নয়া দিল্লি: ২০০৯ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর, নয়া দিল্লির বসন্ত বিহার এলাকায়, অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথে খুন হয়েছিলেন টিভি
সাংবাদিক সৌম্যা বিশ্বনাথন। বুধবার, তাঁর হত্যা রহস্যের সমাধান হল। তাঁকে হত্যর দায়ে ৫ দুষ্কৃতীকে দোষী সাব্যস্ত করল দিল্লির এক আদালত। তারা প্রত্যেকেই এক সংগঠিত অপরাধ চক্রের সদস্য। জিগিষা ঘোষ নামে এক তথ্য প্রযুক্তি কর্মীর হত্যার তদন্তে নেমে, সৌম্যা বিশ্বনাথনের হত্যাকারীদের সন্ধান পায় পুলিশ। আর এই দুই হত্যা রহস্য সমাধানে পুলিশকে সাহায্য করেছে একটি হাতের ট্যাটু, একজন পুলিশকর্মীর কাছ থেকে চুরি যাওয়া একটি ওয়্যারলেস সেট এবং সিসিটিভি ফুটেজ। এই তিন উপকরণের মাধ্যমেই প্রথমে জিগিশা ঘোষ হত্যা মামলার সমাধান করেছিল পুলিশ। পরে, ওই হত্যাকাণ্ডে গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিরা নিজেরাই সৌম্য বিশ্বনাথনকে হত্যার কথাও স্বীকার করে।
২০০৯ সালে, সৌম্যার হত্যার পরায় এক বছর পর লুঠপাটের পর খুন করা হয়েছিল জিগিষা ঘোষকে। ফরিদাবাদের সুরজ কুন্ড এলাকা থেকে তাঁর মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছিল। তার দুই-তিন দিনের মধ্যেই সেই হত্যা মামলার সমাধান করে ফেলেছিল পুলিশ। জিগিষার মৃত্যুর পরও তার ডেবিট কার্ড ব্যবহার করা হয়েছে বলে জানতে পেরেছিল পুলিশ। সেই সূত্র ধরে তদন্ত করতে গিয়ে, পুলিশ পেয়েছিল এক সিসিটিভি ফুটেজ। তাতে দেখা গিয়েছিল, ওই কার্ড যে ব্যবহার করেছে, তার হাতে একটি বিশেষ ট্যাটু ছিল। তার মাথায় ছিল টুপি। আর সঙ্গে ছিল একটি ওয়্যারলেস সেট। তদন্তে জানা যায়, ওয়্যারলেস সেটটি এক পুলিশকর্মীর কাছ থেকে চুরি গিয়েছিল।
এই সূত্র ধরেই তদন্ত করে দিল্লি পুলিশের তদন্তকারী দল খোঁজ পেয়েছিল মাসুদপুরে বাসিন্দা বলজিৎ মালিকের। তার হাতে নিজের নাম ট্যাটু করা ছিল। আর সে একটি ওয়্যারলেস সেট নিয়ে ঘুরত, যা সে আগে এক পুলিশকর্মীর কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিল। তার বাসভবন থেকেই গ্রেফতার করা হয়েছিল বলজিৎকে। পরে, রবি কাপুর ও অমিত শুক্লা নামে আরও দুই দুষ্কৃতীকে গ্রেফতার করা হয়। তিন জনেই জিগিষা হত্যার সঙ্গে জড়িত ছিল। তদন্তকারী পুলিশ কর্তা অতুল কুমার ভার্মা জানিয়েছেন, বসন্ত বিহারে তার বাড়ির কাছ থেকেই জিগিশাকে অপহরণ করেছিল তারা। পরে তাকে হত্যা করে এবং তার কাছে থাকা সমস্ত দামি জিনিসপত্র লুঠ করে। পরে তার দেহটি সুরজ কুণ্ডে ফেলে দেওয়া হয়।
