতে স্বাস্থ্য কাঠামোর উন্নয়ন করার সময় পাওয়া যায়।
কেমন হওয়া উচিত লকডাউন?
লকডাউন এমনভাবে হওয়া উচিত যাতে নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজের কাঠামোর উপর প্রভাব ফেলতে না পারে। ক্রমবর্ধমান সংক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে এক-দু’বার লকডাউনে কাজ হয় না। তাই লকডাউন কয়েকবার বাড়াতে হয়। স্বাস্থ্য বিভাগের জারি করা নির্দেশিকাকে কঠোরভাবে অনুসরণ করা দরকার। ডাঃ রণদীপ গুলেরিয়া বলেছেন, করোনার সংক্রমণ এখন অনেক জায়গায় বাতাসে ছড়িয়ে পড়েছে। অর্থাৎ গোষ্ঠী সংক্রমণের বাইরে চলে গিয়েছে। আপনি করোনায় আক্রান্ত, অথচ আপনি তা বুঝতেই পারছেন না। কুড়ি শতাংশ মানুষ জানেনই না যে, তারা করোনা পজিটিভ। তারা ভাবেন যে আমরা বাড়িতে নিরাপদ। এটাও ঠিক নয়।
আরও পড়ুন: রাজ্যগুলির জন্য রেমডেসিভির বরাদ্দ কেন্দ্রের, বাংলার ভাগে ৯৪ হাজার, উত্তর প্রদেশ পেল ৩ লক্ষ
তাঁর ব্যাখ্যা, “আপনি কোথাও বাইরে যাননি। এদিকে আপনার বাড়িতে হয়ত একজন মেকানিক এসেছেন। হতে পারে যে তিনিই করোনায় আক্রান্ত। তিনি যদি হাঁচেন সেটাও আপনার পক্ষে খারাপ হতে পারে। ভাইরাস কণা বেশ কয়েক ঘন্টা সেখানে উপস্থিত থাকে। তাই বাড়িতেও মুখে মাস্ক পরার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।” তিনি আরও যোগ করেন, “পরিবারের কেউ কারোনার পজিটিভ, এদিকে হয়ত তাঁর কোনও লক্ষণ নেই। অন্য সদস্যরা যদি এক সঙ্গে থাকেন তবে তাদের সংক্রামিত হওয়ার ঝুঁকি প্রবল।”