পরীক্ষার আগে মনে নানা চিন্তা-দুশ্চিন্তা থাকেই। পড়ুয়াদের মনোবল বাড়াতেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এক অভিনব উদ্যোগ নেন। শুরু করা হয় পরীক্ষা পে চর্চা, যেখানে পরীক্ষার্থীদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। পড়ুয়াদের যাবতীয় প্রশ্ন, তা সে পড়াশোনা বা পরীক্ষা নিয়েই হোক বা কেরিয়ার, সব প্রশ্নের উত্তর দেন প্রধানমন্ত্রী। আজ, ২৭ জানুয়ারি দিল্লিতে আয়োজন করা হয়েছে এই অনুষ্ঠানের। এবারে মোট ৩৮ লক্ষ পড়ুয়া নিজেদের নাম রেজিস্টার করেছেন। মোট ২০ লক্ষ প্রশ্ন জমা পড়েছে, এনসিইআরটি-র তরফে সেই প্রশ্নের ঝাড়াই-বাছাই করা হয়েছে, এই প্রশ্নগুলির উত্তর দেবেন প্রধানমন্ত্রী মোদী।
পরীক্ষা পে চর্চা অনুষ্ঠানের শেষ প্রশ্ন ছিল, পড়ুয়ারা সমাজে কীভাবে আদর্শ মানুষ হয়ে উঠবে। এর উত্তরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “দশম বা দ্বাদশ শ্রেণির পরীক্ষা হয়ে যাওয়ার পর পড়ুয়াদের হাতে কিছু টাকা দিন এবং ঘুরে আসতে বলুন। এই কয়েক দিনে কী কী শিখল তারা, তা জানতে চান। এতেই আপনার সন্তান বা পড়ুয়ারা সমাজ সম্পর্কে পরিচিত হবে, শিক্ষিত হবে। ঘরবন্দি করে রাখলে চলবে না। বাচ্চাদের মানসিক, সামাজিক বিস্তার হতে দিন। আমাদের ছোটবেলায় মামাবাড়ি, কাকার বাড়ি যাওয়া হত ছুটি পড়লেই, এর অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল সমাজের সঙ্গে পরিচিত করানো। সন্তানদের স্বভাব-আচরণ সম্পর্কে সচেতন হন। কিন্তু তাদের উপরে নিজের প্রত্যাশা চাপিয়ে দেবেন না। সাফাই কর্মীরা এলেও তাদের সঙ্গে কথা বলতে দিন। প্রশ্ন করতে বলুন তাঁর পেশা, বাড়ি, পরিবার সম্পর্কে। সন্তানকে সুযোগ দিন, তবেই সে আদর্শ মানুষ হিসাবে বেড়ে উঠবে।”
ক্লাসে কীভাবে নিয়মানুবর্তিতার সঙ্গে পড়ানো যায়, এই নিয়ে প্রশ্ন করেন এক শিক্ষক। জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আজকাল মনে হয়, শিক্ষকেরা নিজেদের মধ্যেই হারিয়ে রয়েছেন। তারা সিলেবাস অনুযায়ী ক্লাসে এসে ২০-৩০ মিনিট পড়ান। ব্যাস ওইটুকুই। তারা যদি পড়াতে গিয়ে কোনও বিষয় ভুলে যান, তাহলে পড়ুয়াদের বুঝতে দিতে চান না। উল্টে কোনও পড়ুয়াকে বকাঝকা শুরু করেন। শিক্ষকেরা আজকাল মোবাইল দেখে পড়ান। পড়ুয়াদের সঙ্গে মিশতে শিখুন। পড়ুয়ারা আপনাদের ছোট করতে বা আপনার পরীক্ষা নিতে চায় না, এই ভুল ধারণা দূর করুন। এটা তার জিজ্ঞাসা। তাঁকে চুপ করাবেন না। যদি উত্তর জানা না থাকে, তবে সত্য়িটা বলুন। পরের দিন উত্তরটা জেনে এসে তাঁকে বোঝান।”
বিশ্বের সবথেকে পুরনো ভাষা তামিল, এটা অত্যন্ত গর্বের বিষয়। এই নিয়ে গর্ব করুন। বিশ্বের কাছে আমি গর্ব করি তামিল ভাষার এই ঐতিহ্য নিয়ে। উত্তর ভারতের মানুষেরাও ধোসা খান, দক্ষিণ ভারতেও পরোটা-সবজি পাওয়া যায়। খাবারে যেমন প্রতিবন্ধকতা নেই, তেমন ভাষাতেও প্রতিবন্ধকতা থাকা উচিত নয়।
