নয়া দিল্লি: লোকসভা ভোটকে পাখির চোখ করে এগোচ্ছে বিরোধী দলগুলিকে। বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এক ছাতার তলায় আসছে তারা। তৈরি হয়েছে অবিজেপি দলগুলির মিলিত মঞ্চ ‘ইন্ডিয়া’। বাম-কংগ্রেস-তৃণমূল কে নেই সেখানে! সীতারাম ইয়েচুরি, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, সনিয়া গান্ধী, অরবিন্দ কেজরীবাল, লালু প্রসাদ যাদব, নীতীশ কুমার… একেবারে চাঁদের হাট। কিন্তু বিজেপিকে টক্কর দেওয়ার জন্য কি তৈরি বিরোধীদের টিম ‘ইন্ডিয়া’? এই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
কারণ প্রাদেশিক রাজনীতির সমীকরণ। পশ্চিমবঙ্গ থেকে শুরু করে পঞ্জাব, বিহার… একাধিক রাজ্যে প্রাদেশিক রাজনীতির অঙ্ক এমন জটিল হয়ে উঠেছে, যে তা ‘ইন্ডিয়া’ ব্লক শেষ পর্যন্ত কতটা কার্যকর হবে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠে যাচ্ছে। প্রশ্ন উঠছে, জোট শেষ পর্যন্ত টিকবে তো?
এই যেমন পশ্চিমবঙ্গের কথাই ধরা যাক। এখানে তৃণমূলের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এককাট্টা বাম-কংগ্রেস। অধীররঞ্জন চৌধুরী, মহম্মদ সেলিমরা নাগাড়ে আক্রমণ শানিয়ে যাচ্ছেন মমতার দলকে। জাতীয় রাজনীতিতে সমীকরণ যাই হোক না কেন, বাংলার মাটিতে তৃণমূলের বিরুদ্ধে একেবারে খড়্গহস্ত তাঁরা। এ রাজ্যে অধীর-সেলিমদের অবস্থান স্পষ্ট, তৃণমূল ও বিজেপি উভয়ের বিরুদ্ধেই লড়াই তাঁদের।
প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীরবাবু তো প্রায় নিত্যদিন আক্রমণ শানিয়ে যাচ্ছেন তৃণমূল সুপ্রিমোকে। রাজ্যে লগ্নি টানতে সম্প্রতি স্পেন সফরে গিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তা নিয়েও খোঁচা দিয়েছেন অধীর। মমতার স্পেন সফরকে ‘অযথা খরচ’ বলে কটাক্ষ করেছেন তিনি। বাংলার ডেঙ্গি পরিস্থিতি নিয়েও মুখ্যমন্ত্রীকে কড়া ভাষায় আক্রমণ শানিয়েছেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি। রাজ্যের ডেঙ্গি পরিস্থিতিকে ‘মমতা-মেড’ ও রাজ্য সরকার ‘স্পনসরড’ বলে কটাক্ষ করেছেন অধীর।
এসব আক্রমণ-প্রতি আক্রমণ তো রয়েছেই বাংলায়। এর সঙ্গে চলছে আবার ঘর ভাঙার খেলা। জেলা থেকে শহরে সব জায়গায় কংগ্রেসের সংগঠনে ভাঙন ধরাচ্ছে তৃণমূল। চলতি সপ্তাহেই কলকাতা পুরনিগমের এক কাউন্সিলর কাউন্সিলর যোগ দিয়েছেন তৃণমূলে। যাঁরা হাত ছাড়ছেন, তাঁরা বলছেন মমতা সরকারের ‘উন্নয়নের’ জোয়ারে সামিল হতেই তৃণমূলে যাচ্ছেন। আবার তৃণমূলের যুক্তি কিছুটা এমন, যে কেউ যদি তাদের দলে আসতে চায়, তাহলে তারা কী করবে! তারা তো আর কাউকে জোর করে তৃণমূলে টানছে না।