তবে, এই মামলার তদন্তের সময়ই রবি কাপুরকে জেরা করতে গিয়ে চমকে গিয়েছিল পুলিশ। সে নিজেই জানিয়েছিল, এর আগে নেলসন ম্যান্ডেলা মার্গে অপর এক যুবতীকেও তারা হত্যা করেছিল। তবে, সেই ক্ষেত্রে এই তিনজনের সঙ্গে জড়িত ছিল আরও দুইজন – অজয় কুমার ও অজয় শেঠি। এই বিস্ময়কর স্বীকারোক্তির পরই দিল্লি পুলিশের তৎকালীন ডেপুটি কমিশনার (দক্ষিণ), এইচজিএস ধালিওয়াল দুই হত্যা মামলার তদন্তের জন্য তৎকালীন এসিপি ভীষম সিং-এর নেতৃত্বে পুলিশ কর্তাদের আরও একটি দল গঠন করেছিলেন। ভীষম সিং জানিয়েছেন, অভিযুক্তের স্বীকারোক্তি ছিল। কিন্তু, আদালতে শুধু সেটাই প্রমাণ হিসেবে গ্রাহ্য হয় না। তাই, তাঁদের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল ফরেনসিক প্রমাণ সংগ্রহ করা।
ফলে, অভিযুক্তের কাছ থেকে হত্যায় ব্যবহৃত অস্ত্র সংগ্রহ করেছইল পুলিশ। সেই সঙ্গে ঘটনাস্থলের ফরেনসিক স্কেচ করানো হয়েছিল। সেই সঙ্গে, তৈরি করা হয়েছিল ঘটনার ক্রম। অর্থাৎ, সৌম্যা বিশ্বনাথনকে হত্যার রাতে ঠিক কী ঘটেছিল, তাও সাজিয়েছিল পুলিশ। অভিযুক্তদের স্বীকারোক্তির সঙ্গে ঘটনাক্রম মিলে যাওয়াতেই শেষ পর্যন্ত আদালতে অপরাধ প্রমাণ করা গিয়েছে। কী ঘটেছিল সেই অভিশপ্ত রাতে?
পুলিশ জানিয়েছে, ওই রাতে একটি মারুতি ওয়াগন আর গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছিল রবি কাপুর। তাঁর পাশের আসনে ছিল অমিত শুক্লা। পিছনের আসনে ছিল বলজিৎ মালিক এবং অজয় কুমার। সকলেই মত্ত অবস্থায় ছিল। একই সময়ে করোলবাগের ভিডিয়োকন টাওয়ার থেকে বাড়ি একটি মারুতি জেন গাড়িতে করে বসন্ত কুঞ্জের বাড়িতে ফিরছিলেন সৌম্যা। দুষ্কৃতীদের গাড়ি ওভারটেক করেছিলেন সৌম্যা। এক মহিলা চালক তাদের ওভারটেক করেছে, এটা দুষ্কৃতীদের ‘পৌরুষে’ আঘাত দিয়েছিল। তাই, সৌম্যার গাড়িকে টপকে যাওয়ার চেষ্টা করে তারা। সৌম্যা একা আছেন দেখে, তারা আরও বেপরোয়া হয়ে গিয়েছিল। নিজেদের গাড়ির গতি বাড়িয়ে, সৌম্যার গাড়ির সামনে এসে তার রাস্তা আটকানোর চেষ্টা করেছিল তারা। সৌম্যা গাড়ি না থামানোয়, রবি কাপুর গাড়ি লক্ষ্য করে গুলি চালিয়েছিল। গুলিটি সরাসরি সৌম্যার কপালে লেগেছিল এবং সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর মৃত্যু হয়েছিল।
এরপর, একটি ডিভাইডারে ধাক্কা লেগে তার গাড়িটি থেমে গিয়েছিল। সেই সময় সকল অভিযুক্তই ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু মিনিট ২০ বাদে, তারা আবার ঘটনাস্থলে ফিরে এসেছিল। কিন্তু, ততক্ষণে সেখানে পুলিশ এসে গিয়েছিল। পুলিশকে দেখে তারা পালিয়ে গিয়েছিল। এই মামলার পঞ্চম অভিযুক্ত অজয় শেঠি, সরাসরি হত্যাকাণ্ডে জড়িত না হলেও, তার বিরুদ্ধে চুরি, হত্যার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকা, সাহায্য করা এবং এই অপরাধের আয় থেকে লাভবান হওয়ার অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে।