চেন্নাই: হিন্দু কোনও ধর্ম নয়। হিন্দু এক ভূমি, যা কালক্রমে এক সভ্যতায় পরিণত হয়েছে। সনাতন ধর্ম নিয়ে বিতর্কের মধ্যে এমনই জানিয়েছেন সদগুরু। হিন্দু হওয়ার প্রকৃত অর্থ কী, কীভাবে এই সভ্যতা বহু যুগ ধরে সংরক্ষিত রয়েছে, এই সকল বিষয় ব্যাখ্যা করেছেন তিনি। তিনি জানিয়েছেন, হিমালয় এবং ভারত মহাসাগরের মধ্যবর্তী ভূমিই হল হিন্দু। এখানে যারা বসবাস করত, তাদেরও হিন্দু বলা শুরু হয়েছিল এবং অঞ্চলটিকে হিন্দুস্থান নাম পেয়ছিল। এই সভ্যতা কোনও একক বিশ্বাস, শিক্ষা বা গ্রন্থকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠেনি। ভূগোল, জাতিসত্তা, ভাষা, খাদ্য এবং সংস্কৃতির এক বিশাল বৈচিত্র্যে সম্বৃদ্ধ এই সভ্যতা। শাস্তি, অপরাধবোধ এবং স্বর্গীয় পুরস্কারের টোপ থেকে মুক্ত হয়ে এই সভ্যতা আমাদের চূড়ান্ত প্রকৃতির সন্ধান করেছিল।
আর এই চূড়ান্ত প্রকৃতির সন্ধানেই হিন্দুরা বিজ্ঞান এবং জ্ঞানের সাধনায় ডুব দিয়েছিল। সদগুরু জানিয়েছেন, হাজার হাজার বছর আগেই হিন্দুরা জানত পৃথিবী গোলাকার এবং এটি সূর্যের চারপাশে ঘুরছে। বিশ্বাস নয়, হিন্দুরা অন্বেষণ করে। আর তাই হিন্দুরা এই উপলব্ধিতে পৌঁছতে পেরেছিল। বিশ্বাসী হলে বিজ্ঞানী হওয়া যায় না। কারণ বিশ্বাস মানে এমন কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছন, যা সম্পর্কে নিজের কোনও ধারণা নেই। এই সাধনায় হিন্দুরা গণিত, সঙ্গীত, জ্যোতির্বিদ্যা, অতীন্দ্রিয়বাদ – সমস্ত দিকে এগিয়েছিল। জ্ঞানের চাহিদা এবং উপলব্ধির গভীরতা বৃদ্ধি পেলে, হিন্দুরা জানতে পেরেছিল, মহাবিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ অলৌকিক ঘটনা। সবকিছু শূন্য থেকেই সৃষ্টি হয় এবং শূন্যেই ফিরে যায়। জাগতিক সবকিছুই নিছক একটি প্রকাশ। অনুসন্ধানী সভ্যতা বলেই হিন্দুদের কিছুই নিষিদ্ধ নয়। অঘোরী, তান্ত্রিক এবং বিভিন্ন পন্থার মানুষ রয়েছে। প্রত্যেকেরই অভিপ্রায়, জীবনের মূল অংশকে স্পর্শ করা।