একাধিক ভাষা শেখার জন্য কী করা উচিত, সেই প্রশ্নের উত্তরে প্রধানমন্ত্রী বললেন, “বিদেশিদের অনেক সময় দেখবেন আপনাকে নমস্কার বলে সম্ভাষণ করছেন। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের একটা আত্মিকতা অনুভব হয়। শখ হিসাবে আমরা যেমন নাচ-গান বা তবলা শিখি, সেভাবেই প্রতিবেশী রাজ্যগুলির ভাষা শেখারও চেষ্টা করা উচিত। ভাষা শিখলে শুধু নতুন শব্দের সঙ্গে পরিচিতিই নয়, বরং সেই ভাষার পিছনে যে হাজার বছরের পুরনো ইতিহাস রয়েছে, তাও জানা যায়।”
“বন্ধুরা কী করছে, তা দেখে আমরাও প্রভাবিত হই, সর্বক্ষণ প্রতিযোগিতা চলে। তই চিন্তাও বাড়ে। নিজের জন্য বাঁচো। জীবন কখনও কারোর জন্য দাঁড়িয়ে থাকে না। পরীক্ষাই জীবনের শেষ ধাপ নয়। যাই হোক, জীবনে হার মানলে চলবে না। এই মন্ত্রই অনুসরণ করে চলা উচিত”, পড়ুয়াদের এমনটাই পরামর্শ দিলেন প্রধানমন্ত্রী।
আশাতীত ফল না হলে, অনেক পড়ুয়ারই মনোবল ভেঙে যায়। এই সমস্যার প্রতিকার জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমরা পরীক্ষা দিয়ে ফিরে বাড়িতে এমনভাবে বলি যেন পরীক্ষায় ৯০ পাব। এদিকে রেজাল্ট বেরলে দেখা যায ৪০-৪৫ পেয়েছে। এই জন্য বলছি, মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া উচিত নয়।”
উপোস করলে যেমন শরীর সুস্থ থাকে, ঠিক সেভাবেই সপ্তাহে একদিন বা দিনে কয়েক ঘণ্টা ডিজিটাল মাধ্যম ও প্রযুক্তি থেকে উপোস করার পরামর্শ দিলেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ” একই ঘরে বসে এখন হোয়াটসঅ্যাপ করেন এখন সবাই। এই রোগকে দূর করতে হবে। বাড়িতে এমন একটা জায়গা চিহ্নিত করুন, যা নো টেকনোলজি জ়োন হবে। সেখানে কোনও প্রযুক্তির ব্যবহার করা যাবে না।”
নিজের উদাহরণ টেনে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমার হাতে কখনও মোবাইল দেখেছেন? আমি কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ায় খুব সক্রিয়। কিন্তু আমি তার জন্য় একটা নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দিয়েছি। গ্যাজেটের গুলাম হলে চলবে না। নিজেদের ক্ষমতা হারিয়ে ফেললে চলবে না। বরং কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। নিজেরা কী করতে পারি, তার নিয়মিত মূল্য়ায়ন করতে হবে।”
সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে পড়ুয়ারা সহজেই মনোযোগে বিঘ্ন ঘটে। এর সমাধান চেয়ে প্রধানমন্ত্রীকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “প্রথমে ভাবুন আপনি স্মার্ট নাকি গ্যাজেট? অনেকেই মনে করেন নিজেদের থেকে গ্যাজেট বেশি স্মার্ট। এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। ভারতে গড়ে ৬ ঘণ্টা সাধারণ মানুষ ফোনের উপরে খরচ করেন। যখন টকটাইমের ব্যবস্থা ছিল, তখ গড়ে ২০ মিনিট খরচ হত। আমাদের সৃজনশীলতার ৬ ঘণ্টা মোবাইলেই নষ্ট করে ফেললে , বড় বিপদ।”