এ তো গেল বাংলার সমীকরণের কথা। সমস্যা রয়েছে প্রধানমন্ত্রী পদের দাবিদার কে হবেন, সেই নিয়েও। বাংলার তৃণমূল নেতারা কিছুদিন আগে পর্যন্তও দাবি করে আসছিলেন, তারা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেই প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখতে চান। যদিও মমতার এই নিয়ে সুকৌশলী বক্তব্য, ‘প্রধানমন্ত্রীর মুখ হবে ইন্ডিয়াই’। তবে প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবে ‘ইন্ডিয়া’ ব্লকে আরও একাধিক নাম নিয়ে চর্চা শুরু হয়ে গিয়েছে। যেমন পড়শি রাজ্য বিহার। সেখানে আবার দাবি উঠছে নীতীশ কুমারকেই প্রধানমন্ত্রীর পদপ্রার্থী করা হোক। এমনই দাবি তুলছে আরজেডি। আর এই নিয়েই নতুন করে রাজনৈতিক সংঘাতের বাতাবরণ তৈরি হয়েছে টিম ‘ইন্ডিয়া’-র ড্রেসিং রুমে।
সম্প্রতি নীতীশ কুমার পটনার ফুলওয়াড়ি শরিফে গিয়েছিলেন। সেখানে চাদর চড়ান মুখ্যমন্ত্রী। সেই সময় দরগা উপস্থিত ছিলেন লালু প্রসাদের আরজেডির কয়েকজন নেতাও। তাঁদের বক্তব্য ছিল, তাঁরা দোয়া চেয়েছেন যাতে নীতীশ আগামী দিনে প্রধানমন্ত্রী হন। আর ওই দোয়া-পর্বের পরপরই বিহারে আরজেডি নেতাদের সুর বদলে যায়। আরজেডি বিধায়ক ভাই বীরেন্দ্রের বক্তব্য, তিনি চান, আগামী দিনে প্রধানমন্ত্রী বিহার থেকেই হোক। নীতীশ কুমারই হোক। প্রসঙ্গত, ভাই বীরেন্দ্র কোনও ছোটখাটো নেতা নন, বিহারের রাজনীতিতে তিনি লালুর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বলেই পরিচিত। সেই বীরেন্দ্রর মুখে এমন দাবি ঘিরে জোর চর্চা শুরু হয়ে গিয়েছে।
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠে যাচ্ছে, লালুর অঙ্গুলিহেলনেই কি এই মন্তব্য করলেন বীরেন্দ্র? নাকি পোড় খাওয়া লালু এখানে রাজনীতির দাবা খেলায় কোনও আড়াই চাল খেলে দিলেন? প্রশ্ন উঠছে, কারণ কিছুদিন আগে পর্যন্তও রাহুলেরই জয়গান গাইছিলেন লালু। এখন সেই লালু-ঘনিষ্ঠ নেতার মুখেই নীতীশকে প্রধানমন্ত্রীর মুখ করার দাবি? কেন হঠাৎ এমন একশো আশি ডিগ্রি ঘুরে গেল লালুর দল? এই নিয়ে চর্চা শুরু করে গিয়েছে ইন্ডিয়ার অন্দরে।
আরজেডি মুখপাত্র এই বিতর্কের মধ্যে দলের অবস্থান আরও স্পষ্ট করে দিয়েছেন। তাঁর বক্তব্য, “এতে তো খারাপ কিছু নেই। বিহারি হিসেবে আমরাও চাই, বিহার থেকে কেউ প্রধানমন্ত্রী হোক। প্রধানমন্ত্রী করা হোক নীতীশ কুমারকে। তাঁর মধ্যে সেই ক্ষমতা, যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা রয়েছে।”
এই বিতর্কের মধ্যে কৌশলী মন্তব্য অরবিন্দ কেজরীবালের। তাঁর বক্তব্য, “এমন একটি ব্যবস্থা হওয়া দরকার, যেখানে দেশের ১৪০ কোটি জনসংখ্যার প্রতিটি মানুষ মনে করেন, তাঁরা প্রধানমন্ত্রী। আমাদের কোনও একজন ব্যক্তির ক্ষমতায়ণ করলে চলবে না। প্রত্যেক মানুষের ক্ষমতায়ণ করতে হবে।”