সদগুরু আরও জানিয়েছেন, মানব বুদ্ধি আজ অনেক বেশি সক্রিয় হওয়ায় মানুষ বুঝতে পেরেছে, জীবনই সকলের কর্ম। আর এই উপলব্ধিই হিন্দু। হিন্দু কোন ধর্ম বা কোন বিশেষ জীবনধারা নয়। হিন্দু একটি ভূমি। এই ভূমির কারণে, মানুষের কারণেই এই সভ্যতা হিন্দু হয়েছে। সভ্যতার কারণেই দেশ হিন্দুস্তান হয়েছে। ভয়, অপরাধবোধ ও লোভের প্রভাব থেকে বুদ্ধিকে মুক্ত করতে পারলেই যে কেউ হিন্দু হতে পারে। একেই বলা হয় সনাতন ধর্ম। সনাতন মানে শাশ্বত, অর্থাৎ, যা চিরন্তন। ধর্ম মানে হল আইন বা নিয়ম। চিরন্তন নিয়ম হল, পৃথিবীতে আমরা সবাই আলাদা হলেও, জীবনের শেষে, সবাই মাটিতে ফিরে যায়। কাউকে পুড়িয়ে দেওয়া হয় বা কাউকে কবর দেওয়া হয়। শাশ্বত প্রকৃতির জন্য উচ্চাকাঙ্খাই সনাতন ধর্ম।
তাঁর মতে, শাশ্বত বলেই গত হাজার বছরে নৃশংস আক্রমণ নেমে আসার পরও, সনাতন ধর্মের পথ আঁকড়ে থেকেছে হিন্দুরা। কারণ, এটা কোন ধর্ম নয়। এর কোনও একক নেতা নেই। কোনও একক মতবাদ বা বই নেই। তাই, নেতা, মতবাদ বা বই ধ্বংস করে সনাতন ধর্মকে খতম করা যায়নি। হামলাকারীরা ধর্মীয় নেতাদের হত্যা করেছে। হাজার হাজার মন্দির ধ্বংস করেছে। কিন্তু সনাতন ধর্মকে হত্যা করতে পারেনি। কারণ তা হিন্দুদের হৃদয়ে রয়ে গিয়েছে। জানার স্বাভাবিক আকাঙ্ক্ষাকে হত্যা করা যায় না। মনকে ভয়, লোভ এবং অপরাধবোধ থেকে মুক্ত করলে মানুষ স্বাভাবিকভাবেই তার চিরন্তন প্রকৃতির সন্ধান করে। হিন্দুই একমাত্র ভূমি, যা বহিঃশক্তির আক্রমণের পরও, অনেকাংশে তার সংস্কৃতিকে ধরে রেখেছে। কোনও ব্যবস্থাকে ধ্বংস করা যায়, কিন্তু সংগঠিত, ইচ্ছাকৃত বিশৃঙ্খলাকে ধ্বংস করা যায় না। এটাই সনাতন ধর্মের শক্তি বলে জানিয়েছেন সদগুরু।
গোটা বিশ্বের সকলে যদি ভয়, অপরাধবোধ এবং লোভ মুক্ত হয়, তাহলে গোটা বিশ্বেই সনাতন ধর্ম ছড়িয়ে পড়বে বলে আশা প্রকাশ করেছেন সদগুরু। তবে, এর মানে তারা সকলে ধর্মান্তরিত হবে, তা নয়। কারণ হিন্দুদের মধ্যে ধর্মান্তরিত হওয়ার জন্য কোন আদর্শ, কোন দর্শন, কোন ঈশ্বর নেই। চূড়ান্ত প্রকৃতির সন্ধানীরা সকলেই সনাতনী। কারণ, প্রকাশ ক্ষণস্থায়ী। কিন্তু উৎস চিরন্তন। কারও আগ্রহ শরীর থেকে উৎসে চলে গেলেই সে সনাতনীতে পরিণত হয়। চিরন্তন প্রকৃতির সন্ধানীরাই সনাতনী। সনাতনীরা নিজের জীববিজ্ঞান বা মনোবিজ্ঞানকে অবজ্ঞা করে না, এগুলির ঊর্ধ্বে থাকতে চায়। যাতে জীববিজ্ঞান এবং মনোবিজ্ঞানের উপর নিয়ন্ত্রণ থাকে। সনাতন মানে সকল প্রকাশের ঊর্ধ্বে থাকা। সদগুরুর মতে, মানুষের সবথেকে বড় বাধা তার শরীর এবং মন। এই শরীর, এই মনের বাধাকে উত্তরণের ধাপে পরিণত করতে পারলেই সনাতনী হওয়া যায়।