সংসদের উদাহরণ টেনে বলেন, “অনেক সাংসদ খুব চালাক। ইচ্ছাকৃতভাবে এমন মন্তব্য বা টিপ্পনী করেন, যাতে যিনি বলছেন, তাঁর ফোকাস নষ্ট হয়ে যায়। তিনি তখন নিজের আলোচ্য বিষয় ছেড়ে ওই টিপ্পনীর জবাব দিতেই ব্যস্ত হয়ে পড়েন। দোষারোপ ও আলোচনার মধ্যে অনেক ফারাক রয়েছে। দোষারোপকে গুরুত্ব দিতে হবে না, তবে আলোচনাকে হালকাভাবে নেওয়া উচিত নয়।”
বিরোধীদের সমালোচনাকে কীভাবে গ্রহণ করেন প্রধানমন্ত্রী, এই প্রশ্নের উত্তরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আপনারা পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি ফিরে বন্ধু-বান্ধব বা পরিবারের সঙ্গে আলোচনা করতে বসে যদি দেখেন যে কোনও উত্তর ভুল দিয়েছেন, তখন আপনারা বলেন যে আউট অব সিলেবাস প্রশ্ন এসেছে। আমি বিশ্বাস করি, সম্মৃদ্ধ লোকতন্ত্রের অন্যতম শর্ত হল আলোচনা। ওপেন সোর্স টেকনোলজিতে সকলে নিজেদের মতামত রাখেন, তাদের সেই পরামর্শ গ্রহণ করেই সবথেকে ভাল প্রযুক্তি তৈরি হয়। বিভিন্ন সংস্থা তাদের প্রযুক্তি বা পণ্যে ভুল বা গাফিলতি ধরিয়ে দিলে পুরস্কার দেন। যখন প্রিয়জন সমালোচনা করে, তখন আপনি সেই সমালোচনা ইতিবাচকভাবে নেন। কিন্তু অপছন্দের ব্যক্তি সমালোচনা করলেই রেগে যান। বাড়িতে আলোচনা হয় না। এর জন্য মা-বাবাদেরও অনেক অধ্যয়ন করতে হয়। আপনি বন্ধুদের সঙ্গে কতক্ষণ সময় ব্যয় করছেন, কতক্ষণ মোবাইল ব্যবহার করছেন, তা বুঝে শান্তভাবে বোঝানো উচিত। আজকাল মা-বাবাদের হাতে সময় নেই, তাই বকাবকি করেন, তাই আপনারা রেগে যান।”
হার্ডওয়ার্ক বনাম স্মার্টওয়ার্কের তুলনায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, “একসঙ্গে সবকিছু পেতে চাইলে চাপ তো বাড়বেই। কোন ক্ষেত্রে কী প্রয়োজন, তা আগে অনুধাবন করুন। সেই অনুযায়ী স্মার্টলি হার্ডওয়ার্ক করুন।”
হার্ডওয়ার্ক নাকি স্মার্টওয়ার্ক, কোনটা বেশি জরুরি, এমনই প্রশ্ন করেন এক পড়ুয়া। এর জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “কলসি থেকে কাকের জলপানের গল্পটা সকলেই জানেন। এটাকে কী বলবেন? কিছুজন এমন হন, যারা বরাবর কঠোর পরিশ্রম করেন। কিছুজনের জীবনে কঠোর পরিশ্রম শব্দটাই নেই। আবার কেউ স্মার্টলি হার্ডওয়ার্ক করেন। আগে বিষয়টি বুঝুন, তারপরে বিচার করুন যে সমস্যা সমাধানের জন্য পরিশ্রমের প্রয়োজন নাকি বুদ্ধিমত্তার।”
পড়ুয়াদের কঠোর পরিশ্রমী হতে বললেন প্রধানমন্ত্রী। শর্টকাটে সাফল্য মেলে না।
পরিশ্রমী পড়ুয়াদের উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আপনাদের কঠোর পরিশ্রমের ফল পাবেনই। কেউ হয়তো টুকলি করে আপনার থেকে বেশি নম্বর পেতে পারে, কিন্তু তা নিয়ে চিন্তিত হওয়ার কোনও কারণ নেই।”
