কমলেশ চৌধুরী: মগনলাল মেঘরাজকে ধরতে নামানো হয়েছিল ‘ফেলুদা’কে। ধরাও পড়ছিল চটজলদি। খরচ-খরচাও বেশ কম। কিন্তু বাস্তবের মগনলাল আরও বেশি ঘোরেল। দুশ্চিন্তা বাড়িয়ে চলেছে বারবার ভেক বদলে। এ বার তাই আসরে স্বয়ং ফেলুদার স্রষ্টা ‘রে’!
এই মগনলাল আসলে করোনাভাইরাস। মিউটেশনকে হাতিয়ার করে নিজেকে টিকিয়ে রাখার জোর চেষ্টা চালাচ্ছে গত সওয়া এক বছর ধরে। একইসঙ্গে হৃদকম্প বাড়িয়ে চলেছে গোটা দুনিয়ার। সম্প্রতি ব্রিটেন, ব্রাজিল এবং দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে তিনটি অতি সংক্রামক স্ট্রেনের খবর পাওয়া যায়। বিলিতি স্ট্রেনের খোঁজ মিলেছে ভারতেও। কিন্তু কোনও করোনা রোগীর শরীরে নতুন স্ট্রেনের একটিও আছে কি না, জানতে একমাত্র ভরসা জিনোম সিকোয়েন্সিং। খরচ সাপেক্ষ। সময় সাপেক্ষ। এরই সমাধান করতে আসরে ‘রে’। নেপথ্যে, দুই বাঙালি বিজ্ঞানী– দেবজ্যোতি চক্রবর্তী এবং সৌভিক মাইতি।
জিন এডিটিংয়ের ক্রিসপার ক্যাস৯ পদ্ধতি ব্যবহার করে তাঁরা তৈরি করেছেন এমন এক পেপার স্ট্রিপ, যার মাধ্যমে মাত্র ৭৫ মিনিটে জানা যাবে নতুন স্ট্রেনের খবর। খরচ পড়বে ১০ ডলারেরও কম। এই পরীক্ষারই পোশাকি নাম দেওয়া হয়েছে, রে অর্থাৎ Rapid variant AssaY। কাজ করবে জোড়া ফলা হিসেবে। করোনা ধরবে। নতুন স্ট্রেন কি না, জানান দেবে তাও। দেখতে প্রেগনেন্সি স্ট্রিপের মতো, রং বদলালেই হাতে রিপোর্ট। বুধবার এই আবিষ্কারের কথা সামনে এনেছে প্রি-প্রিন্ট জার্নাল মেডিক্যাল আর্কাইভ।
দেবজ্যোতি এবং সৌভিক দু’জনেই নয়াদিল্লির সিএসআইআর প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট অব জিনোমিক্স অ্যান্ড ইন্টিগ্রেটিভ বায়োলজি (আইজিআইবি)-র বিজ্ঞানী। লকডাউনের মধ্যে ল্যাবে লড়াই চালিয়ে করোনা ধরার ‘ফেলুদা’ (এফএনক্যাস৯ এডিটর লিমিটেড ইউনিফর্ম ডিটেকশন অ্যাসে) কিট তৈরি করেছিলেন দু’জনে। সেপ্টেম্বরে সেই কিটে সিলমোহর দেয় ড্রাগ কন্ট্রোলার জেনারেল অব ইন্ডিয়া। ‘রে’ এই ‘ফেলুদা’রই আধুনিক সংস্করণ। বলা যেতে পারে, সৃষ্টির চেয়ে স্রষ্টা আরও বেশি দুঁদে! ‘ফেলুদা’ শুধু করোনা ধরতে পারত, ‘রে’ খোঁজ দেবে করোনার বদলে ফেলা অস্ত্রসম্ভারেরও।
কী সেই অস্ত্রসম্ভার? এই পরীক্ষায় পাখির চোখ করা হয়েছে করোনার এমন একটি মিউটেশন অর্থাৎ পরিবর্তনকে, যার উপস্থিতি রয়েছে ব্রিটেন, ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকার তিন স্ট্রেনেই। N501Y- স্পাইক প্রোটিনের ৫০১ নম্বর অ্যামাইনো অ্যাসিড পজিশনে অ্যাসপারাজিনের জায়গায় এসেছে টাইরোসিন। এবং স্পাইকের যে অংশের মাধ্যমে মানুষের শরীরে ঢোকার বন্দোবস্ত করে, সেই রিসেপ্টর বাইন্ডিং ডোমেনের এই মিউটেশনের ফলে করোনা আরও সংক্রামক হয়ে উঠেছে বলেই মনে করা হচ্ছে। নমুনায় এই মিউটেশনের খোঁজ পাওয়ার অর্থই হল, স্ট্রেনটি নতুনই।
পুরোপুরি স্বাভাবিক না হলেও ভারতের সঙ্গে বিভিন্ন দেশের বিমান যোগাযোগ আবার শুরু হয়েছে। ফলে ব্রিটেন, ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকার অতি সংক্রামক স্ট্রেন ভারতে পৌঁছনো খুবই স্বাভাবিক। ইতিমধ্যেই বিলিতি স্ট্রেনের খোঁজ মিলেছে দেশে। এখনও পর্যন্ত সংক্রমণের ঢেউ না দেখলেও সাবধানী কেন্দ্র। তাই জোর দেওয়া হয়েছে জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের উপর। কিন্তু বিপুল জনসংখ্যার কথা মাথায় রাখলে ‘রে’ স্ট্রিপ অনেক বেশি উপযোগী হতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশেষ করে বিমানবন্দরে এই স্ট্রিপ ব্যবহার করলে সঙ্গে সঙ্গেই স্ট্রেন সম্পর্কে হাতে-নাতে তথ্য মিলবে। এখনকার মতো অপেক্ষা দীর্ঘ হবে না।
দেবজ্যোতির কথায়, ‘এই স্ট্রেনের সংক্রমণে আক্রান্তের ভাইরাল লোড বেশি থাকছে। বেশি থাকছে সংক্রমণ ছড়ানোর সম্ভাবনাও। তাই নতুন এই ভেরিয়্যান্টের ছড়িয়ে পড়া ঠেকানো জরুরি। তার জন্য উপস্থিতি জানা দরকার। এখানেই আমাদের ‘রে’ কাজে দেবে।’
জিন এডিটিংয়ের ক্রিসপার ক্যাস৯ পদ্ধতি এই মুহূর্তে বিশ্বের অন্যতম বন্দিত প্রযুক্তি। যার পথ দেখিয়ে গত বছর কেমিস্ট্রিতে নোবেল পেয়েছেন ফরাসি বিজ্ঞানী ইমানুয়েল শারপঁসিয়ে ও মার্কিন বিজ্ঞানী জেনিফার এ ডাউডনা। দেবজ্যোতিরা বলছেন, শুধু করোনা নয়, অন্য রোগ নির্ণয় করতেও কাজে দেবে এই ক্যাস৯ প্রোটিন।