‘ইন্ডিয়া’ ব্লকে যে সবকিছু ঠিকঠাক নেই, তা বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য এই খণ্ডচিত্রগুলিই যথেষ্ট। তবে এখানেই শেষ নয়। প্রাদেশিক সমীকরণ ঘিরে সমস্যা বাড়ছে পঞ্জাবেও। পঞ্জাব এখন আম আদমি পার্টির হাতে। সম্প্রতি সেখানে গ্রেফতার হয়েছেন পঞ্জাব কংগ্রেসের অন্যতম বড় মুখ সুখপাল সিং খায়রা। কংগ্রেস নেতার গ্রেফতারি নিয়ে আপের বিরুদ্ধে ক্ষোভ বাড়ছে পঞ্জাবের কংগ্রেস শিবিরে। ইন্ডিয়া জোটের উপরেও তার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে।
পঞ্জাবের প্রবীণ কংগ্রেস নেতা সুখজিন্দর সিং রান্ধাওয়া যেমন বলেই দিয়েছেন, সে রাজ্যে তাঁরা আম আদমি পার্টির সঙ্গে কোনও জোট চাইছেন না। পরিস্থিতি এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে আম আদমি পার্টির প্রধান অরবিন্দ কেজরীবালকেও এই নিয়ে মুখ খুলতে হয়েছে। এক বিবৃতিতে কেজরী জানিয়েছেন, ইন্ডিয়া জোটের প্রতি তাঁরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বলেছেন, “আপ কোনও পরিস্থিতিতেই জোট ভাঙবে না। জোট-ধর্ম পালনে আমরা সবরকমভাবে সচেষ্ট।”
পাঁচটি রাজ্যে ‘ইন্ডিয়া’ জোট সবচেয়ে বেশি সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গ, উত্তর প্রদেশ, কেরল, পঞ্জাব এবং দিল্লি। কেরল ছাড়া বাকি চারটি রাজ্যে কংগ্রেস বর্তমানে সাংগঠনিকভাবে ভীষণ দুর্বল জায়গায় রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ ও উত্তর প্রদেশে তো কংগ্রেস চতুর্থ দল।
এদিকে আবার ইন্ডিয়া জোটের কাজকর্মের জন্য সমন্বয় কমিটি তৈরি হয়েছে। গত ১৩ সেপ্টেম্বর সমন্বয় কমিটি প্রথম বৈঠকে বসেছিল। সেখানে ঘোষণা করা হয়েছিল, অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে ভোপালে জোটের বড় যৌথ সমাবেশ হবে। সবই হচ্ছে, কিন্তু আসন সমঝোতা নিয়েই কিছু হচ্ছে না! আর এই যৌথ সমাবেশ নিয়েও কিছু শোনা যাচ্ছে না।
১৮ জুলাই বেঙ্গালুরু বৈঠকে আলোচনা হয়েছিল ইন্ডিয়া জোটের একটি অফিস খোলার বিষয়ে। দায়িত্ব পড়েছিল কংগ্রেসের উপর। কিন্তু সেটিও এখন হিমঘরে। আপাতত কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়্গের বাড়ি থেকেই টিম ইন্ডিয়ার সমন্বয়ের কাজ চলছে।
১৩ সেপ্টেম্বর সমন্বয় কমিটির ১৩ জন সদস্য শরদ পাওয়ারের বাড়িতে বৈঠকে যোগ দিয়েছিল। কিন্তু সীতারাম ইয়েচুরির দলের কেউ ওই বৈঠকে ছিলেন না। পরে সিপিএম জানিয়ে দেয়, সমন্বয় কমিটিতে তারা কোনও প্রতিনিধি রাখছে না।
মুম্বই বৈঠকের পর শোনা যাচ্ছিল রাজ্যভিত্তিক আসন সমঝোতার পর্ব শুরু হবে এবং অক্টোবরের মধ্যে সেই কাজ হয়ে যাবে। কিন্তু সূত্রের দাবি, বাংলা, দিল্লি, পঞ্জাব-সহ রাজ্যগুলিতে এখনও আসন সমঝোতা নিয়ে কোনও আলোচনাই হয়নি।