প্রধানমন্ত্রী বললেন, “নানান অভিনব পদ্ধতিতে আজকাল পরীক্ষায় নকল করা হয়। আমার মতে, নকল করায় যতটা সময় ব্য়য় করা হয়, সেই সময়টা শেখার জন্য ব্যয় করা উচিত। নকল করে একটা-দুটো পরীক্ষায় পাশ করা যায়, কিন্তু জীবনের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া যায় না।”
পরীক্ষায় টুকলি নিয়ে দুই পড়ুয়ার প্রশ্নের উত্তরে প্রধানমন্ত্রী বললেন, “পরীক্ষায় টোকাটুকি নিয়ে চিন্তা থাকেই। বিশেষ করে ভাল পড়ুয়াদের। তারা পরিশ্রম করে পড়াশোনা করেন, অথচ কয়েকজন টুকলি করে পাশ করে যান। এই নিয়ে অনেকে গর্বও করেন। মূল্যবোধের এই পরিবর্তন ভয়ঙ্কর।”
বাড়িতে সবথেকে বেশি কাজ করেন মায়েরা। যেভাবে মায়েরা সময়ের হিসাব করে সমস্ত কাজ করেন, তা দেখে শেখা উচিত। তারা কখনও ক্লান্ত হন না। যদি একটুও অবসর পান, তাতেও অন্য কোনও কাজ নিয়ে বসে পড়েন। মায়েদের কাজ থেকেই সময়ের মাইক্রো ম্যানেজমেন্ট শেখা উচিত।
পড়ুয়াদের সময়ের সঠিক ব্যবহার নিয়ে পাঠ দিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “শুধু পড়াশোনা বা পরীক্ষায় নয়, জীবনেও সময়ানুবর্তিতা অত্যন্ত জরুরি। কাজ নিয়ে ভাবলেই বরং ক্লান্তি আসবে। তার থেকে না ভেবে আগে কাজ করা শুরু করুন। পড়তে বসে কোন বিষয় কতক্ষণ কোন বিষয় পড়বেন, তা সময় অনুযায়ী ভাগ করে নিন। শুধুমাত্র পছন্দের বিষয়েই সম্পূর্ণ সময় খরচ না করে, প্রথমে অপছন্দের বা কঠিন বিষয়ে আধ ঘণ্টা, তারপর পছন্দের বিষয়ের জন্য ২০ মিনিট বরাদ্দ করুন। এভাবে পড়লে সমস্ত বিষয়ই পড়া হয়ে যাবে।”
পড়ুয়াদের উপরে পড়াশোনার চাপ ও পরিবারের প্রত্যাশা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ক্রিকেট খেলার সঙ্গে তুলনা টানলেন। স্টেডিয়ামে সবাই চার, ছয় বলে চিৎকার করলেও ব্য়াটসম্যান যেমন নিজের খেলার উপরেই নজর দেন, ঠিক সেরকমভাবেই পড়ুয়ারাও যেন পরিবার বা সামাজিক চাপে না পড়ে, শুধুমাত্র নিজের পড়াশোনাতেই মন দেন।
পড়াশোনা নিয়ে পরিবারের যে চাপ থাকে পড়ুয়াদের উপরে, সেই সংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “প্রত্য়াশা থাকবেই। কিন্তু নিজেদের ক্ষমতা বোঝা উচিত। আমার আপনাদের কাছে অনুরোধ, সামাজিক চাপ নিয়ে নিজেরা উদ্বিগ্ন হবেন না। বরং নিজেদের যথা সম্ভব ক্ষমতা ব্যবহার করুন, যাবতীয় সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।”
পরীক্ষা পে চর্চা অনুষ্ঠানের শুরুতেই প্রধানমন্ত্রী বললেন, “এটা আমারও পরীক্ষা। লক্ষাধিক পড়ুয়া আমার পরীক্ষা নিচ্ছে। আপনারা যেমন পরীক্ষার আগে চিন্তিত থাকেন, তেমন আমিও চিন্তিত আপনাদের সঙ্গে কথা বলা নিয়ে।”
আজ, ২৭ জানুয়ারি পরীক্ষা পে চর্চা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। দেশের ৩৮ লক্ষ পড়ুয়া নিজেদের নাম রেজিস্টার করেছেন। ২০ লক্ষ প্রশ্ন জমা পড়েছে, এই সমস্ত প্রশ্নের মধ্যে থেকেই প্রয়োজনীয় প্রশ্নগুলির উত্তর দেবেন প্রধানমন্ত্রী।