বেঙ্গালুরু: ‘দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের সময়, তাঁকে রক্ষা করার জন্য অন্তত একজন ভগবান কৃষ্ণ ছিল। কিন্তু, আধুনিক যুগে এই দুর্যোধনদের পৃথিবীতে দ্রৌপদীদের কে বাঁচাবে?’ বৃহস্পতিবার (১৪ ডিসেম্বর), এক মহিলাকে বেধড়ক মারধর এবং প্রকাশ্যে নগ্ন করে হাঁটানো ও ওই অবস্থায় একটি খুঁটিতে বেঁধে রাখার মামলার শুনানিতে, এমনই মন্তব্য করলেন কর্নাটক হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি পিবি ভারালে। গত সোমবার (১১ ডিসেম্বর), বেলগাভি জেলার এক গ্রামে এই ঘটনা ঘটেছিল। নির্যাতিত মহিলার ছেলের বিরুদ্ধে গ্রামেরই এক মেয়েকে নিয়ে পালানোর অভিযোগ উঠেছিল। মেয়েটির অন্যত্র বিয়ে ঠিক হয়েছিল। তবে, ওই ছেলে এবং মেয়েটির মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক ছিল। ওই যুগল গ্রাম ছেড়ে পালানোর পর, ছেলেটির মায়ের উপর যারপরনাই অত্যাচার চালিয়েছিল মেয়েটির বাবা-সহ তাঁর বাড়ির লোকজন। এরপরই স্বতঃপ্রণোদিতভাবে এই মামলা গ্রহণ করেছিল আদালত।
এদিন এই ঘটনা নিয়ে এদিন তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করেছে প্রধান বিচারপতি পিবি ভারালে এবং বিচারপতির কৃষ্ণা এস দীক্ষিতের বেঞ্চ। নির্যাতিতা মহিলাকে সাহায্যে করার বিষয়ে পুলিশ কেন আরও তত্পর ভূমিকা নেয়নি, সেই প্রশ্নও তুলেছে আদালত। বেঞ্চের মতে, পুলিশ আরও তৎপর হলে, এই ঘটনা ঘটতই না। প্রধান বিচারপতি পিবি ভারালে বলেন,
“মহিলাকে যে মানসিক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে, তা বলার মতো আমার কোনও ভাষা নেই। দুই ঘন্টা ধরে তাঁর উপর অত্যাচার চলেছে। তাঁকে বাড়ি থেকে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, ছিনতাই করা হয়েছিল, পশুর মতো পেটানো হয়েছে। তাঁকে বাড়ি থেকে বের করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল রাত ১টায়। আর পুলিশ সেখানে পৌঁছেছিল ভোর সাড়ে তিনটেয়। হামলাকারীারা কি মানুষ? এমনকি পশুদেরও সুবুদ্ধি আছে। মানুষ কীকরে এমন আচরণ করতে পারে? দুই ঘন্টা ধরে তাঁকে পিটিয়েছে পশুরা…আমার তাদের মানুষ বলতে লজ্জা হচ্ছে। এত নিষ্ঠুর, এত অমানবিক?”
বিচারপতি দীক্ষিত বলেন, ” আমরা জানি প্রশাসন বিষয়টিকে গুরুত্ব সহকারে নিয়েছে। কিন্তু, এটা ঘটতে দেওয়া হল কেন? কেন পুলিশ ছিল না? পুলিশের কাজ শুধু তদন্ত করা নয়, অপরাধ আটকানোও পুলিশের কাজ। এই ধরনের ঘটনার বিরুদ্ধে পুলিশের সতর্ক থাকা উচিত ছিল। ওই যুগলের পালিয়ে যাওয়ার খবর গ্রামে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল। যাতে কোনও অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে, তার জন্য গ্রামবাসীদের সতর্ক করতে পারত বেলগাভি জেলার পুলিশ।”
এই অমানবিক আচরণের পিছনে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতাকে দায়ী করেছেন কর্নাটক হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি। তিনি বলেন, “আমি খুব বলতে চাই, এই ঘটনার মূলে রয়েছে পুরুষতান্ত্রিকতা। শুধুমাত্র পুরুষ বলেই কি তারা কোনও মহিলার সঙ্গে নৃশংস আচরণ করতে পারে? শুধুমাত্র পুরুষ হওয়ার কারণেই এই লাইসেন্স পায় তারা? এটা কি মানসিকতার দোষ নয়?” এই প্রসঙ্গে সাহির লুধিয়ানির একটি কবিতার লাইনও উদ্ধৃত করেন তিনি। তিনি বলেন, “পুরুষদের জন্ম দিয়েছে মহিলা, আর পুরুষরা তাঁকে বাজার দিয়েছে, ইচ্ছামত পিষ্ট ও পদদলিত করার জন্য, প্রত্যাখ্যান করার জন্য এবং ইচ্ছামত ছিবড়ে করে ফেলে দেওয়ার জন্য।”
এই ঘটনা গ্রামের অন্যান্য মহিলাদের উপরও গভীর প্রভাব ফেলতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে আদালত। বিচারপতি দীক্ষিত বলেন, “দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের সময়, মহাভারতেও এরকম ঘটেনি। এই ঘটনা তার থেকেও অনেক, অনেক বেশি জঘন্য। সৌভাগ্যবশত, সেই সময় দ্রৌপদীকে সাহায্য করার জন্য ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ছিলেন। এই আধুনিক যুগে, বেচারি দ্রৌপদীকে সাহায্য করবে কে? কোন কৃষ্ণ সাহায্য করতে আসবেন না! দ্রৌপদী যখন হাহাকার করছিলেন, তখন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে সাহায্য করেছিলেন। দুর্ভাগ্যবশত, এটা দুর্যোধন ও দুঃশাসনদের জগৎ। কোনও ভগবান কৃষ্ণ সাহায্য করতে আসবেন না।”